মতামত

মিয়ান আরিফির জবানবন্দি (৪)

মিয়ান আরেফি:”জন্ম আমার বাংলাদেশে। বেড়ে ওঠাও সেখানে। জীবিকা উপার্জনের জন্য প্রবাসে। কিন্তু সেখানে আমার অনেক বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন রয়েছেন। তাদের টানেই ২০২৩ সালে আমি বাংলাদেশে ফিরে যাই।

বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের তিন মাস আগে দেশের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ২০২৩ সালে ২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশে পুলিশ দমন-পীড়ন চালায়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থকদের সংঘর্ষে অন্তত ১১ জন নিহত হন, হাজার হাজার মানুষ আহত হন এবং বিএনপির শীর্ষ এক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। বিএনপি দাবি করে, সমাবেশের আগে ১,৫০০-এর বেশি বিরোধী সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এটি ছিল ওই বছরের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক সমাবেশ।
উত্তপ্ত অবস্থার মধ্যে সে দিন লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) ড. সারওয়ার্দীর সঙ্গে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যাই। সেখানে একটি সংবাদ সম্মেলনে আমি বক্তব্য রাখি। আমার বক্তব্যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের শাসনামল নিয়ে সমালোচনা করি। এছাড়া মার্কিন নিষেধাজ্ঞা, নিরপরাধ মানুষের ওপর পুলিশের নির্মম নির্যাতন, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, আইনের শাসন এবং গণতন্ত্রের অবস্থা নিয়েও কথা বলি।
এর আগে ড. সারওয়ার্দীসহ অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে পরিকল্পনা করি। আমাদের লক্ষ্য ছিল এই বিশাল সমাবেশের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পদত্যাগের দাবি তোলা।
২৯ অক্টোবর ঢাকার বিমানবন্দর থেকে আমাকে আটক করা হয়। দুই দিন পর ড. সারওয়ার্দীকেও গ্রেপ্তার করা হয়। আমরা দু’জনই সাড়ে ৯ মাস কারাগারে বন্দি ছিলাম।
বন্দি জীবন ছিল অত্যন্ত কঠিন ও নিষ্ঠুর। সেখানে যে মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণা ভোগ করেছি, তা কখনো ভুলতে পারব না।
আমাদের মুক্তি ঘটে ফ্যাসিস্ট হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর। সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা, যিনি আমাদের জীবন ও সবকিছু রক্ষা করেছেন।
কাশিমপুর কারাগারে আমার দিনগুলো ছিল ভীষণ কষ্টকর। সেলের বাইরে যাওয়া তো দূরের কথা, হাঁটাহাঁটি বা খোলা বাতাস নেওয়ার অনুমতি ছিল না। আমি সর্বক্ষণ কঠোর নজরদারিতে ছিলাম। হাসিনা সরকার আমাকে একজন কুকুরের মতো পর্যবেক্ষণ করত। প্রতিদিন আমাকে হুমকি দেওয়া হতো। কোনো মানুষের সঙ্গে এমন অমানবিক আচরণ হওয়া উচিত নয়। আমি ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছি।
রক্তপিপাসু আওয়ামী লীগার এবং ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে কঠোর জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত। তাদের বিরুদ্ধে ক্রসফায়ারের মতো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশের মানুষ চায় আওয়ামী লীগকে চিরতরে উৎখাত করা হোক। আওয়ামী লীগকে এখনই নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে।
বাংলাদেশে আসার আগে আমি ওয়াশিংটন ডিসির স্টেট ডিপার্টমেন্টে যোগাযোগ করি। সেখানে আমি বাংলাদেশের ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার, তার দল এবং শাসনামল সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করি। স্টেট ডিপার্টমেন্টের ফরেন অ্যাফেয়ার্স অফিসারের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ করি। স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে বেশ কয়েকবার পরিদর্শন করেছে এবং নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
আমি আমাদের সাবেক স্টেট সেক্রেটারি অ্যান্থনি ব্লিংকেনের কাছে একটি চিঠি লিখি। চিঠিটি সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস এবং স্টেট ডিপার্টমেন্টের অন্যান্য কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো হয়। চিঠিতে আমি বিএনপির শীর্ষ নেতাদের এবং সেনা কর্মকর্তাদের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দিয়েছি।
এছাড়া, আমি তালিকাভুক্ত করি:
১. সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে দ্রুত মুক্তি দিয়ে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো উচিত।
২. তারেক জিয়া (বিএনপির অন্তর্বর্তী চেয়ারম্যান) এবং তার স্ত্রী জুবাইদা রহমানের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা হোক এবং তাদের বাংলাদেশে ফিরে আসার সুযোগ দেওয়া হোক, যাতে তারা দলের কার্যক্রম পুনরায় চালিয়ে যেতে পারেন।
৩. ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) আমান আজমি আট বছর ধরে আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে নিখোঁজ ছিলেন। অবশ্য তিনি এখন মুক্ত। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে তিনি মুক্তি পান।
৪. আমরা স্টেট ডিপার্টমেন্টের কাছে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের অবসান ঘটানোর জন্য সাহায্য চাই। হাসিনা সরকারের শাসন হিটলারের চেয়েও অনেক বেশি নির্যাতনমূলক।
৫. আমি স্টেট ডিপার্টমেন্টের ফরেন অ্যাফেয়ার্স অফিসার মিস কালার সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ করি। ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের শাসনামল এবং বাংলাদেশের ‘সন্ত্রাসী দেশগুলির তালিকা’ থেকে উত্তোলনের বিষয়ে আলোচনা করি, যা ২০২২ সালের ২৩ ডিসেম্বর ঘটে।
উল্লেখযোগ্য, ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার তার ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝানোর মাধ্যমে বাংলাদেশকে ‘জঙ্গিবাদ’ এবং ‘সন্ত্রাসী’ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। বাংলাদেশে মুসলিম জনগণের শতকরা ৯৬ ভাগ রয়েছে, যারা সাধারণত পাঞ্জাবী, পায়জামা, টুপি পরিধান করেন এবং নামাজিদের অনেকেই দাড়ি রাখেন। ফ্যাসিস্ট হাসিনা এসব বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগিয়ে দেশের পরিস্থিতি সংকটময় করে তোলেন।
বাংলাদেশের জনগণ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রকে অনেক শ্রদ্ধা করে এবং আমরা নিজেরাই হাসিনাকে কঠোর শাসনের মধ্যে এনেছি। আমি এবং ড. সারওয়ার্দী ২০২২ সাল থেকে মাতৃভূমি বাংলাদেশকে রক্ষা এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে একযোগে কাজ করে আসছি। ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবরের সমাবেশের জন্য আমাদের পরিকল্পনা ছিল খুবই শক্তিশালী, তবে বিএনপি থেকে পর্যাপ্ত সমর্থন না পাওয়ায় তা বাস্তবায়ন করতে পারিনি।
যদি সেদিন বিএনপির সমর্থন পেতাম, তাহলে হাসিনাকে সরিয়ে একটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে পারতাম। আমরা প্রথম যারা মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করেছি, তাদের একত্রিত করেছি এবং একটি কার্যকর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি, যাতে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পদত্যাগ নিশ্চিত করা যায়।
যখন আমি এবং ড. সারওয়ার্দী কারাগারে ছিলাম, তখন ২০২৪ সালে বাংলাদেশ কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়। জুন ও জুলাই মাসে এই আন্দোলন সরকারবিরোধী এবং গণতন্ত্রপন্থী প্রতিবাদের মঞ্চে পরিণত হয়।
২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশে একটি ভয়াবহ গণহত্যা ঘটে, যা ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্রদের প্রতিবাদের সময় সংঘটিত হয়। এই সময়ে ১৪২৫+ নিহত হয়, ২২,০০০ মানুষ আহত, যার মধ্যে অনেক শিশু রয়েছে। ১২,০০০ মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ফ্যাসিস্ট সরকার হাসিনা ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে ভারত পালিয়ে যান। হাসিনা সরকারের পতনের পর মোহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়।
বাংলাদেশে পরিবর্তন আনার জন্য অনেক জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। ২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্ট মাসের বিপ্লব ছাত্রদের এবং যুবকদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এনবিআর, আমলারা এবং পুলিশ কর্মকর্তারা বিপ্লবের গতির সঙ্গে সহযোগিতা করছেন না। বিপ্লবের জন্য ১০০ মাইল গতির প্রয়োজন, কিন্তু কর্মকর্তারা ৫ মাইল প্রতি ঘণ্টায় হাঁটছেন।

লেখক: ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল কমিটির সদস্য, ওয়াশিংটন ডিসি, যুক্তরাষ্ট্র

Related Articles

Back to top button