জাতীয়

ড. ইউনূসের কূটনৈতিক চমক বিশ্বমঞ্চে গৌরবের আসনে বাংলাদেশ

টাইমস ২৪ ডটনেট: জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে গত ২৪ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে আসেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এসেই দীর্ঘদিনের ব্যক্তিগত পরিচিতি ও কূটনৈতিক চমকে পুরো বিশ্ববাসীর সামনে নতুন এক বাংলাদেশকে পরিচয় করিয়ে দেন তিনি। মাত্র চারদিনের সংক্ষিপ্ত সফরে বিভিন্ন রাষ্ট্র, সরকার ও সংস্থার প্রধানদের সঙ্গে ৪০টির বেশি বৈঠক করেছেন ড. ইউনূস। তার নেওয়া সংস্কার উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সংস্থার প্রধানরা দিয়েছেন আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি।
এছাড়া সব প্রটোকল ভেঙে বাইডেন-ইউনূস ‘ওয়ান টু ওয়ান’ বৈঠক নজর কেড়েছে বিশ্ব নেতাদের। শুধু তাই নয়, বৈঠকে তাদের হাস্যোজ্জ্বল আলিঙ্গনের ছবি বিশ্বকে নতুন বার্তা দিয়েছে। এছাড়া দীর্ঘদিনের বন্ধু মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের অনুষ্ঠানেও যোগ দিয়েছেন ড. ইউনূস। সংবর্ধনায় তাকে পেয়ে প্রবাসীরাও ছিলেন উচ্ছ্বসিত। দূতাবাস ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের তথ্যমতে, চার দিনের এ সফরে ড. ইউনূস বৈঠক করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন, জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ, নেদারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী রুটে শুফ, নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি, মালদ্বীপের প্রধানমন্ত্রী, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্টসহ আরও কয়েকজন সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে। এছাড়া চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ নেতৃত্ববৃন্দ, বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফ ব্যবস্থাপনা পরিচালক, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রধান প্রসিকিউটর করিম এ এ খান, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ ৯টি মানবাধিকার সংগঠনের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন তিনি। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভের মঞ্চে বক্তব্য দিয়েছেন ড. ইউনূস। সেখানে তার বন্ধু বিল ক্লিনটনের দেওয়া সংবর্ধনা নেন তিনি। এমন আরও শতাধিক সংগঠন ও সংস্থা ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ চাইলেও সময় স্বল্পতার কারণে তিনি থাকতে পারেননি। ৮৪ বছর বয়সে অনেকটা তরুণের মতো সময় পার করেছেন ড. ইউনূস। যেখানে গেছেন সবাই আগ বাড়িয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এতে এবারের অধিবেশন ছিল অনেকটা ইউনূসময়।
আগে জাতিসংঘের বিভিন্ন ফোরামে ভাষণ দেওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংস্থার দায়িত্ব পালন করেছেন ড. ইউনূস। তবে এবার আটলান্টিকের ওপারে তার সফরটা ছিল বিশেষ। এবার কোনো অতিথি বক্তা হিসেবে নয়, এসেছেন বাংলাদেশের সরকারপ্রধান হিসেবে। বিশ্বমঞ্চে নতুন এক বাংলাদেশকে তুলে ধরেন তিনি। মূল অধিবেশনের পাশাপাশি প্রায় ৪০টি সাইট ইভেন্টে যোগ দেন ড. ইউনূস। সুশাসন নিশ্চিতে তার সরকারের সংস্কার উদ্যোগ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে নেওয়া পদক্ষেপ বিশ্বনেতাদের সামনে তুলে ধরেন। এরমধ্যে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও সংস্থার প্রতিনিধিরা জাতিসংঘের সাইড লাইনে এসে সাক্ষাৎ করেন। এরমধ্যে কানাডার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকটি পূর্ব নির্ধারিত ছিল না। বৈঠকটি হয়েছে জাস্টিন ট্রুডোর আগ্রহে। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত অভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন বাংলাদেশের দায়িত্ব গ্রহণ করে জাতিসংঘের ৭৯তম আসরে যোগ দেন ড. ইউনূস। এবারের অধিবেশন ছিল ইউনূসময়। তার বিরল নেতৃত্বে গৌরবের আসনে ছিল বাংলাদেশ। ৫৪ বছরের ইতিহাসে যা ঘটেনি এবার এমন সব ঘটনাই ঘটছে। সব প্রটোকল ভেঙে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আসেন ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। যা শুধু বাংলাদেশের জন্য গৌরবের নয়, ঐতিহাসিক কূটনৈতিক বিজয়ও বটে।
জাতিসংঘে ড. ইউনূস বিশ্ব রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন। জাতিসংঘ ও নিউ ইয়র্কে একাধিক অনুষ্ঠানেও অংশ নেন তিনি। সবখানেই তার সঙ্গে ছবি তোলার হিড়িক পড়ে। অনেককেই লাইন ধরে তার সঙ্গে ছবি তুলতে দেখা যায়। যার মধ্যে অন্যতম ছিলেন বাংলাদেশের বহুল আলোচিত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। ড. ইউনূসকে কাছে পেয়ে আলিঙ্গন করেন তিনি। সেইসঙ্গে আপ্লুত পিটার হাস্ হাসিমুখে ছবিও তোলেন।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাত হয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের। এবারের সম্মেলনে বাংলাদেশের জন্য ছিল বিরল কর্তৃত্ব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কোনো দেশের শীর্ষ নেতার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের তেমন নজির নেই। এবার সব প্রটোকল ভেঙে বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। শুধু তাই নয়, বৈঠকের ফাঁকে আলিঙ্গনে হাস্যোজ্জল মুখে যে ছবি তুলেছেন তা স্পষ্ট বলে দেয় আগামী দিনে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কেমন হচ্ছে। বাংলাদেশে সোলার প্যানেল প্রকল্পে বিনিয়োগকে গুরুত্ব-সহকারে দেখছে চীন। একই সঙ্গে অন্তর্বতী সরকারের সঙ্গে গভীরভাবে কাজ করতে চায় দেশটি।
গত বুধবার স্থানীয় সময় বিকেলে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সাইডলাইনে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসেরসঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকালে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, চীন-বাংলাদেশে সোলার প্যানেলে বিনিয়োগ এবং ঢাকার সঙ্গে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও গভীর করতে চায়।
অন্তর্বতীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুসকে স্বাগত জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিভা। একইসঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংস্কার ও অন্যান্য খাতে আইএমএফ আরও ঋণ দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। সে জন্য বাংলাদেশে একটি টিম পাঠিয়েছে সংস্থাটি। টিমের প্রতিবেদন পাওয়ার পর পরবর্তী ঋণ কর্মসূচি আরও বাড়ানোর ঘোষণা আসতে পারে বলে জানিয়েছে এ সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। জাতিসংঘ সদর দপ্তরে সাধারণ পরিষদের বার্ষিক অধিবেশনের সাইডলাইনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসেরসঙ্গে বৈঠকে আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তার সমর্থন ব্যক্ত করেন। বাংলাদেশের অন্তর্র্বতী সরকারের নেওয়া নানা সংস্কারের পাশে থাকবে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি জানিয়েছে, অর্থনৈতিক সংস্কার, ডিজিটালাইজেশন, তারল্য, জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ ও পরিবহন খাতে সংস্কারের জন্য ৩.৫ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেওয়া হবে।
বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বঙ্গ বুধবার নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় দুপুরে ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশকে অর্থ সহায়তা দেবেন বলে জানান। বৈঠকে ড. ইউনূস তার নেওয়া সংস্কার কাজের জন্য বিশ্বব্যাংকের আরও সহায়তা চান। এবারের বৈঠকের সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সেক্রেটারি শফিকুল আলম বলেন, শুধু বাংলাদেশের মানুষ নয়, পুরো বিশ্ববাসী নতুন এক বাংলাদেশ দেখেছে। পুরো অধিবেশনজুড়ে ড. ইউনূস বন্দনা ছিল। এটা সম্ভব হয়েছে বিশ্বব্যাপী তার খ্যাতি ও সুনামের কারণে। তার ব্যক্তিগত সুনামগুলো এখন দেশের কাজে লাগাচ্ছেন তিনি। এটা নিঃসন্দেহে দেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে। শফিকুল আলম জানান, চারদিনে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, পাকিস্তানসহ কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও ৪০টির বেশি ইভেন্টে অংশগ্রহণ করেন তিনি। সকাল ৮টায় শুরু হতো তার বৈঠক। এরপরও প্রায় শতাধিক বৈঠকের আবদার রক্ষা করতে পারেনি।
তিনি বলেন, এবারের সবচেয়ে আকর্ষণ ছিল ইউনূস-বাইডেন বৈঠকটি। যা ছিল ঐতিহাসিক। কারণ, জাতিসংঘের অধিবেশনের ফাঁকে বাংলাদেশের কোনো শীর্ষনেতার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কোনো বৈঠক হয়নি। বৈঠকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট যেভাবে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে অলিঙ্গন করেছেন তা বিরল। বাইডেন নিজ থেকে বাংলাদেশে কী কী সমর্থন ও সহযোগিতা দেওয়া প্রয়োজন সে সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। একইসঙ্গে তিনি তার সরকারের পূর্ণ সমর্থন বাংলাদেশ পাবে বলেও জানান। দুদেশের রাষ্ট্রপ্রধানের বিরল ওই বৈঠকের পর বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে গেছে।

 

Related Articles

Back to top button