টাইমস ২৪ ডটনেট, ঢাকা: উত্তর গাজাকে কার্যত ধ্বংস্তূপে পরিণত করার পর এবার দক্ষিণ গাজায় স্থল অভিযান চালাচ্ছে ইসরাইলি সেনারা। এর আগে তিনদিন অঞ্চলটিতে ব্যাপক বোমাবর্ষণ করেছে ইসরাইল বাহিনী। অবরুদ্ধ গাজায় ক্ষণস্থায়ী সাতদিনের যুদ্ধবিরতির পর পুনরায় ইসরায়েলি বোমা হামলার বিরুদ্ধে তেল আবিবে প্রতিবাদ করেছেন প্রায় অর্ধশতাধিক বিক্ষোভকারী। ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধে আরেকটি যুদ্ধবিরতির বিষয়ে কাতার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে। এক্ষেত্রে যাতে স্থায়ী যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছানো যায়, সে বিষয়েও কাজ করবে বলে জানিয়েছেন কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আব্দুলরাহমান বিন জসিম। গাজায় এই গণহত্যার জন্য ইসরাইলকে শাস্তি দিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যথাসাধ্য চেষ্টা করবে বলে জানিয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান।
ইসরাইলি সেনাবাহিনী পরিচালিত রেডিওতে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরাইল খান ইউনিসের উত্তরে স্থল অভিযান শুরু করেছে ইসরাইলি বাহিনী। ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধান (আইডিএফ) লেফটেন্যান্ট জেনারেল হেরজি হালেভি সেনাদের উদ্দেশে বলেছেন, ইসরাইলি সেনারা দক্ষিণ গাজায় ‘দৃঢ় ও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে’ লড়াইয়ে অংশ নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘আগে আমরা উত্তর গাজায় জোরালো ও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লড়াই করেছি। এখন দক্ষিণ গাজায় তা করা হচ্ছে।’
গত ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় হামলা চালাচ্ছে ইসরাইল। দীর্ঘ দেড় মাসেরও বেশি সময় ধরে হামলা চালানোর পর মিশর ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় গত ২৪ নভেম্বর প্রথম দফায় চার দিনের যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। এরপর দুই দফায় মোট তিন দিন বাড়ানো হয় যুদ্ধবিরতির মেয়াদ। যুদ্ধবিরতির মধ্যে চুক্তি মেনে মোট সাতবার বন্দি বিনিময় হয়েছে। এরপর ১ ডিসেম্বর এই চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় আবারো গাজায় ব্যাপক হামলা শুরু করেছে ইসরাইলি সেনারা। গত রোববার গাজার সরকারি মিডিয়া অফিসের মহাপরিচালক বলেছেন, গত ২৪ ঘণ্টায় গাজায় সাত শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
অন্যদিকে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) দাবি করছে, তারা হামাসের এক কমান্ডারকে হত্যা করেছে। দক্ষিণ গাজার রাফাহ শহরের দুটি বাড়িতে রাতারাতি বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এতে বেশ কয়েকজনের হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। দক্ষিণ গাজার রাফাহ এবং ইয়াবনা শরণার্থী শিবিরে আবাসিক ভবনে হামলার ঘটনায় কয়েক ডজন মানুষ আহত হয়েছেন। আইডিএফ এর আগে ঘোষণা দিয়েছিল, যে তারা দক্ষিণে স্থল অভিযান শুরু করছে। আকাশপথে হামলার পাশাপাশি তারা ট্যাংক নিয়েও অভিযান চালাচ্ছে। এর রেশ ধরে আইডিএফের প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হেরজি হালেভি বলেছেন, ইসরায়েলি সেনারা দক্ষিণ গাজায় দৃঢ়ভাবে লড়াইয়ে অংশ নিয়েছে।
এদিকে আইডিএফের প্রধান বলছেন, ইসরায়েলি সেনারা গাজায় হামাসের একজন কমান্ডারকে হত্যা করেছে। ওই ব্যক্তি ৭ অক্টোবর ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে হামাস যে আকস্মিক হামলা চালায় তার সঙ্গে জড়িত ছিল। টানা ৪৭ দিনের সংঘাতের পর গাজায় গত ২৪ নভেম্বর কাতারের মধ্যস্থতায় চারদিনের যুদ্ধবিরতি দেওয়া হয়। এরপর যুদ্ধবিরতির মেয়াদ দুই দফা বাড়িয়ে সাতদিন করা হয়। যুদ্ধবিরতি শেষ হওয়া মাত্র শুক্রবার সকাল গাজায় থেকে আবারও হামলা শুরু করেছে ইসরায়েল।
এদিকে অবরুদ্ধ গাজায় ক্ষণস্থায়ী সাতদিনের যুদ্ধবিরতির পর পুনরায় ইসরায়েলি বোমা হামলার বিরুদ্ধে তেল আবিবে প্রতিবাদ করেছেন প্রায় অর্ধশতাধিক বিক্ষোভকারী। গত শনিবার রাতে ইসরায়েলি সামরিক সদর দফতরের বাইরে এই বিক্ষোভ করেন ইসরায়েলিরা। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান এ খবর জানিয়েছে। প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, হামাসের হাতে বন্দি সব জিম্মিদের মুক্তির দাবিতে নিয়মিত সাপ্তাহিক সমাবেশের পর এখানে প্রতিবাদ করেন বিক্ষোভকারীরা। এ সময় ইসরায়েলের যুদ্ধ মন্ত্রিসভার সঙ্গে জরুরি বৈঠকের দাবি জানান তারা। গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর কিরিয়া সামরিক ঘাঁটির চারপাশে মিছিল করেন এই প্রতিবাদী জনতা। তখন তারা বলেন, এখনও ১৩০ জন জিম্মি মুক্তি না পাওয়ার জন্য ইসরায়েলই দায়ী।
প্রতিবাদে অংশ নেওয়া কৌতুক অভিনেতা নোম শাস্টার-এলিয়াসি বলেন, গাজায় আবার বোমা হামলার সিদ্ধান্ত জিম্মিদের পরিবারকে দুঃখের মধ্যে ফেলেছে। জিম্মিদের শেষ পরিণতির কথা ভেবে তিনি প্রশ্ন করেন, ইসরায়েলের পরিকল্পনা কী? এরা কি শুধু গাজায় বোমাবর্ষণ চালাচ্ছে? প্রতিবেদনে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর এলাকা সিজারিয়াতে আবারও সরকারবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে।
৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরায়েলে হামাসের হামলার জবাবে প্রায় দুই মাস ধরে গাজায় আগ্রাসন চালাচ্ছে ইসরায়েলি সেনারা। স্কুল, হাসপাতাল, স্কুল, শরণার্থী শিবির, অ্যাম্বুলেন্স কোনও কিছুই হামলার হাত থেকে রেহাই পায়নি। এখন পর্যন্ত ফিলিস্তিনে নিহতের সংখ্যা ১৫ হাজার ছাড়িয়েছে।
অন্যদিকে ইসরায়েলি কর্মকর্তারা এরই মধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছে তারা গাজার দক্ষিণে হামলা জোরদার করতে চায়। যদিও অক্টোবরে গাজাবাসীকে নিরাপদ অঞ্চল হিসেবে দক্ষিণে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল ইসরায়েল।
কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আব্দুলরাহমান বিন জসিম আল থানি বলেন, ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধে আরেকটি যুদ্ধবিরতির বিষয়ে তার দেশ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে। এক্ষেত্রে যাতে স্থায়ী যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছানো যায়, সে বিষয়েও কাজ করবে কাতার। এর আগে, মিশর এবং যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে কাতারের মধ্যস্থতায় এক সপ্তাহের যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছায় ইসরাইল ও হামাস। এ সময় ৮০ ইসরাইলি বন্দিকে মুক্ত করে হামাস। বিনিময়ে ২৪০ ফিলিস্তিনিকে ছেড়ে দেয় ইসরাইল। গত শুক্রবার এ যুদ্ধবিরতি শেষ হয়। এর জন্য একে অন্যের ওপর দায় চাপায় হামাস ও ইসরাইল। যুদ্ধবিরতি শেষ হতেই গাজায় আবার হামলা শুরু করে ইসরাইলি বাহিনী। গত রোববার গাজা কর্তৃপক্ষ জানায়, এদিন ইসরাইলি হামলায় ৭০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে, যার বড় অংশই নারী ও শিশু। এরই মধ্যে কাতার থেকে ইসরাইল তার গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের আলোচকদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এর ফলে গাজায় নতুন করে যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে এসেছে। এদিকে, হামাসও আর বন্দি বিনিময় নিয়ে নতুন করে আলোচনা করবে না বলে জানিয়েছে।
গত ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামলা চালায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস। ইসরাইলের ভাষ্যমতে, হামাসের এ হামলায় প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হন। এছাড়া দুই শতাধিক ইসরাইলিকে গাজায় জিম্মি করে হামাস। তাদের হাতে এখনও ১৩৭ জিম্মি আছেন বলে জানিয়েছে ইসরাইল। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, গত ৭ অক্টোবর থেকে ইসরাইলের পাল্টা হামলায় সাড়ে ১৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৭০ শতাংশের বেশি নারী ও শিশু।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান বলেন, আমরা এই গণহত্যার জন্য (ইসরাইলকে) শাস্তি দিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যথাসাধ্য চেষ্টা করব। এটি শুধু ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীর ওপর নয়, নেতানিয়াহুর সরকারের পাশাপাশি সেই দেশগুলোর ওপরও দায় বর্তাবে যারা নিঃশর্তভাবে এটিকে সমর্থন করে। নীরবতার জন্য আগামীতে তাদেরও মূল্য দিতে হবে। বিশ্ব এ উদাসীনতা ভুলবে না এবং ভুলতে দেয়া হবে না উল্লেখ করে এরদোয়ান জানান, তুরস্কের পাশাপাশি প্রায় তিন হাজার আইনজীবী গাজায় ইসরাইলের গণহত্যার বিষয়ে আইসিসির কাছে আবেদন করেছেন।
এর আগে, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে ‘গাজার কসাই’ বলে আখ্যায়িত করেছেন এরদোয়ান। অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় আগ্রাসন চালানোর জন্য ইসরাইলকে ‘সন্ত্রাসী রাষ্ট্র’ হিসেবেও আখ্যা দেন তিনি। নেতানিয়াহু এরই মধ্যে গাজার কসাই হিসেবে ইতিহাসে নাম লিখিয়েছেন। গাজায় হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে বা ইহুদি বিরোধিতাকে সমর্থন করে সব ইহুদিকে অনিরাপদ করে তুলেছেন তিনি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এরদোয়ানের এ মন্তব্য ইসরাইলের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক ছিন্ন করার ইঙ্গিত দিচ্ছে। তাদের সম্পর্ক প্রায় এক দশক খারাপ ছিল। সেটা ঠিক করে গত বছর আবার রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দিয়েছিল দুই পক্ষ। কিন্তু গাজা ইস্যুতে এখন তা আবারও অবনতির পথে।