মতামত

বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ সংক্রান্ত কিছু কথা

সৈয়দা রাশিদা বারী: ১৯৯৩ সালে আমার লেখা একক ছোট গল্প গ্রন্থ, ‘চাঁদ ভাঙন ও বেদনা’ প্রথম প্রকাশ হয়। অজ পাড়া গ্রামের গ্রাম্য তরুণী লেখিকা হিসেবে, ১৯৯৩ সালেই বেগম পত্রিকার প্রচ্ছদে, আমার ছবি ছাপা হয়। ওই বছরই বেগম পত্রিকার সম্পাদিকা ‘নুরজাহান বেগম’ আপা আমাকে কুষ্টিয়াতে বাংলাদেশ লেখিকা সংঘর শাখা প্রতিষ্ঠা করতে নির্দেশ দিলেন। কিন্তু সবকিছু ঠিকঠাক করে, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ’র কুষ্টিয়া জেলা শাখা প্রতিষ্ঠা করলাম আমি, ১৯৯৫ সালে। তবে অনেক বাধা বিঘ্ন ডিঙিয়ে কাগজপত্র পাকা করেছি আরো পরে। তাই বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ, কুষ্টিয়া জেলা শাখায়, সাধারণ সম্পাদিকা হিসেবে আমার পরিচালনায় চালাবার কাগজ পত্রের মেয়াদ ৪ অক্টোবর ১৯৯৬ থেকে ২০০০ ইং সাল। আর আমি যখন বেগম পত্রিকার সম্পাদক বেগম নূরজাহান আপার পরামর্শ মতো বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ কুষ্টিয়া জেলা শাখা খুলেছিলাম। তখন ছিলেন এই সংগঠনের প্রাণপুরুষ অধ্যাপক ড. খালেদা সালাহ উদ্দিন ও অধ্যাপক নয়ন রহমান। অর্থাৎ তিনারায় ছিলেন এই সংগঠনের প্রধান। শাখা খোলার আগে এবং পরেও বাংলাদেশ লেখিকা সংঘের এই দুই শ্রদ্ধাভাজন আপার নিকট আমি হয়েছিলাম স্নেহ অনন্য ও স্নেহ ধন্য। তিনারা আমাকে ছোটবোনের মতোই ভালবাসতেন এবং কদর দিতেন। যখন কুষ্টিয়া লেখিকা সংঘর দায়িত্ব ছেড়ে, ঢাকাতে আমি লেখালেখি নিয়ে প্রচন্ড ব্যস্ত ছিলাম। এই দুই মহত ব্যক্তির সঙ্গে আমার ভালবাসা গভীর থেকে আরও গভীরতম হয়। কেননা কুষ্টিয়াতে শাখা প্রতিষ্ঠা করে তুখোর ভাবে চালিয়েছি প্রায় ৫বছর। এবং ঢাকাতেও আজীবন সদস্য ছিলাম। কুষ্টিয়া শাখা ছেড়ে ঢাকাতে এসে তাদের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকলেও কখনও নির্বাহী কমিটিতে দায়িত্ব নিতে চাইনি, সময় দিতে পারব না বলে। তিনারা আমাকে কুষ্টিয়া ফিরে, কুষ্টিয়া জেলা শাখা সংগঠন আবার চাঙ্গা করতে অনুরোধ করেন। কিন্তু সময়ের জন্য আমি তাঁদের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চেয়ে নিই। কেননা তারা জানতেন তাদের কথা ফেলবো, এমন অবাধ্য মেয়ে আমি নই। কাজেই তাঁরা আমার দিকটাও ভাবলেন এবং বেশ খুশিই থাকলেন। আমি ছিলাম নাকি বয়সে অনেক ছোট। তাই দেখা হতে মাত্র, নিজের থেকেই দু’জন বলতেন, রাশিদা তুমি লেখিকা সংঘের পুরস্কার প্রাপ্তা বটে। আমরা তোমাকে প্রথম কাতারেই পুরস্কৃত করার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছি কিন্তু তুমি বয়সে এত বেশী ছোট যে সাহিত্য পুরষ্কার নেওয়ার অনুপোযুক্ত।
বলতেন তুমি তো লেখিকা সংঘ’র কাছে সম্মাননা প্রাপ্তা দুই সাইড দিয়ে। ১. বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ’র কুষ্টিয়া জেলা শাখা খুলে ব্যাপক আলোড়িত করেছ যোগ্য পরিচালনায়। (তখন আলোড়িতই ছিল, যখন আমি চালাতাম এখন আমি না থাকাই তেমন কার্যক্রম নাই।) ২. লেখালেখিতেও অনেক ধাপে এগিয়ে। গ্রাম্য সাধারণ মধ্যবৃত্ত পরিবার-থেকে এবং একজন নারী লেখক রূপে সার্বিক পর্যায়ের মাপকাঠি অনুযায়ী বিবেচনা করলে তুমি বিশেষ ভাবে এখনই পাওনাদার। কিন্তু বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ বয়সেরও সিনিয়রিটি মেইনটেইন এখনো পর্যন্ত করে। আমরা এটা সচল ধরে রেখেছি- তবে আমাদের অবর্তমানে পরবর্তী জেনারেশন কি করবে, সেটা তখনকার ব্যাপার। তাই তোমার বয়স পরিপক্ক না হওয়ায় আমরা অপেক্ষা করছি, তোমাকে সিডিউলে রেখেই। আমাদের সাথে তুমিও অপেক্ষা করো। অপেক্ষায় বরকত থাকে। তিনারা আমার মঙ্গল চাইতেন আমার লেখালেখিতে পরামর্শ দিতেন সাহিত্যের সারথীয় বন্ধু হিসেবে। আমিও বড়বোন মনে করে আমার গবেষণা ও সাহিত্য সাধনায়, কখনো অভিভাবক, কখনো গুরুজন ভেবে, তাদের মান্য ও শ্রদ্ধায় সান্নিধ্য নিতাম। পরে ২০১০ সালে তিনাদের দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর, মনে করলেন বয়সে আমি লেখিকা সংঘর ধারা চিত্রে উপযুক্ত হয়েছি। এবং সেইবার তিনারা আমার লেখিকা সংঘের পক্ষ থেকে সংবর্ধিত করলেন। লিপি মনোয়ার (বর্তমান সেক্রটারী) কে নয়ন আপা অনেক পছন্দ করতেন। আমাকে তাঁর কথা বলতেন। বলতেন তোমার মতো লিপি মনোয়ারও লেখিকা সংঘ’র প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং লেখিকা সংঘের একনিষ্ঠ কর্মী। আমি লক্ষ্য করলাম যে আমাকে সংবর্ধিত করে তিনারা আমার সংবর্ধনা পাওয়ার চেয়েও অনেক বেশী খুশি হলেন নিজের। অর্থাৎ আমার থেকে ডবল গুনে বেশী আনন্দিত উনারা হয়েছিলেন। ঐ সময় হতেই ড. খালেদা সালাহউদ্দিন (জন্ম: ০১.০৩.১৯৩৫- মৃত্যু: ১৫.০১.২০১৪ইং) আপার শরীর ক্রমেই অবনতির দিকে যেতে থাকে। ড. খালেদা সালাহউদ্দিন দীর্ঘ ৪০ বছর যাবত বাংলাদেশ লেখিকা সংঘের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। সকল ভাবে নয়ন আপাকে সহযোগিতা করেছেন সুস্থ থাকার সময় প্রায় ২৫ বছর তিনি এই সংগঠনের সভানেত্রীর দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করেছেন। নিঅর্হংকারী দীপ্ত প্রতিভার অধিকারী খালেদা সালাহউদ্দিন। সংগঠনের প্রতিটি সদস্যের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতেন। এই সংগঠনে তার স্বামীর ভূমিকাও যথেষ্ট ছিলো। আমি ফোন দিলে, তার স্বামী সমস্ত বিষয়ে জেনে, খালেদা আপাকে ডেকে দিতেন। এছাড়াও তিনি ‘বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ’র সবকিছু মনে রেখে, আমাকে ও খালেদা আপাকে মনে করিয়ে দিয়ে, সহযোগিতা করতেন। এই উৎসাহ দাতা উদীয়মান প্রাণ, ড. খালেদা সালাহউদ্দিনের জীবন সঙ্গী, জনাব সালাহউদ্দিন আহমেদ পুলিশ ডিপার্টমেন্টের একজন উচ্চপদস্থ (আই জি পি) কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি ২০১১ সালে ৩০ জুলাই পরলোক গমন করেন। আর ২০১৪ সালের ১৫ জানুয়ারী ড. খালেদা সালাহউদ্দিনের মৃত্যু হয়। নয়ন রহমান (জন্ম: ০৯.০৯.১৯৪০ – মৃত্যু: ২১.১২.২০১৪ইং) আপার শরীরও বেশ খারাপ ছিল। কিন্তু তিনি যে এত তাড়াতাড়ি এমন করে তার অসুস্থ স্বামীর ফেলে আগে চলে যাবেন কল্পনাও করতে কষ্ট হয়। কেননা নয়ন আপাও ছিলেন এক অমীয় দায়িত্বশীল প্রাণ। স্বামীর প্রতি ছিল তার অসম্ভব শ্রদ্ধা। আর তার স্বামীও নয়ন আপার সাংগঠনিক কর্মে এবং সাহিত্য চর্চার প্রতি শ্রদ্ধাশীল দরদী ছিলেন। যখন তিনি সুস্থ ছিলেন, সকল ভাবে নয়ন আপাকে সহযোগিতা করেছেন। জীবনের সিংহভাগ সময় নয়ন রহমান আপা ‘বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ’র পিছনে শ্রম দিয়েছেন। প্রতিটা সদস্য তার ওখানে গেলে, কখনোই চা নাস্তা দিতে ভুল করেন নাই। সময়টা দুপুর হলে, ভাত খাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন। শরীরের এবং পরিবারের খবর নিতেন। সংগঠনের কেন্দ্র ছাড়াও, জেলা শাখার কার্যক্রম উন্নয়ন ও উন্নতির ব্যাপারে পরামর্শ দিতেন। ভাবতেন। স্রষ্টার ডাকে একই সালে সংগঠনের এই দুই অভিভাবকের চির বিদায় অর্থাৎ মৃত্যু হয়!
আজ তাদের (ড. খালেদা সালাহ উদ্দিন-নয়ন রহমান) বিয়োগ বেদনা আমাকে অনেকটায় ব্যথিত করেছে। সেই তো কিংবদন্তি বেগম নূরজাহান (জন্ম: ০৪.০৬.১৯২৫ – মৃত্যু: ২৩.০৫.২০১৬ইং) আপা তখনও ছিলেন। যার নির্দেশক্রমে আমি প্রথম তাদের সঙ্গে দেখা করি! এবং তাদের থেকে মনোনয়নপত্র লাভ করে, কুষ্টিয়াতে বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ’র শাখা খুলি। অস্বাভাবিক পরিশ্রম এবং সমস্ত রাত জেগে সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা অব্যাহত রাখার ফলে, অল্প বয়স থেকেই আমি কঠিন কঠিন রোগে জড়িয়ে যাই। তারপরও ডাক্তারের নির্দেশ ও জীবন চলার বাধা রুটিন, কখনোই না মানার প্রপ্রেক্ষিতে অনেক বেশী অসুস্থ থেকেও, আমি আজও আছি! নেই কেবল অনেক বেশি নিয়ম, শরীরের প্রতি অধিক যত্নবান সতর্কতা অব্যাহত রাখা বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ’র (আমি কুষ্টিয়া সংঘ প্রতিষ্ঠা লগ্ন বা যুগ ধরে বলছি) সেই দুই প্রাণ পুরুষ। তারা অধ্যাপক কবি ও কথাশিল্পী ড. খালেদা সালাহ উদ্দিন এবং অধ্যাপক ও শিশু সাহিত্যিক কথাশিল্পী নয়ন রহমান। যা কিছুতেই মেনে নিতে মন চাইছে না অথচ মেনে নিতেই হচ্ছে। কিন্তু নয়ন রহমান আপা যিনি একজন গার্জিয়ানের মতো প্রায়ই আমার শরীরের খোঁজ খবর নিতেন। আমাকে সাবধান ও সতর্কতায় চলতে উপদেশ দিয়ে বিশেষ চিন্তিত থাকতেন। সেই আমিই আছি এত কঠিন অবস্থানে থেকেও, যা অবিশ্বাস্য, – সৃস্টি জগতের এ এক পাষন্ড রহস্য ?! নাকী স্রষ্ঠার অপার দয়া ও অবিস্মণীয় ক্ষমতা!!
আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘে এই দুই নেত্রীর যে নিঃস্বার্থ ত্যাগ ও অবদান, তা নক্ষত্রের মতই জ্বলজ্বল করবে। তাদের লেখনির সৃষ্টিও চিরদিন বেঁচে থাকবে। জগতের এটায় ধারা এবং নিয়ম, – যে মানুষ থাকে না স্মৃতি রয়, সৃষ্টি রয়। তাই যুগেযুগে কালে কালে ড. খালেদা সালাহ উদ্দিন, নয়ন রহমান, সাহিত্য ইতিহাসে থাকবেন, নিশ্চয় থাকবেন। ইতিতে আমি এই দুই নক্ষত্রের পরিবারের ওপর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি এবং মৃতদ্বয়ের আত্মার শান্তি ও বেহেস্ত নসীব কামনা করছি। কামনা করছি বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ’র উজ্বল ভবিষ্যত। আর প্রাণবন্ত হোক বাংলাদেশে ‘বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ’র সকল জেলা শাখা।।

Related Articles

Back to top button