মতামত

ড. খালেদা সালাহ উদ্দিন জীবনলিপি এবং নয়ন রহমান

সৈয়দা রাশিদা বারী: সৃষ্টিশীল অথবা সমাজসেবী মানুষের জীবনাসন হলেও তিনি যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকেন মানুষের মনে। এ জন্যই কবি, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী এবং শিল্পীরা বেঁচে থাকেন যুগ যুগ ধরে মানুষের অন্তর লোকে। ড. খালেদা সালাহউদ্দিন তাঁর সৃষ্টি কর্মের জন্য, তাঁর অনন্য সাধারণ প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের জন্য অসাধারণ সাহিত্যকর্ম এবং সদাচারণের জন্য দৈহিক মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকবেন তাঁর অনুরাগীদের মনে।
বাংলাদেশের সমুদ্র বেষ্টিত এক নিভৃত পল্লীর নৈসর্গিক পরিবেশে বর্তমান ভোলার চরফ্যাশন গ্রামে ১৯৩৫ সালের ১লা মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা নাসির আহমেদ ছিলেন উচ্চশিক্ষিত এবং উদার প্রকৃতির। খালেদা সালাহউদ্দিন নিজেই বলেছেন, “আমার জীবনের সবটুকু পাওয়ার পেছনে রয়েছে আমার বাবার অবদান।” যে সময়ে আমার জন্ম সে সময়ে মুসলিম সমাজে শিক্ষিত মহিলাদের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। খালেদা সালাহ উদ্দিনের দাদা তার বাবা নাসির আহমেদকে সামাজিক প্রতিকুলতার মধ্য দিয়ে যেমন লেখাপড়া শিখিয়েছেন তেমনি তার বাবাও সমাজের ভ্রুকুুটি উপেক্ষা করে তার হাত ধরে তাঁকে আলোর পথে এনে দাঁড় করিয়েছেন।
তেঁতুলিয়া নদীর পাড়ে অপার নৈসর্গিক সৌন্দর্যের আঁধার এই গ্রামটি। প্রচুর নারকেল ও সুপারি গাছের বেষ্টনীতে এ গ্রামটি ছায়া ঢাকা। মায়া ভরা। খালেদা সালাহউদ্দিনের বাবার জন্মও এই গ্রামে। প্রচলিত নিয়মানুযায়ী বাংলাভাষার সাথে সাথে আরবী ভাষাও শিখতে হয়েছিল তাঁর বাবাকে। আরবী ভাষার উপর অসামান্য দখল ছিল তাঁর আরবী ভাষায়, তাঁর পাণ্ডিত্যও ছিল অসাধারণ এবং ঈর্ষণীয়। তিনি বিদ্যোৎসাহী ছিলেন স্মরণ শক্তি ছিল প্রখর। একজন ধার্মিক ব্যক্তি হিসেবে ততটাই পরিচিত ছিলেন। সমাজ সচেতন বিদ্যেৎসাহী পিতা পুত্র কন্যাদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। এই অগ্রসরমনা বাবার জন্যই তাঁর যাত্রা শুরু হয়েছিল আলোর পথে। মাওলানা নাসির আহমেদ ছিলেন অবিভক্ত ভারতবর্ষের বর্তমান ভোলা জেলার অন্যতম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি খেলাফত ও স্বদেশী আন্দোলন এবং পরবর্তীতে কুইট ইন্ডিয়া আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেছিলেন। মাহাত্মা গান্ধীর বরিশাল আগমন উপলক্ষ্যে সেখানে যে বিশাল সভা হয়েছিল সে সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন মাওলানা নাসির আহমেদ। তাঁর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনের তথ্য অনেক সমৃদ্ধ। পুত্র কন্যাদের নিজের আদর্শে তিনি উপযুক্ত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। খালেদা সালাহউদ্দিন- ড. খালেদা সালাহউদ্দিন হিসেবে পরিচিতি লাভের পেছনে রয়েছে তাঁর অফুরন্ত অবদান।
ড. খালেদা সালাহ উদ্দিনের এক ভাই ও তিন বোন। ভাই অধ্যক্ষ সাদ জগলুল (বর্তমানে পরলোকগত)। অন্য ৩ বোন হলেন- মিসেস সাজেদা রেজা, ড. নাদিয়া আলম এবং ড. রেহানা হোসেন। ড. রেহানা হোসেন বর্তমানে ঢাকাস্থ সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের সিনিয়র পিডিয়াট্রিশয়ান। লে. কর্ণেল পদমর্যাদায় শিশু বিভাগের প্রধানের দায়িত্বে নিয়েজিত আছেন। তাঁর স্বামী ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন। তিনি দায়িত্বপূর্ণ পদে থেকেও লেখালেখির অভ্যাস ত্যাগ করতে পারেননি। বাংলাদেশের রক্তাক্ত অধ্যায়, জনগণের রাজকুমারী ডায়না গ্রন্থসহ অনেক বিদগ্ধ প্রবন্ধ এবং ভ্রমণ বিষয়ে লেখালেখিতে অবসরে ব্যস্ত থাকেন।
খালেদা সালাহউদ্দিনের মা বেগম জেবুন্নেসা স্কুলের গন্ডি পার হয়ে বেশি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় অগ্রসর হতে না পারলেও ছেলে মেয়ের পড়াশুনার ব্যাপারে খুবই যত্নশীল ছিলেন। বাবা মার আগ্রহ ও অনুপ্রেরণায় রক্ষণশীল সমাজের শৃঙ্খলা ভেঙ্গে খালেদা সালাহউদ্দিন এবং তার ভাই বোনরা উচ্চ শিক্ষা লাভে সক্ষম হয়েছিলেন।
খালেদা সালাহউদ্দিনের শিক্ষা জীবন শুরু হয় টাফন্যাল ব্যারেট এম. ই স্কুলে। পরীক্ষায় তিনি ১ম স্থান অধিকার করেন। এরপর সব প্রতিকূলতাকে পেছনে ফেলে তাঁর বাবা তাঁকে চরফ্যাশন প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। সেখান থেকে তাকে নিয়ে আসেন বরিশাল সাইদুন্নেসা গার্লস হাই স্কুলে। মাধ্যমিক পরীক্ষায় তিনি অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করেন। খালেদা সালাহউদ্দিন তাঁর বাবার উৎসাহে চলে আসেন কলকাতা। তাঁকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয় লেডি ব্রাবোর্ন কলেজে। এক নতুন জীবনের সাথে পরিচিত হন খালেদা সালাহউদ্দিন। ম্যাট্রিকুলেশন এবং আই.এ. পরীক্ষায় তিনি মেধা তালিকায় ৩য় স্থান লাভ করেন। উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য তিনি ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বৃত্তি নিয়ে অর্থনীতিতে অনার্সসহ বি.এ পাশ করেন। এরপর একই বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম. এ ডিগ্রী লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চ পরিচালিত স্যোসাল সায়েন্স গবেষণা পদ্ধতির উচ্চতর কোর্সে তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান লাভ করেন এবং পুরস্কৃত হন। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পি.এইচ. ডি ডিগ্রী লাভ করেন (১৯৩৩) সালে।
ড. খালেদা সালাহউদ্দিন কর্মজীবনে বি. সি. এস এডুকেশন ক্যাডারের সদস্য হিসেবে ইডেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অর্থনীতি বিষয়ে অধ্যাপনা করেছেন। পরে বাংলাদেশ সরকারের বস্ত্র মন্ত্রণালয়ে কর্মসংস্থান পরামর্শক (এডভাইজার) হিসেবেও কিছুদিন কাজ করেছেন। এরই মধ্যে অব্যাহত রেখেছেন সাহিত্যচর্চা। ইংরেজী এবং বাংলায় তিনি দক্ষতার সাথে গল্প ও প্রবন্ধ রচনায় পারদর্শী ছিলেন। গল্প, কবিতা প্রবন্ধ প্রতিটি শাখায় ছিল তাঁর সাবলীল বিচরণ রম্য গল্প রচনায় তিনি উৎসাহ পেতেন এবং পাঠক মন তৃপ্ত হতো তা পড়ে।
ব্যক্তিগত জীবন: পরিতৃপ্ত পারিবারিক জীবন যাপন করেছেন ড. খালেদা সালাহউদ্দিন। একমাত্র ছেলে ছিল তার চোখের মণি। একমাত্র কন্যা মলির আকষ্মিক মৃত্যু তাঁকে বিচলিত করেছিল। ফলে পরবর্তীতে ধীরে ধীরে মানসিক ভারসাম্য হারাতে শুরু করেন। স্বাভাবিক জীবনে নামাজ রোজা কখনো বাদ দেননি। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে সুসজ্জিত অবস্থায় যে কোন অনুষ্ঠানে সময়মত উপস্থিত হতে পছন্দ করতেন, বাংলাদেশের অনেক নারী সংগঠন সাহিত্য সংগঠন রয়েছে। সকলের সাথে সু সম্পর্ক থাকায় নিমন্ত্রণ পেলে অংশ গ্রহণ করতেন। তিনি বাগ্মী ছিলেন। ইংরেজীতে যেকোন বিষয়ে অনর্গল বক্তৃতা দিতে পারতেন। শ্রোতা দর্শক বিমুগ্ধ চিত্তে তা শুনতেন। তিনি সাজ-গোছ পছন্দ করতেন তবে তা শালীনতার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।
ড. খালেদা সালাহউদ্দিন দীর্ঘ ৪০ বছর যাবত বাংলাদেশ লেখিকা সংঘের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। প্রায় ২৫ বছর তিনি এই সংগঠনের সভানেত্রীর দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করেছেন। নির্অহংকারী দীপ্ত প্রতিভার অধিকারী খালেদা সালাহউদ্দিন। সংগঠনের প্রতিটি সদস্যের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতেন।
ড. খালেদা সালাহউদ্দিনের প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ :
গল্প: ১. ঞযব জধরহনড়ি (১৯৬৬) ২. দুই বৃত্তে (১৯৭০) ৩. যখন রুদ্ধশ্বাস (১৯৮৬) ৪. হৃদয়ের বিচিত্রগতি (১৯৮৮) ৫. নির্বাচিত গল্প (১৯৯১) ৬. খালেদা সালাহউদ্দিনের রচনাবলী (২০০০) ৭. চয়িত গল্পগুচ্ছ (১৯৯৯) ৮. ফিরে আসে স্মৃতির পাখিরা (২০০৫)
কবিতা: ১. নদীরা সমুদ্রমুখী।
প্রবন্ধ গবেষণা: ১. মহিলা সাহিত্যিকদের রচনায় মুক্তিযুদ্ধ ও অন্যান্য প্রবন্ধ (১৯৮৭) ২. আধুনিক সমাজ ও বাংলাদেশের নারী (১৯৯০) ৩. ডড়সবহ ধহফ ঞবপযহড়ষড়মু: ওসঢ়ধপঃ ড়ভ ঃবপযহড়ষড়মরপধষ পযধহমবং রহ অমৎরপঁষঃঁৎব ড়হ ৎঁৎধষ ড়িসবহ রহ ইধহমষধফবংয (১৯৮৬) ৪. ডড়সবহ রহ টৎনধহ রহভড়ৎসধষ ংবপঃড়ৎ: ঊসঢ়ষড়ুসবহঃ চধঃঃবৎহ অপঃরারঃু ষরভবং ধহফ চৎড়নষবসং (১৯৯২). ৫. ঊহবৎমু ধহফ ধিঃবৎ পৎরংবং রহ জঁৎধষ ইধহমষধফবংয ষরহশধমং রিঃয ড়িসবহ’ং ড়িৎশ ধহফ ঃরসব (১৯৯৪). ৬. ডরফড়ংি রহ ৎঁৎধষ ইধহমষধফবংয (১৯৯৫) ৭. জঁৎধষ ড়িসবহ রহ চড়াবৎঃু: ঘএঙ ওহঃবৎাবহঃরড়হ ভড়ৎ অষষবারধঃরড়হ (১৯৬৬) ৮. ওহপড়সব মবহবৎধঃরড়হ ড়ভ ংধারহমং ড়ভ ৎঁৎধষ ড়িসবহ: ওহংঃরঃঁঃরড়হধষ ৎৎধহমবসবহঃ রহ ইধহমষধফবংয (১৯৮৪). পুরস্কার: ১. নূরুন্নেসা খাতুন বিদ্যা বিনোদিনী ¯¦র্ণপদক (১৯৭৮) ২. নিভূত স্বর্ণপদক (১৯৯৩) ৩. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইকনমিকস রিচার্স ব্যুরো
পুরস্কার ৪. ঢাকা লেডিস ক্লাব সংবর্ধনা (১৯৮১) ৫ জাতীয় সাহিত্য সংসদ স্বর্ণপদক – (১৯৯০) ৬. বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ সাহিত্য পদক ও (১৯৯৮), ৭. আল্পনা সাহিত্য পুরস্কার, ৮. শ্রেষ্ঠ নন্দিনী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৬) ৮. সোনালী রোদ সাহিত্য পুরস্কার (কলকাতা-১৯৯৭) ৯. সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদ এর নববর্ষ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৭) ১০. সাজিদুন্নেসা চৌধুরানী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৮) ১১. ড. আশরাফ সিদ্দিকী ফাউন্ডেশন পুরস্কার (২০০০), ১২. কমর মুশতারী সাহিত্য পুরস্কার (২০০০), ১৩. সিলেট লেখিকা সংঘ পুরস্কার (২০০০), ১৪. বাংলাদেশ জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন (২০০২), ১৫. সানি হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন পুরস্কার (২০০০)।
ড. খালেদা সালাহউদ্দিনের জীবন সঙ্গী জনাব সালাহউদ্দিন আহমেদ পুলিশ ডিপার্টমেন্টের একজন উচ্চপদস্থ (আই জি পি) কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি ২০১১ ইং ৩০ জুলাই পরলোক গমন করেন। আর ২০১৪ ইং – ১৫ জানুয়ারী ড. খালেদা সালাহউদ্দিনের মৃত্যু হয়।
দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে যে, ড. খালেদা সালাহ উদ্দিন সাহেবের মৃত্যুর পর উপরোক্ত কালেকশন ‘স্বপ্নের দেশ’ এ ছাপানোর জন্য তৈরি রেখেছিলাম। বিশেষ সমস্যার কারণে ‘স্বপ্নের দেশ’ তার পরে আর প্রকাশ না হওয়ায় লেখাটিও প্রকাশ হয়নি। এরপর একই সালে বছর পার না হতেই লেখিকা সংঘের আর এক অভিভাবক সাহিত্যিক নয়ন রহমান আপাও হঠাৎ পরলোকগমন করলেন (২১ ডিসেম্বর, ২০১৪)। বলতে হয় বাংলাদেশ লেখিকা সংঘর ইনারা ছিলেন দুই প্রাণ পুরুষ। আমি যখন বেগম পত্রিকার সম্পাদক বেগম নূরজাহান আপার পরামর্শ মতো বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ কুষ্টিয়া শাখা খুলেছিলাম, তখন ছিলেন এই সংগঠনের ইনারায় প্রধান। শাখা খোলার আগে এবং পরেও বাংলাদেশ লেখিকা সংঘের এই দুই প্রাণ পুরুষের নিকট আমি ছিলাম স্নেহ অনন্য ও স্নেহ ধন্য। তিনারা আমাকে ছোটবোনের মতোই ভালবাসতেন এবং কদর দিতেন। কুষ্টিয়া লেখিকা সংঘ ছেড়ে ঢাকাতে আমি লেখালেখি নিয়ে প্রচন্ড ব্যস্ত ছিলাম। এই দুই মহত ব্যক্তির সঙ্গে আমার ভালবাসা গভীর থেকে আরও গভীরতম হয়। কেননা কুষ্টিয়াতে শাখা প্রতিষ্ঠা করে তুখোর ভাবে চালিয়েছি ৫বছর। এবং ঢাকাতেও আজীবন সদস্য ছিলাম। কুষ্টিয়া শাখা ছেড়ে ঢাকাতে এসে তাদের সাথে অতঃপরত জড়িত থাকলেও কখনও নির্বাহী কমিটিতে দায়িত্ব নিতে চাইনি, সময় দিতে পারব না বলে। তিনারা আমাকে কুষ্টিয়া ফিরে কুষ্টিয়া শাখা সংগঠন আবার চাঙ্গা করতে অনুরোধ করেন। কিন্তু সময়ের জন্য আমি তাঁদের কাছে ক্ষমা ভিক্ষে চেয়ে নিই। কেননা তারা জানতেন তাদের কথা ফেলবো এমন অবাধ্য মেয়ে আমি নই। কাজেই তাঁরা আমার দিকটাও ভাবলেন এবং বেশ খুশিই থাকলেন। আমি ছিলাম নাকি অনেক ছোট। তাই দেখা হতে মাত্র নিজের থেকেই দু’জন বলতেন রাশিদা Ñ তুমি লেখিকা সংঘের পুরস্কার প্রাপ্তা বটে। আমরা তোমাকে প্রথম কাতারেই পুরস্কৃত করার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছি কিন্তু তুমি বয়সে এত বেশী ছোট যে সাহিত্য পুরষ্কার নেয়ার অনুপোযুক্ত।
বলতেন তুমি তো লেখিকা সংঘর কাছে সম্মাননা প্রাপ্তা দুই সাইড দিয়ে। ১. বাংলাদেশ লেখিকা সংঘর কুষ্টিয়া জেলা শাখা খুলে ব্যাপক আলোড়িত করেছ যোগ্য পরিচালনায়। (তখন আলোড়িতই ছিল, যখন আমি চালাতাম এখন আমি না থাকাই তেমন কার্যক্রম নাই।) ২. লেখালেখিতেও অনেক ধাপে এগিয়ে। গ্রাম্য সাধারণ মধ্যবৃত্ত পরিবার-থেকে এবং একজন নারী লেখক রূপে সার্বিক পর্যায়ের মাপকাঠি অনুযায়ী বিবেচনা করলে তুমি বিশেষ ভাবে এখনই পাওনাদার। কিন্তু বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ বয়সেরও সিনিয়রিটি মেইনটেইন করে। তোমার বয়স পরিপক্ক না হওয়ায় আমরা অপেক্ষা করছি, তোমাকে সিডিউলে রেখেই; আমাদের সাথে তুমিও অপেক্ষা করো। অপেক্ষায় বরকত থাকে। তিনারা আমার মঙ্গল চাইতেন আমার লেখালেখিতে পরামর্শ দিতেন সাহিত্যের সারথীয় বন্ধু হিসেবে। আমিও বড়বোন মনে করে আমার গবেষণা ও সাহিত্য সাধনায় কখনো অভিভাবক কখনো গুরুজন ভেবে তাদের মান্য ও শ্রদ্ধায় সান্নিধ্য নিতাম। পরে ২০১০ সালে তিনাদের দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর মনে করলেন বয়সে আমি লেখিকা সংঘর ধারা চিত্রে উপযুক্ত হয়েছি। এবং সেইবার তিনারা আমার লেখিকা সংঘের পক্ষ থেকে সংবর্ধিত করলেন। আমি লক্ষ্য করলাম যে আমাকে সংবর্ধিত করে তিনারা আমার সংবর্ধনা পাওয়ার চেয়েও অনেক বেশী খুশি হলেন। অর্থাৎ আমার থেকে ডবল গুনে বেশী খুশি উনারা হয়েছিলেন। ঐ সময় হতেই ড. খালেদা সালাহউদ্দিন আপার শরীর ক্রমেই অবনতির দিকে যেতে থাকে। নয়ন আপার শরীরও বেশ খারাপ ছিল। কিন্তু তিনি যে এত তাড়াতাড়ি এমন করে তার অসুস্থ স্বামীর ফেলে আগে চলে যাবেন কল্পনাও করতে কষ্ট হয়। কেননা নয়ন আপা ছিলেন এক অমীয় দায়িত্বশীল প্রাণ। স্বামীর প্রতি ছিল তার অসম্ভব শ্রদ্ধা।
আজ তাদের (ড. খালেদা সালাহ উদ্দিন-নয়ন রহমান) বিয়োগ বেদনা আমাকে অনেকটায় ব্যথিত করেছে। সেই তো কিংবদন্তি বেগম নূরজাহান আপা তখনও ছিলেন। যার নির্দেশক্রমে আমি প্রথম তাদের সঙ্গে দেখা করি! পরবর্তীতে কুষ্টিয়ায় বাংলাদেশ লেখিকা সংঘর শাখা খুলি ১৯৯৫ সালে। এবং অনেক বেশী অসুস্থ থেকেও আমি আজও আছি! নেই কেবল বাংলাদেশ লেখিকা সংঘর (আমি কুষ্টিয়া সংঘ প্রতিষ্ঠা লগ্ন বা যুগ ধরে বলছি) সেই দুই প্রাণ পুরুষ অধ্যাপক কবি ও কথাশিল্পী ড. খালেদা সালাহ উদ্দিন এবং অধ্যাপক ও শিশু সাহিত্যিক কথাশিল্পী নয়ন রহমান। যা কিছুতেই মেনে নিতে মন চাইছে না অথচ মেনে নিতেই হচ্ছে। কিন্তু নয়ন আপা যিনি একজন গার্জিয়ানের মতো প্রায়ই আমার শরীরের খোঁজ খবর নিতেন। আমাকে সাবধান ও সতর্কতায় চলতে উপদেশ দিয়ে বিশেষ চিন্তিত থাকতেন। সেই আমিই আছি এত কঠিন অবস্থানে থেকেও যা অবিশ্বাস্য – সৃস্টি জগতের এ এক পাষন্ড রহস্য ?! নাকী স্রষ্ঠার অপার দয়া ও অবিস্মণীয় ক্ষমতা!!
আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘে এই দুই নেত্রীর যে নিঃস্বার্থ অবদান তা নক্ষত্রের মতই জ্বলজ্বল করবে। তাদের লেখনির সৃষ্টিও চিরদিন বেঁচে থাকবে। জগতের এটায় ধারা এবং নিয়ম – যে মানুষ থাকে না স্মৃতি রয় সৃষ্টি রয়। তাই যুগেযুগে কালে কালে ড. খালেদা সালাহ উদ্দিন, নয়ন রহমান সাহিত্য ইতিহাসে থাকবেন, নিশ্চয় থাকবেন। ইতিতে আমি এই দুই নক্ষত্রের পরিবারের ওপর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি এবং মৃতদ্বয়ের আত্মার শান্তি ও বেহেস্ত নসীব কামনা করছি। ওয়াস সালাম।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Related Articles

Back to top button