মতামত

জুলাই অভ্যুত্থান: একটি জনতার ইতিহাস

মিয়ান আরেফি:২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায় রচিত হয়। এটি ছিল একটি নেতৃত্বহীন কিন্তু সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবাহী ছাত্র জনতার অভ্যুত্থান। কোনো রাজনৈতিক সংগঠন বা পরিচিত নেতৃত্ব ছাড়াই, তরুণ প্রজন্ম বৈষম্যের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে এবং জনগণের আস্থার প্রতীক হয়ে ওঠে।

প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশের ইতিহাসে ক্ষমতার পরিবর্তন বারবার ঘটেছে। তবে প্রতিবারই পরিবর্তনের সুফল ভোগ করেছে কিছু নির্দিষ্ট গোষ্ঠী, অথচ সাধারণ মানুষের জীবন থেকে পরিবর্তনের প্রতিফলন প্রায় অনুপস্থিত থেকেছে। রাজনৈতিক কাঠামোর এই ধারাবাহিক ব্যর্থতা জনগণের মনে হতাশা এবং ক্ষোভের জন্ম দেয়।

২০২৪ সালের জুলাই মাসে, এই হতাশা ও ক্ষোভের প্রকাশ ঘটে এক গণজাগরণের মাধ্যমে। দেড় দশকের রাজনৈতিক সংকট এবং সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্মের স্বতঃস্ফূর্ত জাগরণ এ অভ্যুত্থানের ভিত্তি গড়ে তোলে।

ছাত্র জনতার উত্থান

জুলাইয়ের এই আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে রংপুরে। বৈষম্যের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামা ছাত্রনেতা আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। তার আত্মত্যাগ সারা দেশের তরুণদের উদ্বুদ্ধ করে। এ আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় ছিল না, বরং এটি ছাত্রদের নির্দলীয় কণ্ঠস্বরের প্রকাশ ছিল।

আবু সাঈদের আত্মত্যাগের পর, সাধারণ মানুষও তাদের সন্তানদের পাশে দাঁড়ায়। কৃষক, শ্রমিক, ছোট ব্যবসায়ীসহ সকল শ্রেণির মানুষ এই আন্দোলনে যোগ দেয়। তরুণ প্রজন্ম হয়ে ওঠে জনমানুষের প্রতিনিধিত্বকারী শক্তি।

গণমাধ্যমের ভূমিকা এবং বিভ্রান্তি

বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোর ভূমিকা এই সময়ে ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। আওয়ামী লীগের প্রভাবিত মিডিয়া আন্দোলনের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়। তারা একটি মাস্টারমাইন্ড খুঁজে বের করার চেষ্টা করে এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে দেয়।

তবে আন্দোলনটি পুরোপুরি স্বতঃস্ফূর্ত ছিল। প্রত্যেক শহীদ তরুণ নিজেই আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড। আন্দোলনের শক্তি ছিল তাদের ঐক্য, যা বৈষম্যের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ।

রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান

জুলাই অভ্যুত্থান বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতাকে আরও প্রকাশ করে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং অন্যান্য দলগুলো জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়। এই অভ্যুত্থান দলীয় রাজনীতির প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থাহীনতা স্পষ্ট করে তোলে।

তরুণদের নেতৃত্বে পরিচালিত এই আন্দোলনে পুরোনো রাজনীতির প্রতি মানুষের অনাস্থা আরও গভীর হয়। বিএনপি এবং অন্যান্য দল আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে ব্যর্থ হয়। জনগণ তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

জুলাই আন্দোলন বাংলাদেশকে বৈশ্বিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে। পশ্চিমা মিডিয়া এই আন্দোলনকে একটি অনন্য গণজাগরণ হিসেবে তুলে ধরে। “ইকোনমিস্ট” সহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রকাশনা বাংলাদেশকে বছরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে ঘোষণা করে।

এদিকে, প্রতিবেশী দেশ ভারত এই আন্দোলনের পর বাংলাদেশে তাদের প্রভাব হারায়। পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশের পরিবর্তনকে স্বাগত জানায় এবং নতুন নেতৃত্বকে সমর্থন দেয়।

মিডিয়া এবং বিভাজনের চেষ্টা

আন্দোলনের সময়, প্রভাবশালী কিছু গণমাধ্যম বিভাজনের কৌশল নিয়ে কাজ করে। তারা “ডিভাইড অ্যান্ড রুল” নীতিতে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। মিডিয়া আন্দোলনের কৃতিত্ব কে পাবে তা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করতে চায়।

তবে বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের শিকার সাধারণ মানুষ, গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবার, এবং ক্রসফায়ারে নিহতদের স্বজনরা হাসিনার পদত্যাগের দাবি জানায়। এই দাবি আন্দোলনের প্রতিটি স্তরে প্রতিফলিত হয়।

তরুণদের শক্তি এবং ভবিষ্যৎ

জুলাইয়ের অভ্যুত্থান প্রমাণ করেছে, তরুণ প্রজন্মই বাংলাদেশের পরিবর্তনের মূল চালিকাশক্তি। তারা পুরোনো রাজনৈতিক কাঠামোকে প্রত্যাখ্যান করে একটি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে।

এই আন্দোলন ছিল একটি নতুন সূচনা। তরুণদের ঐক্য এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রাম ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এটি একটি শিক্ষা এবং অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে যে, অন্যায় এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়া গেলে, কোনো শক্তিই তাদের আটকাতে পারে না।

আমার অভিজ্ঞতা

আমার প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ সফরে ২৮ অক্টোবর ২০২৩-এ বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়, নয়া পল্টনে একটি সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পাই। সেখানে আমি বাংলাদেশের বর্তমান সরকার, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসন, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা, আইনের শাসন, গণতন্ত্রের অবস্থা, এবং নিরীহ জনগণের ওপর পুলিশি নির্যাতন নিয়ে কথা বলি।

২০২৩ সালের সাধারণ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। ২৮ অক্টোবরের বিক্ষোভে পুলিশি নিপীড়নের অভিযোগ তোলে মানবাধিকার সংস্থাগুলো। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থকদের সংঘর্ষে অন্তত ১১ জন নিহত, হাজার হাজার আহত হন, এবং বিএনপির একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা গ্রেপ্তার হন। সমাবেশের আগে ১,৫০০-এরও বেশি বিরোধী সদস্যের গ্রেপ্তারের অভিযোগ তোলে বিএনপি। লাখ লাখ বিক্ষোভকারী শেখ হাসিনার পদত্যাগ দাবি করেন এবং সরকারকে আগামী জানুয়ারি নির্বাচনের আগে সংযত থাকার আহ্বান জানান।

জুলাই অভ্যুত্থান বাংলাদেশের জনগণের ঐক্য, সাহস এবং স্বতঃস্ফূর্ততার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। এটি কেবল ইতিহাসের একটি অধ্যায় নয়; বরং এটি বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি নতুন দিশা।

লেখক: ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল কমিটির সদস্য, ওয়াশিংটন ডিসি, যুক্তরাষ্ট্র

Related Articles

Back to top button