টাইমস ২৪ ডটনেট, ঢাকা: বাংলাদেশে চট্টগ্রামের দোহাজারী-কক্সবাজার রেল প্রকল্পের উদ্বোধনের মাধ্যমে অর্থনীতির নতুন দ্বার খুললো কক্সবাজার। শনিবার কক্সবাজারের সঙ্গে রেলওয়ে নেটওয়ার্ক সংযুক্ত হয়েছে। এতে করে উন্মোচিত হয়েছে বহুমাত্রিক সম্ভাবনার দ্বার। যোগাযোগ, শিল্পায়ন, পর্যটন, বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের রেলগাড়ি ছুটবে এ পথ ধরে। সব মিলিয়ে ১৮ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পটি এই অঞ্চলের সার্বিক অর্থনীতিতে আনবে নতুন প্রাণ। কক্সবাজার হয়ে উঠবে দেশের অর্থনীতির নতুন দুয়ার।
জানা গেছে, বাংলাদেশের চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার সড়কপথে বাসে গেলে সময় লাগে ৫ ঘণ্টার মতো। চট্টগ্রামের দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথে সে সময় অর্ধেকে নেমে আসবে। সেই সঙ্গে পর্যটনসহ নানা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডেও গতি আসবে বলে মনে করেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। এ রেলপথ আবার মিয়ানমারের কাছে গুনদুম পর্যন্ত যাবে, যা ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের সংযোগ হিসেবে কাজ করবে। এর মধ্যে দিয়ে তুরস্ক ও সিঙ্গাপুর থেকে যে ট্রান্স-এশিয়ান যোগাযোগ ব্যবস্থার সূচনা, তার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে আশিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গেও কানেক্টিভিটির মাধ্যমে তৈরি হবে বড় সুযোগ। আবার লজিস্টিক হাব হিসেবে দক্ষিণ চট্টগ্রামকে রূপান্তরের মূল পরিকল্পনা হচ্ছে মাতারবাড়ীতে প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্র বন্দরকেন্দ্রিক উন্নয়ন। এমন পরিকল্পনার জন্য একটি টেকসই সড়ক অবকাঠামোর পাশাপাশি রেলওয়ে সংযোগকেও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখছেন উদ্যোক্তারা।
বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন ভবিষ্যতে যুক্ত করা হবে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে। আর এটি চালু হলে বাণিজ্যিকভাবে হবে আঞ্চলিক হাব বন্দর। এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের পর প্যারালাল অর্থনীতির লাইফলাইনও হবে। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর বিভিন্ন বন্দরের ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর হিসেবেও মাতারবাড়ীকে ব্যবহার করা যাবে। নির্মাণাধীন গভীর সমুদ্রবন্দরটিকে ঘিরে এরই মধ্যে শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলার প্রস্তাব আসছে বিভিন্ন দেশ থেকে। যেমন নেপাল, ভুটান ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় রফতানির জন্য জাপান তাদের পণ্য উৎপাদনে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এ কারণে গভীর সমুদ্র্রবন্দর ছাড়াও পণ্য সরবরাহে সেখানকার সার্বিক পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন চায় দেশটি।
বাংলাদেশে কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর থেকে ঢাকার আইসিডিতে পণ্য পরিবহনের সুবিধা নিশ্চিত করতেই চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইনের চকরিয়া অংশ থেকে ২৬ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন মাতারবাড়ীতে পণ্য পরিবহনে রেললাইন যুক্ত হলে পাল্টে যাবে দেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের চিত্রও। রাজস্ব আদায় বাড়বে তখন বহুগুণ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ রেলওয়ে নেটওয়ার্কের ৪৮তম জেলা হিসেবে যুক্ত হয়েছে কক্সবাজার। অর্থনীতিতে গতিসঞ্চার ও জনগণের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে এই রেল যোগাযোগ, বলছেন স্থানীয়রা। সেই সাথে বাড়বে কর্মসংস্থানও। আর এজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
কক্সবাজারে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সব অনুষঙ্গ বিদ্যমান। আছে পর্যটন থেকে শুরু করে মহেশখালীর মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র ও এলএনজি টার্মিনালের মতো বিনিয়োগ আকর্ষণযোগ্য বড় বড় প্রকল্প। এসব প্রকল্পের ছায়াসঙ্গী হিসেবে যোগ হয়েছে দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথটি। ফলে পর্যটনের পাশাপাশি লবণ, কৃষি, আবাসন ও চিংড়ি শিল্পে নতুন বিনিয়োগ সম্ভাবনা তৈরি হলো। ঘুরে যাবে এই অঞ্চলের অর্থনীতির চাকা। ত্বরান্বিত হবে ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি। ১০০ কিলোমিটারের এই রেলপথের ছোঁয়ায় সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়া, পটিয়া, চন্দনাইশ, বাঁশখালী, আনোয়ারাসহ আশপাশের অর্থনীতির চিত্র পাল্টে যাবে। কারণ এ প্রকল্পের আওতায় নির্মিত কক্সবাজার আইকনিক রেলস্টেশনসহ মোট ৯টি স্টেশনের মাধ্যমে রেলপথে সংযুক্ত হবে এলাকাগুলো।
গতকাল শনিবার সকাল থেকে কক্সবাজারের ঝিলংজা চান্দের পাড়ার দিকে ছুটতে থাকেন হাজারো মানুষ। আমন্ত্রিত অতিথি ছাড়াও পুরো এলাকা ভরে যায় মানুষে মানুষে। চলতি বছরে কক্সবাজারে এটি প্রধানমন্ত্রীর দ্বিতীয় সফর। এবার এসেছেন জেলাবাসীর দীর্ঘ সময়ের প্রতীক্ষার অবসান ঘটাতে। ট্রেনে সৈকতের শহর কক্সবাজারে যাওয়ার পথ তৈরি করে দেয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কৃতজ্ঞতা জানান সবাই।
ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা বলছে, কক্সবাজারের লবণ, পান, সুপারি, মাছসহ নানা উৎপাদিত পণ্য ট্রেনে করে দেশের নানা জায়গায় পৌঁছাবে এবার। এতে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবেন তারা। এর মাধ্যমে কক্সবাজারে বহুমাত্রিক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হলে বলেও মনে করছেন তারা। পর্যটন শিল্পের সাথে জড়িতরা বললেন, পুরো দেশের সাথে কক্সবাজারের সংযুক্তিটা সহজ হলো রেলপথ হওয়ায়। ফলে পুরো দেশের পর্যটকরা কক্সবাজারে ভ্রমণে আসবেন সহজে ও কম খরচে। আগামী পহেলা ডিসেম্বর থেকে কক্সবাজার থেকে দোহাজারী পর্যন্ত ট্রেন বাণিজ্যিকভাবে চলাচল শুরু করবে।
সূত্র জানায়, ২০১০ সালের ৬ জুলাই একনেকে অনুমোদন পায় দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প। ২০১৮ সালে নির্মাণকাজ শুরু হয়। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২২ সালের ৩০ জুন। পরে এক দফা বাড়িয়ে প্রকল্পের মেয়াদ করা হয় ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। এতে ব্যয় বেড়ে হয় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। প্রকল্পে ঋণসহায়তা দেয় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। ২০১৬ সালের ২৭ এপ্রিল প্রকল্পটি ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। রেলপথটি নির্মিত হওয়ায় মিয়ানমার, চীনসহ ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের করিডোরে যুক্ত হবে বাংলাদেশ। কক্সবাজার পরিণত হবে ব্যবসা-বাণিজ্য ও পর্যটনের তীর্থ স্থান। কক্সবাজারে যেতে এখনো পর্যটকদের প্রধান ভরসা সড়কপথ। আকাশপথে আসা পর্যটকের সংখ্যা সীমিত। পর্যটন অর্থনীতি চাঙা থাকে মূলত শুষ্ক মৌসুমে। রেল যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ার ফলে সারা বছর পর্যটক পাওয়ার আশা করছেন হোটেল-মোটেলের উদ্যোক্তারা। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে প্রকৃত অর্থেই সারা বছর চাঙা থাকবে পর্যটন অর্থনীতি। রেলব্যবস্থা পুরোদমে চালু হলে প্রতিবছর প্রায় ১ কোটি পর্যটক কক্সবাজারে ভিড় জমাবে। সেসব পর্যটকের মধ্যে স্থানীয় থাকবেন ১৭ শতাংশ। এই অগ্রগতির ঢেউ এসে পড়বে চট্টগ্রামসহ সারা দেশের সার্বিক অর্থনীতির গতিধারায়। কারণ এই রেলপথ চট্টগ্রাম-ঢাকা রেলপথের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে। স্থানীয়দের মধ্যেও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে জানালেন কক্সবাজার সদরের রুমালিয়ার ছড়া এলাকার বাসিন্দা চট্টগ্রাম ওয়াসার কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ও রেলওয়ের মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী দোহাজারী-কক্সবাজার রেল প্রকল্পের মাধ্যমে রেলপথে ১৫ শতাংশ পণ্য পরিবহন বাড়ানো যাবে। লবণ, শুঁটকি, সামুদ্রিক মাছ, সুপারি ও পানের বড় আধার হচ্ছে কক্সবাজার। ট্রাকে করে এসব পণ্য পরিবহনে খরচ যেমন বাড়ে সময়ও বেশি লাগে। এতে অনেক ক্ষেত্রে পণ্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। রেলে পরিবহনে খরচ ও সময় দুটোই সাশ্রয় হবে।
দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের পরিচালক মো. সুবক্তগীন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত করার মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর বিষয়কে সামনে রেখে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে।
এই রেলপথ চালুর ফলে কক্সবাজারের উৎপাদিত পণ্য যেমন সহজে সারা দেশে নেওয়া যাবে, তেমনি সারা দেশ থেকে পণ্য কক্সবাজারে সাশ্রয়ীভাবে আনা যাবে। এতে উৎপাদকদের পাশাপাশি ক্রেতারাও হবেন লাভবান। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, রেল চালুর কারণে পচনশীল পণ্য পরিবহনে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পণ্য পরিবহনব্যবস্থা চালু করা যাবে। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর থেকে সহজে এবং কম খরচে কনটেইনার আনা-নেওয়া করা যাবে। সহজে ও কম খরচে মাছ, লবণ, সুপারি, শুঁটকি, পান ও রাবারের কাঁচামাল এবং বিভিন্ন বনজ ও কৃষিজ পণ্য পরিবহন করা সম্ভব হবে এ রেলপথে। কক্সবাজারের টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যেও গতি আনতে পারে পথটি। ফলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আসবে কক্সবাজারে। গতি পাবে অর্থনীতি। নানা ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে।
এই অঞ্চলের বেকারত্ব সামাল দেওয়া যাবে বলে মনে করেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক মু. সিকান্দার খান। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি চট্টগ্রাম চেপ্টারের সাবেক এই সভাপতি বলেন, রেলপথে সংযুক্ত হওয়ার ফলে এই অঞ্চলে উৎপাদনশীলতা উৎসাহিত হবে। এখানে উৎপাদিত পণ্য সারা দেশে ছড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। রাস্তাঘাটের সুবিধা তো সরকার নেবে না, নেবে দেশের জনগণ। এই ধরনের প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রাম-শহর উন্নয়নে একাকার হবে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এন এম মইনুল ইসলাম বলেন, দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথের মতো বড় প্রকল্পগুলোর দীর্ঘমেয়াদি ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। এ প্রভাব বহুমাত্রিক ও সুদূরপ্রসারী। রেলপথে যোগাযোগ নিশ্চিত করার ফলে এই অঞ্চলের সার্বিক অর্থনীতিতে পরিবর্তন আসবে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হবে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।