অর্থনীতিজাতীয়

পুরো বাজেটটাই গরিবের জন্য

বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী

টাইমস ২৪ ডটনেট, ঢাকা: অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত পুরো বাজেটই গরিব মানুষের জন্য উপহার। এ দেশে অনেক মধ্য আয়ের মানুষ আছে, সময় এসেছে তাদের ট্যাক্স পেমেন্ট করতে হবে। যারা আয় করেন ট্যাক্স দেওয়ার সক্ষমতা আছে তাদের ট্যাক্স দিতে হবে। তিনি বলেন, চলতি বাজেটে যেসব কমিটমেন্ট বা অঙ্গীকার দিয়েছি সবগুলো পূরণ করেছি। ২ কোটি ৪৫ লাখ চাকরির ব্যবস্থা করেছি। ধীরে ধীরে কর্মসংস্থান বাড়ছে। কর্মসংস্থানের জন্য নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছি।শুক্রবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) অর্থ মন্ত্রণালয় আয়োজিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন অর্থমন্ত্রী। গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট পেশ করেন তিনি। বাজেটে এবার রাজস্ব খাতে আয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে কর হিসেবে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা আদায় করা যাবে বলে আশা করছেন মন্ত্রী। রীতি অনুযায়ী শুক্রবার ছয়জন মন্ত্রী এবং সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে আসেন অর্থমন্ত্রী। নতুন অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সেখানে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি।
আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, আপনারাই আগে বলতেন এ দেশে মিডিল ইনকাম জনসংখ্যার হার বেশি, কিন্তু তারা ট্যাক্স দেয় না। এরা সবাই যদি ট্যাক্স দিতে তাহলে অন্যদের ভাগে কম ট্যাক্স দিতে হত। আমি মনে করি, এখন সময় এসেছে সবাইকে ট্যাক্স পেমেন্ট করতে হবে। তিনি বলেন, আমি চাকরির ব্যাপারে যেসব কমিটমেন্ট বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বাজেটে করেছিলাম সেগুলো দিয়েছি। আমরা মেইড ইন বাংলাদেশ কালচারটা জনপ্রিয় করার চেষ্টা করছি। এ দেশে যা জিনিস তৈরি হবে, তা দিয়ে আমাদের প্রয়োজন মিটবে। এর মধ্য দিয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
ফেইল করিনি, এবারও করব না:অতীতের বাজেটের ধারাবাহিকতায় সফলতা অর্জনে এবারো আশাবাদী অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি বলেন, গত পাঁচ বছরের বাজেটে আমাদের প্রজেকশন কী ছিল, আমরা কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পেরেছি, তা অ্যানেক্স (সংযুক্তি) হিসাবে দিয়েছি। আমরা ফেইল করি নাই। ইনশাআল্লাহ, এবারো ফেইল করব না, আগামীতেও আমরা ফেইল করব না। এটা আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। মানুষের কর্মদক্ষতা ও দায়বদ্ধতার ওপর ভর করেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে চান জানিয়ে তিনি বলেন, সবকিছুর মূলে হচ্ছে এ দেশের মানুষ, জনগোষ্ঠী। তাদের কর্মদক্ষতা, দেশের প্রতি তাদের মায়ামমতা, মানুষের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা। এটা অসাধারণ এক উদাহরণ আমি মনে করি। সেজন্য আমার বড় বিশ্বাস, আপনার মতো করে আমি বিশ্বাস করি যে, আমাদের পরাজয় নেই। ইনশাআল্লাহ, আমরা বিজয়ী হবই হব।
রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মুস্তফা কামাল বলেন, সরকার যখন প্রথম দায়িত্ব গ্রহণ করে তখন এনবিআর রাজস্ব ছিল ৫৯ হাজার কোটি টাকা। এখন সেটা ২ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকায় উত্তীর্ণ হয়েছে। যদি ৫৯ হাজার কোটি টাকা থেকে এখন যদি তিন লাখ কোটি টাকাতে যায়, যেটুকুন বাড়তি বলছেন, এটা আমরা অর্জন করতে পারব ইনশাআল্লাহ। আমাদের প্রজেকশন যেগুলো আছে, আমরা ফুলফিল করতে পারব। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের সব বাজেটই নির্বাচনি বাজেট। জনগণের কল্যাণের কথা বিবেচনা করেই প্রতিবছর বাজেট দিই আমরা।
আইএমএফ’র শর্ত বা পরামর্শে বাজেট নয়:সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, আইএমএফ’র শর্ত মেনে বা পরামর্শে বাজেট করিনি। তাদের সুপারিশ যা ভালো লাগে, সেগুলো আমরা গ্রহণ করি; যা ভালো লাগে না, তা গ্রহণ করি না। তিনি বলেন, আইএমএফের সঙ্গে কাজ করা ভালো। তারা অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দেয়, সহায়তা দেয়। তবে আমরা আইএমএফের কথামতো বাজেট করিনি। যদিও আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থা দেশের রাজস্ব আয় বাড়ানোর কথা বলেছে। সেই হিসাবে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। শর্ত না মানলেও তাদের যেসব পরামর্শ আমাদের জন্য প্রয়োজনীয়, সেসব বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী বলেন, কেবল আইএমএফ না, সবাই দেখে ব্যালেন্স শিট ঠিক আছে কি না, রেভিনিউ অ্যাকাউন্ট ঠিক আছে কি না, ট্রায়াল ব্যালান্স ঠিক আছে কি না, আয়-ব্যয়ের পার্থক্য ঠিক আছে কি না। শুধু আমাদেরটা না, সবারটাই দেখে, আর এই দেখাটা ভালো। আইএমএফের সঙ্গে যারা কাজ করে, আমি মনে করি এটা ভালো দিক এজন্য যে, তারা শুধু অর্থ দিয়ে মানে লোন দিয়ে সাহায্য করে না, পাশাপাশি কিছু প্রকল্পের পরামর্শ দেয়। সেগুলো কীভাবে কম সময়ে বাস্তবায়ন করা যাবে, এগুলোও তারা পরমার্শ দেয়। তাই আমি মনে করি, এসব থেকে শেখার অনেক কিছু থাকে এবং আমরা সমৃদ্ধ হই। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা এখন পৃথিবীতে সবাই সবার সঙ্গে সম্পর্কিত, একই রেখায় যুক্ত। কেউ আলাদাভাবে বসবাস করার কোনো সুযোগ নেই। আপনি আমদানি করলেও কাউকে না কাউকে লাগবে, রপ্তানি করলেও লাগবে। আর এখন ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ হচ্ছে, অন্য দেশ থেকে বলে দেওয়া হচ্ছে কোন দেশ থেকে পণ্য পাওয়া যাবে, কোথায় থেকে আমরা তা পেতে পারি। আমাদের সাধ বা সাধ্য এখন এককভাবে পরিচালন করা সম্ভব না, মাঝে মাঝে সমস্যা দেখা দিলে আমরা তা ফ্লেক্সিবলভাবে সমাধানের চেষ্টা করি।
মূল্যস্ফীতি নিয়ে সরকারও শঙ্কিত:মূল্যস্ফীতি নিয়ে সরকারও শঙ্কিত বলে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল। মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ে আমরা নিজেরাও শঙ্কিত। সারাবিশ্বই এখন মূল্যস্ফীতিতে আছে। আমরা খাবার তো বন্ধ করতে পারবো না। মানুষকে খাবার না দিয়ে রাখা যাবে না। আমরা একটা ফ্লেক্সিবল ওয়েতে এগোচ্ছি। যেসব কারণে এটি হয়, সেটি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি। প্রয়োজন অনুযায়ী আমরা ছাড় দিচ্ছি। তিনি বলেন, সামাজিক নিরাপত্তার মাধ্যমে প্রচুর খাদ্য সরবরাহ করছি। পাশাপাশি যেসব পণ্য নিত্যপ্রয়োজনীয়, সেখানে নিজেরা নিয়ন্ত্রণ করে সরকারকে সাহায্য করছি। এভাবে আমরা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করছি।
আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, যখন আমরা ক্ষমতায় আসি, তখন মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ শতাংশ। পরের ১০ বছরে সেটি ৬ শতাংশে নেমে আসে। সারাবিশ্বে মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়েছে। এখন খুব খারাপ সময়। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আমরা ভালো আছি। এবারও যেসব প্রজেকশন আমাদের আছে, সবই আমরা বাস্তবায়ন করতে পারবো বলে আশা করি। মূল্যস্ফীতি নিয়ে শঙ্কিত মন্তব্য করে তিনি বলেন, যেসব কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়ে, তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি আমরা। প্রয়োজনে খাদ্য আমদানি করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা হবে। আমরা যখন দায়িত্ব নিই, তখন মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১২ শতাংশ। আমরা মূল্যস্ফীতির এই টার্গেট অর্জন করতে পারবো। আইএমএফ থেকে যে ঋণ নিয়েছি, তা আমাদের দেড় মাসের রেমিট্যান্সের সমান।
একজনও কালো টাকা সাদা করেনি:গত এক বছরে একজনও কালো টাকা সাদা করেনি বলে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। গত বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিলেও এবারের বাজেটে এ ধরনের কোনো সুযোগ কেন রাখা হয়নি- সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গত বছরের বাজেটে বলেছিলাম, কেউ যদি অপ্রত্যাশিত টাকা দেশে নিয়ে আসে, তাহলে সেই টাকার কোনো কর দিতে হবে না। গত বাজেটে এ সুযোগটি দেওয়ার পরও এখন পর্যন্ত কোনো অপ্রত্যাশিত টাকা বাংলাদেশে আসেনি। তাই এবারের বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়নি।
গত অর্থবছরের বাজেটে অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী, কেউ যদি বিদেশ থেকে অর্থ আনেন, তাহলে ৭ শতাংশ কর দিলেই হবে। আর বিদেশে থাকা স্থাবর সম্পত্তি বাংলাদেশে না আনলে ওই সম্পদের মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ এবং বিদেশে থাকা অস্থাবর সম্পত্তি বাংলাদেশে না আনলে এর ওপর ১০ শতাংশ হারে কর আরোপ করা হবে। গত বছরের ১ জুলাই থেকে চলতি মাসের ৩০ জুন পর্যন্ত অর্থাৎ এক বছরের জন্য এ সুবিধা বহাল থাকবে বলে জানানো হয়েছিল।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন- কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম, শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান, এনবিআর চেয়ারম্যান রহমাতুল মুনিম, অর্থসচিব ফাতিমা ইয়াসমিন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার প্রমুখ।

Related Articles

Back to top button