চলতি সংবাদ

বাংলাদেশে স্বামীকে কথা শুনতে হলেও গায়ে মাখেন না উবারচালক মারিয়াম আক্তার

সুকুমার সরকার, টাইমস ২৪ ডটনেট, ঢাকা: বাংলাদেশে সংসারের ঘানি টানতে উবারচালকের খাতায় নাম লিখিয়েছেন মারিয়াম আক্তার। এ কাজে প্রথম দিকে অস্বস্তি লাগলেও এখন বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন মারিয়াম। শ্বশুড়বাড়িতে বেড়াতে গেলে পাড়া-প্রতিবেশীদের ভীড় জমে যায়। এনিয়েও বেশ উপভোগ করেন তিনি। মারিয়াম আক্তার এক বছর ধরে অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং উবারের নিবন্ধিত চালক। মাসে অন্তত ২০ দিন গাড়ি (প্রাইভেট কার) নিয়ে বের হন তিনি। রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে অনার্সে পড়ছেন তিনি। জানালেন, যেদিন গাড়ি নিয়ে বের হন, সেদিন গাড়ির তেল, উবারের কমিশন বাদ দিয়ে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা নিয়ে বাড়ি ফেরার চেষ্টা করেন। মারিয়াম বললেন, পুরুষ চালকেরা গাড়ি চালানোর ফাঁকে চা, সিগারেট, পান খান, আড্ডা দেন। এতে তাঁদের বেশ খানিকটা সময় নষ্ট হয়। তিনি প্রায় সময় বাসা থেকে খাবার নিয়ে বের হন। পান-চা খান না, আড্ডাও দেন না। নিজের গাড়ি হওয়ায় নিজের মতো সময় ঠিক করে নেন। কাজ শেষে ফিরতে মাঝেমধ্যে রাত ১০টা ১১টা বেজে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিদিন ক্লাস থাকে না। যেদিন থাকে, কাজের ফাঁকেই ক্লাস সেরে নেন। শিক্ষকেরা জানেন তিনি উবার চালিয়ে সংসার চালান, তাই এ নিয়ে খুব একটা সমস্যা হয় না।
করোনাকালে উবারে গাড়ি চালানোর চিন্তা মাথায় আসে মারিয়াম আক্তারের। নিজের পছন্দ ও পরে পারিবারিকভাবেই মারিয়ামের বিয়ে হয়। বিয়ের সময় তিনি ও তাঁর স্বামী নাসির উদ্দিন শিক্ষার্থী ছিলেন।এখনো পড়াশোনা করছেন। তখন মারিয়ামের বয়স ছিল ১৮ বছরের একটু বেশি। সাড়ে তিন বছর বয়সী এক ছেলে আছে এ দম্পতির। করোনার আগে তাঁরা পড়াশোনার পাশাপাশি যা আয় করতেন, তা দিয়ে ভালোভাবেই চলতেন। তবে করোনা তাঁদের একেবারে পথে বসিয়ে দিয়েছিল।
ইউটিউবে দেখে মেয়েদের জুতা বানানো শিখেছিলেন মারিয়াম। পরে ছোট একটি কারখানা চালু করেছিলেন, নয়জন কর্মী কাজ করতেন। নিজেও জুতা বানাতেন। তাঁর স্বামী বাসার সামনেই একটি দোকান চালাতেন। দোকানে নিজেই চা বানাতেন আর মারিয়াম বাজার থেকে কেনা চা–পাতা বিভিন্ন চায়ের দোকানে বিক্রি করতেন। তবে ব্যাপক করোনা সংক্রমণকালে অনেক দোকানি টাকা ফেরত দিতে পারেননি।পুঁজির অভাবে জুতার কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। তখন মানুষের কাছে অন্তত তিন লাখ টাকা পাওনা ছিল।বাড়িভাড়া, খাওয়াদাওয়ায় জমানো টাকা শেষ হয়ে যায়। সংসার চালাতে কাজ খুঁজতে থাকেন। চড়া সুদে বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিই। চেনা–পরিচিতদের কাছ থেকে করা ধারদেনা পরিশোধ করতে পারছিলাম না বলে সবাই একটু খারাপ চোখে দেখা শুরু করে। সব মিলিয়ে খুব হিমশিম খাচ্ছিলাম।আমরা ঋণে ডুবে গেছি। অবস্থা এমন হয়েছিল যে স্বামীর মাস্টার্সের ফরম পূরণ করলে আমার পড়াশোনা স্থগিত করতে হবে। তাই আমি পড়াশোনায় একটু বিরতি নিই। কিছু একটা করার চিন্তা শুরু করি। ইউটিউব ঘাঁটতে ঘাঁটতে জানতে পারলাম, উবারে গাড়ি চালালে কম করে হলেও দিনে ২ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব। স্বামীকে বললাম, উবারে গাড়ি চালাব।গাড়ি চালানোর কথা শুনে স্বামী প্রথমে একটু অবাক হন। পরে ট্রেনিং সেন্টার থেকে এক হাজার টাকা প্যাকেজে ছয় মাস গাড়ি চালানো শেখেন। মারিয়াম বলেন, গাড়ি চালানো শেখার পর মনে হলো নিজের গাড়ি ছাড়া চলবে না। ঘুরতে ঘুরতে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক থেকে করোনায় প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনা তহবিল থেকে মাত্র ৪ শতাংশ সুদে ৪ লাখ ঋণ নেন।পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে পুরোনো একটি গাড়ি কেনেন। আর পেছনে তাকাতে হয়নি
উবারে গাড়ি চালিয়ে যে উপার্জন হয়, তাতে আত্মবিশ্বাস অনেকটা বেড়েছে মারিয়ামের। হাসিমুখে তিনি বলেন, ১১ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে তিনি আরেকটি গাড়ি কেনার চেষ্টায় আছেন। উবারের নিয়ম অনুযায়ী, একজন চালক ১২ ঘণ্টার বেশি সময় গাড়ি চালাতে পারেন না। প্রতি ট্রিপে ২৫ শতাংশ কমিশন ও ভ্যাট কেটে রাখে।মারিয়াম বলেন, উবারে গাড়ি চালানো শুরুর আগে দিনে ১ হাজার টাকা আয়ের স্বপ্ন দেখতেন। কাজ শুরুর পর বুঝলেন, স্বপ্নের পরিধিটা বাড়ানো যায়। পরিশ্রম করতে পারলে আয় বাড়বে।মারিয়ামের স্বামী যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন, সেখানেই ব্যবসায় প্রশাসনের মাস্টার্সে ভর্তি হন। চাকরির জন্য আবেদন করছেন, পরীক্ষা দিচ্ছেন। দোকানে বসে বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মারিয়াম সংসার চালানো, পড়াশোনার পাশাপাশি গাড়ি চালাচ্ছেন।
নারীচালক হিসেবে উবারে গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে মারিয়াম বলেন, যাত্রীরা গাড়িতে চড়ে অবাক হন। যাত্রীদের মধ্যে অনেক ছেলে-মেয়ে তাঁকে গাড়ি চালাতে দেখে নিজেরাও উৎসাহিত হন। শ্বশুরবাড়িতে গেলে অনেকে দেখতে আসেন। মারিয়ামের শ্বশুরবাড়ি টাঙ্গাইল জেলায়। গাড়ি চালিয়েই স্বামী-সন্তানকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যান। তখন প্রতিবেশীদের অনেকে তাঁর স্বামীর নাম ধরে বলেন, নাসিরের বউ গাড়ি চালিয়ে বাড়ি আসছে। অনেকেই গাড়িচালক বউ দেখতে বাড়িতে আসেন। তখন শাশুড়ি বেশ গর্বিত হন। সাড়ে তিন বছর বয়সী ছেলেও গল্প করে, তার মা গাড়ি চালায়।রাত পর্যন্ত গাড়ি চালাতে হয়, নিরাপত্তার অভাব বোধ করেন কি না, এমন প্রশ্নে মারিয়াম বলেন, উবারের কাছে আমার ও গাড়ির যাত্রীর সব তথ্য থাকে। গাড়ি কিছুক্ষণ জ্যামে আটকে থাকলেও উবার থেকে এসএমএস করে জানতে চায় কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি না। গাড়ি চালাতে গিয়ে বিপদে পড়লে চালক ও যাত্রীর জন্য নিরাপত্তা বাটন আছে। সব মিলিয়ে কখনো ভয় লাগে না। তা ছাড়া এ পর্যন্ত বাজে কোনো পরিস্থিতির মুখেও পড়েননি তিনি। মারিয়াম জানালেন, তাঁর মুঠোফোন নম্বরটি অনেক যাত্রীর হাতে চলে যাচ্ছে। পরে কেউ কেউ ফোন করে কথা বলতে চান বা বাজে ইঙ্গিত করেন। তবে সংখ্যাটা খুবই কম। মারিয়াম বললেন, চালক শিক্ষিত হলে, মাথা ঠাণ্ডা থাকলে, পরিবারে শান্তি থাকলে, চালকের ধৈর্য থাকলে এবং মুঠোফোনে কথা না বললে কখনোই বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটবে না। চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করা জরুরী।স্ত্রী গাড়িচালক বলে স্বামী নাসিরকে অনেকের কাছে অনেক কথাই শুনতে হয়। তবে নাসির কারও কথা গায়ে মাখেন না। মারিয়ামের স্বপ্নটা বড় হয়েছে। গাড়িচালক হিসেবে উবারে যাত্রীরা তাঁকে ৪ দশমিক ৮৪ রেটিং দিয়েছেন। নতুন গাড়ি পেলে পুরোনো গাড়িটা ভাড়া দেবেন। আয়ের পরিমাণ আরেকটু বাড়লে আরেকটি গাড়ি কিনবেন।

Related Articles

Back to top button