topজাতীয়

অশ্রুসিক্ত চিরবিদায় শহীদ ওসমান হাদি

টাইমস ২৪ ডটনেট, ঢাকা: সহকর্মীসহ লাখো মানুষের ভালোবাসা ও অশ্রুসিক্ত চির বিদায় নিলেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সম্মুখভাগের যোদ্ধা এবং ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শহীদ শরিফ ওসমান হাদি। শনিবার দুপুর আড়াইটায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় লাখো জনতার অংশগ্রহণে তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। তার বড় ভাই আবু বকর সিদ্দিক নামাজে ইমামতি করেন। জানাজায় প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ স্থানীয় নেতারা অংশগ্রহণ করেন। পরে গতকাল শনিবার বিকেল সোয়া ৩টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ সংলগ্ন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধিসৌধের পাশেই তাকে শায়িত করা হয়েছে।
জানা গেছে, শনিবার বিকেল সোয়া ৩টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিদ্রোহী ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধির পাশে জুলাই বিপ্লবী ও আধিপত্যবাদবিরোধী ‘ইনকিলাব মঞ্চ’র মুখপাত্র শরিফ ওসমান বিন হাদিকে সমাহিত করা হয়। দাফন শেষে হাদির বিদেহী আত্মার মাগফিরাত ও শান্তি কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়। কবরস্থানের আশপাশে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, সোয়াটসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য মোতায়েন রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এবং শাহবাগ মোড় থেকে সমাধিসৌধে প্রবেশের সড়ক জনসাধারণের প্রবেশ সীমিত করা হয়েছে। এসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান, সহ-উপাচার্য অধ্যাপক মামুন আহমেদ, দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন, এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ, ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম, এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, ডাকসুর ভিপি সাদিক কায়েমসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। ওসমান হাদির দাফনকে কেন্দ্র করে নজরুল ইসলাম সমাধি কমপ্লেক্সের আশপাশ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা কড়া নিরাপত্তার চাদরে আবৃত করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনে এবং কাজী নজরুল ইসলামের সমাধির মূল ফটকের সামনে ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছে। নিরাপত্তার অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয় মসজিদের ফটকগুলোও বন্ধ করে রাখা হয়।
এর আগে শনিবার দুপুর আড়াইটায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় ওসমান হাদির জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা পড়ান তার বড় ভাই আবু বকর সিদ্দিক। জানাজায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস, জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান, সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া মো. গোলাম পরওয়ার, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ, এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও উপস্থিত ছিলেন। জানাজাপূর্ব বক্তব্য রাখেন ইনকিলাব মঞ্চের সদস্য সচিব জাবের ও ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন।
জানায় অংশ নিয়ে প্রধান উদেষ্টা বলেন, প্রিয় ওসমান হাদি তোমার কাছে ওয়াদা করতে আসছি, তুমি যা বলে গেছো, সেটা যেন পূরণ করতে পারি। শুধু আমরা নয়, বংশানুক্রমে দেশের সব মানুষ পূরণ করবে। তোমার মানবপ্রেম, ভঙ্গি মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সবাই গ্রহণ করেছে। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, লাখো লাখো মানুষ শনিবার এখানে উপস্থিত হয়েছে। পথে ঢেউয়ের মতো মানুষের স্রোত নেমেছে। বাংলাদেশজুড়ে কোটি কোটি মানুষ এ মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছে। বিদেশিরাও হাদির কথা জানতে চায়।
জানাজার আগে সংসদ ভবন প্লাজার সামনের মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। অনেকেই সংসদ ভবনের মাঠে প্রবেশ করতে না পেরে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাদির জানাজায় অংশ নেন। চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সম্মুখসারির যোদ্ধা ওসমান হাদি পরে ‘ইনকিলাব মঞ্চ’ গড়ে তুলে ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে আলোচনায় আসেন। বিভিন্ন টেলিভিশনের টক শোতেও নিয়মিত আমন্ত্রণ পেতে থাকেন তিনি। তার যুক্তিতর্কের অনেক ক্লিপ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। তিনি আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন।
গুলিবিদ্ধ হওয়ার মাসখানেক আগে হত্যার হুমকি পাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন ওসমান হাদি। তিনি গত নভেম্বরে নিজের ফেসবুক পেজে বলেছিলেন, দেশি-বিদেশি অন্তত ৩০টি নম্বর থেকে তাকে ফোনকল করে এবং মেসেজ পাঠিয়ে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। ওই পোস্টে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের ‘খুনি’ ক্যাডাররা তাকে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখছে। তবে প্রাণনাশের আশঙ্কা সত্ত্বেও ইনসাফের লড়াই থেকে পিছিয়ে যাবেন না তিনি।
১২ ডিসেম্বর জুমার নামাজের পর রাজধানীর বিজয়নগরের বক্স কালভার্ট রোড এলাকায় প্রচারে যাওয়া ওসমান হাদিকে গুলি করে মোটরসাইকেলে আসা দুই সন্ত্রাসী। রিকশায় থাকা হাদি মাথায় গুলিবিদ্ধ হন। তাকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এরপর তাকে নেওয়া হয় এভারকেয়ার হাসপাতালে। অবস্থা গুরুতর দেখে সেখান থেকে হাদিকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যায় সরকার। চিকিৎসকদের সর্বাত্মক চেষ্টার পরও মৃত্যুর সঙ্গে লড়াইয়ে হেরে যান হাদি। গত বৃহস্পতিবার রাতে তার মৃত্যুর খবর জানান চিকিৎসকরা। ওসমান হাদি হত্যাকাণ্ডে জড়িত মূল সন্দেহভাজন নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ফয়সল করিম মাসুদ ও তার সহযোগী আলমগীর শেখ। তারা ভারতে পালিয়ে গেছেন বলে জানিয়েছে বিভিন্ন সূত্র। মৃত্যুর পর ১৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ওসমান হাদির লাশ বাংলাদেশে আনা হয়। সেখান থেকে লাশ জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের হিমঘরে নেওয়া হয়। হাদির মৃতুতে গতকাল শনিবার রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক পালন করা হচ্ছে। দেশের সব সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব সরকারি ও বেসরকারি ভবন এবং বিদেশে বাংলাদেশ মিশনে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রয়েছে।
জানাজার আগে শরিফ ওসমান হাদির বড় ভাই ও জানাজার ইমাম ড. মাওলানা আবু বকর ছিদ্দিক ভাই হত্যার বিচার চান। মাওলানা আবু বকর ছিদ্দিক বলেন, ৭-৮ দিন হয়ে গেলো, খুনি দিবালোকের মধ্যে গুলি করে যদি পার পেয়ে যায় এর চেয়ে লজ্জার কিছু নেই। যদি বর্ডার ক্রস হয়ে যায়, ৫ থেকে ৭ ঘণ্টার মধ্যে তারা কেমন করে গেলো? এই প্রশ্ন জাতির কাছে রেখে গেলাম। আমার কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। আমার ভাই শহীদ হয়েছে, তার শহীদি তামান্না ছিল। হয়তো আল্লাহ তার শহীদি মৃত্যু নসিব করেছেন। কিন্তু আপনাদের কাছে আমি এই ঋণ কখনো ছাড়বো না, আমার ভাই শরিফ ওসমান হাদির বিচার যেন প্রকাশ্যে এই বাংলার জমিনে দেখতে পারি। ৭-৮ দিন হয়ে গেলো, এখন পর্যন্ত আমরা কিচ্ছু করতে পারলাম না। এই দুঃখে কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে। যোগ করেন মাওলানা আবু বকর ছিদ্দিক।
ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেন, তারা ওসমান হাদিকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল; আর তিনি হয়ে উঠলেন আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সবচেয়ে বড় প্রতীকে। তিনি বলেন, দোয়া করি আল্লাহ যেন তাকে শাহাদতের মর্যাদা দান করেন এবং তার জীবনের ত্রুটি-বিচ্যুতি আল্লাহ তায়ালা মার্জনা করেন। আল্লাহ তার কবরকে জান্নাতুল ফেরদৌসের টুকরা বানিয়ে দেন। তিনি যে স্বপ্ন দেখেছিলেন—আধিপত্যবিরোধী একটি ইনসাফভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্নতার সেই স্বপ্ন পূর্ণতা দেওয়ার জন্য দেশবাসীকে তৌফিক দান করুন।

 

 

 

Related Articles

Back to top button