topসারাদেশ

পারমাণবিক যুগে বাংলাদেশ

টাইমস ২৪ ডটনেট, ঢাকা: রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের ‘ফ্রেশ নিউক্লিয়ার ফুয়েল’ বা ইউরেনিয়াম হস্তান্তর করা হয়ছে। বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় ইউরেনিয়াম হস্তান্তরের মাধ্যমে বাংলাদেশে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। দুই দেশের সরকার প্রধানের ঐতিহাসিক কমিশনিংয়ের মধ্যদিয়ে পরমাণু যুগে প্রবেশ করলো বাংলাদেশ। ইউরেনিয়াম হস্তান্তর অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এছাড়া আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসিও যুক্ত ছিলেন। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পারমাণবিক সংস্থা রোসাটমের মহাপরিচালক আলেস্কি লিখাচেভ সশরীরে উপস্থিত থেকে ইউরেনিয়াম হস্তান্তর করেন। বাংলাদেশের পক্ষে ইউরেনিয়াম গ্রহণ করেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান।
ইউরেনিয়াম হস্তান্তর অনুষ্ঠান ঘিরে সাজ সাজ রব ছিল পাবনাজুড়ে। রূপপুর প্রকল্প ও গ্রিন সিটি আবাসিক এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়। প্রকল্প এলাকাজুড়ে বাংলাদেশ ও রাশিয়ার জাতীয় পতাকার পাশাপাশি বিভিন্ন রঙের পতাকা শোভা পাচ্ছে। এর আগে ২৯ সেপ্টেম্বর সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিশেষ নিরাপত্তায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিটের ইউরেনিয়ামের প্রথম চালান এসে পৌঁছায়। সেদিন ঈশ্বরদীর তিনটি মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। উৎসুক এলাকাবাসী সড়কের পাশের দোকানপাট, বাসাবাড়ির ছাদ ও দূর থেকে মহাসড়ক দিয়ে ইউরেনিয়ামবাহী গাড়িবহর দেখে উল্লাস প্রকাশ করেন।
২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ছিল রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ। তিন মেয়াদে একটানা প্রায় ১৫ বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে স্বপ্নের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প এখন বাস্তবে রূপ নিয়েছে। দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল এ প্রকল্প নির্মাণের ফলে আওয়ামী লীগ সরকার তার আরও একটি নির্বাচনী ইশতেহার পূরণ করলো।
প্রকল্প পরিচালক শৌকত আকবর বলেন, চলতি বছরের মধ্যে ৭৫ শতাংশ কাজ শেষ হবে রূপপুরে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিভিন্ন প্রস্তুতি পর্ব শেষে প্রথমত ভৌত অবকাঠামো তৈরি করা হয়। এরপর সেইসব অবকাঠামোর মধ্যে পারমাণবিক যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়। ভৌত কাঠামো নির্মাণের পর দ্রুতগতিতে চলে যন্ত্রপাতি বসানোর কাজ। ভৌত কাঠামো নির্মাণ গতির সাথে তাল মিলিয়ে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি তৈরি করা হয়েছে রাশিয়ায়। সব ধরনের বাধা মোকাবিলা করে কাজ চলছে রূপপুরে। কোনো কারণেই এখানে কাজ বন্ধ থাকেনি। আন্তর্জাতিক সব রীতিনীতি ও প্রটোকল এবং সব বিষয় মাথায় রেখেই কাজ চলছে রূপপুর প্রকল্পে। ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি খরচের এ প্রকল্পে ৯০ শতাংশ টাকা ঋণ দিয়েছে রাশিয়া। একই সঙ্গে আন্তঃরাষ্ট্রীয় কয়েকটি চুক্তির মাধ্যমে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ কারে ঠিকাদার এটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পাশাপাশি এটি পরিচালনার জন্য জনবলও তৈরি করে দিচ্ছে রাশিয়া। ইতিমধ্যে প্রকল্প এলাকায় পৌঁছেছে প্রকল্পের ফ্রেশ নিউক্লিয়ার ফুয়েল বা ইউরেনিয়াম।
পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ পদক্ষেপ বাস্তবায়নের প্রতি অঙ্গীকার ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, পারমাণবিক শক্তি আমরা শান্তিরক্ষায় ব্যবহার করব। বাংলাদেশে আমরা পরমাণবিক শক্তি নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করেছি। একটি স্বাধীন পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষও প্রতিষ্ঠা করেছি। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ইউরেনিয়াম হস্তান্তর অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী রাশিয়ার প্রেসিডেন্টকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ২০১৩ সালে প্রকল্পটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেছি। আপনার সহযোগিতায় সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। শেখ হাসিনা বলেন, অনুষ্ঠানে যারা উপস্থিত হয়েছেন তাদেরকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। আজ বাংলাদেশের জনগণের জন্য অত্যন্ত গর্বের দিন। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রচেষ্টায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সফলতার মুখ দেখছে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বন্ধুপ্রতিম দেশ রাশিয়ার সহযোগিতায় আমরা সেই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করেছি। তিনি আরও বলেন, ‘১৯৯৬ সালে যখন সরকার গঠন করি তখন সবার জন্য বিদ্যুৎ দেব-এ প্রতিশ্রুতি নিয়ে আমি কাজ শুরু করি। জ্বালানিতে পারমাণবিক বিদ্যুৎ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করি। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করি। যদিও সেসময় কাজগুলো শেষ করতে পারিনি। ২০০৮ সালে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেই এই প্রকল্পটা আমরা হাতে নিই।’
পারমাণবিক শক্তি শান্তিরক্ষায় ব্যবহার করব উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার সম্পূর্ণ নির্মূল এবং পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ পদক্ষেপ বাস্তবায়নের প্রতি দৃঢ অঙ্গীকার ব্যক্ত করছি। আমরা বাংলাদেশে পারমাণবিক শক্তি নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করেছি। একটি স্বাধীন পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করেছি। এই কর্তৃপক্ষ আইএইএ’র (আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি এজেন্সি) সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রেখে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতিটি স্তরে নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে।’
অপরদিকে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের গুরুত্বপূর্ণ ধাপে উত্তরণ উপলক্ষ্যে আমি সবাইকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। এ প্রকল্পে আমাদের দুই দেশের স্বার্থ জড়িত এবং এটি পারষ্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রকে আরও গভীর করেছে। রুশ প্রেসিডেন্ট বলেন, বাংলাদেশ আমাদের পরীক্ষিত বন্ধু। আমাদের সম্পর্ক সমতা, পরস্পরের জন্য শ্রদ্ধা ও পরষ্পরের স্বার্থ মেনে নেওয়ার ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সহায়তার মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এরপর থেকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে রাশিয়া কাজ করছে। বড় শিল্প ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে রাশিয়া সহায়তা করেছে। গত বছর কূটনৈতিক সম্পর্কের সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করেছে দুই দেশ। গতকাল বৃহস্পতিবার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ইউরেনিয়াম হস্তান্তর অনুষ্ঠানে রাশিয়া থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি এসব কথা বলেন। তাঁর বক্তব্য বাংলায় অনুবাদ করে শোনানো হয়। তিনি বলেন, ২০১৩ সালে রোসাটম বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে কাজ শুরু করে। গবেষণার কাজ শেষ হওযার পর ২০১৭ সালে চুল্লির প্রথম ঢালাইয়ের কাজ শুরু হয়। দুই ইউনিট বিশিষ্ট ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন এই কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিটের উৎপাদন ২৪ সালে এবং দ্বিতীয় ইউনিটের উৎপাদন ২০২৬ সালে শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে। পূর্ণমাত্রায় উৎপাদনে যাওয়ার পর বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বাংলাদেশের বিদ্যুৎ চাহিদার ১০ শতাংশ পূরণে সক্ষম হবে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি কার্বন নির্গমন করবে না, যা সামগ্রিক অর্থে একটি ভালো দিক।
পুতিন বলেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে ২০ হাজারের বেশি মানুষ কাজ করছে, যাদের বেশিরভাগই বাংলাদেশি। তাছাড়া ভারতীয় বন্ধুরাও আমাদের সাহায্য করছে। দুই দেশের কর্মীরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে এবং নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যেই কাজ শেষ করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রকল্পের পরিচিতি তুলে ধরেন পরমাণু বিজ্ঞানী ও প্রকল্প পরিচালক ড. মো. শৌকত আকবর। এরপর পারমাণবিক জ্বালানি উৎপাদন ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রথম ব্যাচের হস্তান্তর সম্পর্কিত ভিডিও প্রদর্শন করা হয়।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আলী হোসেন। এরপর ভার্চুয়ালি যুক্ত থেকে বক্তব্য রাখেন আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি এজেন্সির মহাপরিচালক রাফায়েল মারিয়ানো গ্রসি। এরপর রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রোসাটমের মহাপরিচালক আলেক্সি লিখাচেভ বক্তব্য রাখেন।

Related Articles

Back to top button