জাতীয়রাজনীতি

সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলে নিন্দা বাংলাদেশ-ফ্রান্সের

টাইমস ২৪ ডটনেট, ঢাকা: বিশ্বের যেকোনো দেশের সরকার ব্যবস্থায় অসাংবিধানিক পরিবর্তন এবং সামরিক শাসকদের ক্ষমতা দখলের বিষয়ে নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ ও ফ্রান্স। সোমবার (১১ সেপ্টেম্বর) ঢাকায় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্বিপক্ষীয় বৈঠক নিয়ে যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। বিবৃতিতে সামরিক শাসকদের ক্ষমতা দখলের বিষয়টি উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, যে কোনো দেশে অসাংবিধানিকভাবে সরকার পরিবর্তন এবং অবৈধ সামরিক ক্ষমতা দখলের নিন্দা জানায় বাংলাদেশ এবং ফ্রান্স। এছাড়া এসব দ্বন্দ্ব, সহিংসতা এবং নৃসংতার কারণে যেসব মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন তাদের জরুরি এবং নির্বিঘ্নে মানবিক সহায়তা প্রদানের আহ্বান জানায় এ দুই দেশ।
যৌথ বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ এবং ফ্রান্স পর্যবেক্ষণ করেছে- জলবায়ু পরিবর্তন এবং সরবরাহ শৃঙ্খল বিঘ্নিত হওয়ার কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সার্বভৌমত্ব, খাদ্য নিরাপত্তা এবং পুষ্টির উপর বিপর্যয়কর প্রভাব পড়ছে। বাংলাদেশ ও ফ্রান্স নিয়মিত সংলাপের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তার সমর্থনে টেকসই ও স্থিতিস্থাপক খাদ্য ও কৃষি ব্যবস্থায় তাদের সহযোগিতা জোরদার করতে সম্মত হয়েছে। এ বিষয়ে ফ্রান্সের নেতৃত্বে ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার রেজিলিয়েন্স মিশনের (এফএআরএম) উদ্যোগে বাংলাদেশের যোগদানের প্রশংসা করেছে।
বিবৃতিতে ফ্রান্সের উন্নয়ন সহযোগিতা প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের ৮৬ টিরও বেশি পৌরসভার নগর উন্নয়নে সহায়তা করার জন্য বাংলাদেশ সরকার এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের পাশাপাশি ফ্রেঞ্চ এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্টের সঙ্গে ২০০ মিলিয়ন ডলার অর্থায়ন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
বাংলাদেশ এবং ফ্রান্স বন ও জলাভূমি দ্বারা প্রদত্ত গুরুত্বপূর্ণ ইকোসিস্টেম পরিষেবাগুলোর গুরুত্বের উপর জোর দেয়। ২০২৫ সালে ফ্রান্সের নিস শহরে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ফ্রান্স ও কোস্টারিকার যৌথ সভাপতিত্বে জাতিসংঘের মহাসাগর বিষয়ক সম্মেলনের আগে বাংলাদেশ ও ফ্রান্স তাদের যৌথ প্রয়াস বাড়াতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বাংলাদেশ ফ্রান্সকে বঙ্গোপসাগরে সামুদ্রিক সম্পদের ব্যবহারে যৌথ উদ্যোগ অন্বেষণের আমন্ত্রণ জানিয়েছে।উভয় দেশ বাণিজ্য সম্প্রসারণে সম্মত হয়েছে। এ বিষয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, উভয়পক্ষ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং রেলওয়ে সেক্টরসহ বাংলাদেশে মানসম্মত ও স্থিতিস্থাপক অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগের সম্ভাবনা অন্বেষণে তাদের আগ্রহের কথা পুনর্ব্যক্ত করে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং ফরাসি প্রেসিডেন্ট আশা প্রকাশ করেন যে, আগামী ২৩-২৫ অক্টোবর প্যারিস এবং টুলুজে অনুষ্ঠিতব্য বাংলাদেশ-ফ্রান্স বিনিয়োগ শীর্ষ সম্মেলন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন গতি সঞ্চার করবে।
যৌথ বিবৃতিতে উঠে এসেছে ইউক্রেন যুদ্ধ প্রসঙ্গও। এ প্রসঙ্গে বলা হয়, কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন, শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য অংশীদারিত্ব বাংলাদেশ এবং ফ্রান্স আন্তর্জাতিক আইন এবং জাতিসংঘ সনদের প্রতি তাদের অটল প্রতিশ্রুতি, বিশেষ করে সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধানের নীতি এবং বহুপাক্ষিকতাবাদে অবিচল বিশ্বাসকে পুনর্ব্যক্ত করে। সেক্ষেত্রে ফ্রান্স ও বাংলাদেশ সকল জাতির আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি তাদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে।উভয়পক্ষের ভাষ্য, ইউক্রেনের যুদ্ধ আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন, বিশেষ করে জাতিসংঘের সনদের লঙ্ঘন এবং নিয়ম-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার জন্য একটি গুরুতর হুমকি। তারা জাতিসংঘের সনদের নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি ন্যায্য ও দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সকল প্রচেষ্টার প্রতি তাদের সমর্থন প্রকাশ করে। তারা যুদ্ধের বৈশ্বিক পরিণতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে, যা আর্থিক, অর্থনৈতিক এবং খাদ্য ও শক্তি নিরাপত্তার উপর সমস্ত জাতির উপর প্রভাব ফেলে।যৌথ বিবৃতিতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বিশেষ করে আফ্রিকায় বাংলাদেশের অবদানের কথা উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, ফ্রান্স জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা ও শান্তি বিনির্মাণ প্রক্রিয়ায় বিশেষ করে আফ্রিকায় বাংলাদেশের অগ্রণী অবদানের প্রশংসা করে। বাংলাদেশ এবং ফ্রান্স জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের প্রতি তাদের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে এবং মিশনের আদেশ এবং প্রাসঙ্গিক প্রেক্ষাপটে তাদের বাস্তবায়নের বিষয়ে নিয়মিত পরামর্শ করতে তাদের ইচ্ছা প্রকাশ করে।সংঘাত, সহিংসতা এবং নৃশংস অপরাধের কারণে বাস্তুচ্যুতদের জন্য জরুরি এবং নিরবচ্ছিন্ন মানবিক সহায়তার আহ্বান জানানো হয় যৌথ বিবৃতিতে।বিবৃতিতে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, কয়েক বছর ধরে মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ও মানবিক সহায়তা প্রদানে বাংলাদেশের উদারতার প্রশংসা করেছে ফ্রান্স। উভয় দেশই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে, যেন মিয়ানমারের অভ্যন্তরে এমন পরিস্থিতি তৈরির মাধ্যমে স্বেচ্ছায়, নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ এবং টেকসইভাবে তাদের পৈতৃক জন্মভূমিতে দ্রুত প্রত্যাবর্তন করা যায়।
রোহিঙ্গাদের ন্যায়বিচার এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গাম্বিয়া বনাম মিয়ানমার মামলায় অন্যান্য অংশীদারদের সঙ্গে পাশে থাকার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে ফ্রান্স। রোহিঙ্গাদের মানবিক সংকট মোকাবিলায় জাতিসংঘের যৌথ সাড়া দান পরিকল্পনার জন্য পর্যাপ্ত আন্তর্জাতিক সমর্থন জোগাড় করতে ফ্রান্সের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ। এ প্রেক্ষাপটে ফ্রান্স বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবিরে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির কার্যক্রমে অতিরিক্ত এক মিলিয়ন ইউরো অনুদান ঘোষণা করেছে।
ইন্দো-প্যাসিফিক প্রসঙ্গে বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ এবং ফ্রান্স একটি মুক্ত, উন্মুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক, নিরাপদ এবং শান্তিপূর্ণ ইন্দো-প্যাসিফিকে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পুনর্ব্যক্ত করে। তারা ইন্ডিয়ান ওশান রিম অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যদের মধ্যে সহযোগিতাকে আরও গভীর করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। উভয় দেশই এ অঞ্চলে অবৈধ যানবাহন, অবৈধ মাছ ধরা এবং বাণিজ্য ও নৌ চলাচলের স্বাধীনতার পক্ষে মুক্ত রাখতে তাদের অভিন্ন প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে।
প্রসিডিউরস(এসওপি) বাস্তবায়নের অগ্রগতিও নোট করে, যেখানে অনুমতি ছাড়া অবস্থানকারী ব্যক্তিদের শনাক্তকরণ এবং প্রত্যাবর্তন করা হয়। মানবপাচার ও চোরাচালানসহ অনিয়মিত অভিবাসন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহযোগিতা বাড়াতে সম্মত হয়েছে উভয়পক্ষ।
বিবৃতিতে ২০২১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফ্রান্স সফরের সময় দুই সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে সহযোগিতা ও বিনিময়ের অভিপ্রায় পত্র অনুযায়ী প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়াতে তাদের আগ্রহের কথা জানায়।
বিবৃতিতে আরও উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ এবং ফ্রান্স সার্বভৌমত্ব এবং কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনকে একটি স্থিতিশীল, বহু-মেরু বিশ্বের জন্য মূল নীতি হিসাবে বিবেচনা করে। উভয়দেশ কৌশলগত খাতে বর্ধিত সহযোগিতাকে স্বাগত জানায়। এয়ারবাস-১০ ( এ-৩৫০) নেওয়ার বিষয়ে প্রতিশ্রুতির জন্য বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানায় ফ্রান্স।
বাংলাদেশের সব বিমানবন্দরে উন্নত এয়ার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় অব্যাহত সহযোগিতার গুরুত্বের ওপরও জোর দেয় উভয়পক্ষ। একইসঙ্গে ২০৪১ সালে একটি স্মার্ট বাংলাদেশের রূপকল্পের জন্য দুটি দেশ এয়ারবাস এবং বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেডের (বিএসসিএল) মধ্যে একটি মহাকাশ অংশীদারিত্বকে স্বাগত জানায়।
বাংলাদেশ ও ফ্রান্স কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসহ আইসিটি ও ডিজিটাল প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে সম্মত হয়েছে। এ বিষয়ে ফ্রান্স বাংলাদেশকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংক্রান্ত গ্লোবাল পার্টনারশিপের মতো উদ্যোগে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছে।যৌথ বিবৃতিতে দুই দেশ প্রত্নতত্ত্বের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে মহাস্থানগড় প্রত্নতাত্ত্বিক মিশনের মাধ্যমে তাদের দীর্ঘস্থায়ী সহযোগিতার প্রশংসা করে এবং অন্যান্য সম্ভাব্য খনন ও পুনরুদ্ধার মিশনের বিষয়ে আলোচনা করতে সম্মত হয়।
উভয়পক্ষ সাংস্কৃতিক সহযোগিতার আরও উন্নয়নে আগ্রহের কথা স্বীকার করে। সেক্ষেত্রে ঢাকা ও চট্টগ্রামের অঁলিয়াস ফ্রাসিসের প্রধান ভূমিকার কথা উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশের তরুণ কূটনীতিকদের জন্য ফ্রান্সে কূটনৈতিক ও ফরাসি ভাষার প্রশিক্ষণ দিতে সম্মত হয়েছে ফ্রান্স। বাংলাদেশ ও ফ্রান্স শান্তির সংস্কৃতির উন্নয়নসহ ইউনেস্কোর মধ্যে তাদের পারস্পরিক সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে সম্মত হয়েছে।
বাংলাদেশ এবং ফ্রান্স তাদের বৈজ্ঞানিক, প্রযুক্তিগত ও গবেষণা সহযোগিতা জোরদার করতে চায়। এ গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে গবেষণা সহযোগিতা জোরদার করার উপায় হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ওশান গভর্নেন্সে একজন ফরাসি সমুদ্রবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ নিয়োগকে স্বাগত জানায়।উভয়পক্ষ স্থাপত্য, প্রকৌশল, চিকিৎসা, সমুদ্রবিদ্যা, সিসমোলজির মতো অগ্রাধিকার বিষয়গুলোতে ফোকাসসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উচ্চ শিক্ষাগত এবং স্নাতকোত্তর স্তরে মানবসম্পদকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আরও বেশি শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং শিক্ষাবিদ বিনিময়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।যৌথ বিবৃতিতে আরও উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ এবং ফ্রান্স সম্পর্কের অংশীদারিত্বের কৌশলগত মাত্রা আরও গভীর করতে নিয়মিত উচ্চ-পর্যায়ের সংলাপ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

সূত্র: ঢাকা পোষ্ট।

Related Articles

Back to top button