দীপু সারোয়ার, টাইমস ২৪ ডটনেট, ঢাকা: বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ব্যাপক হাড়ে প্রভাব পড়েছে জলবায়ু পরিবর্তণের। একই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দেশের বায়ু দুষণও। বায়ু দুষণ দেশগুলোর তালিকার শীর্ষ থেকে যেন সড়ছে না বাংলাদেশের নাম। জলবায়ুর প্রভাও ও বায়ু দুষণ যেন কোণ ভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না। এদিকে বিশ্বব্যাপী যেসব অসংক্রামক রোগে মানুষের সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটে তার অধিকাংশই বায়ু দূষণজনিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী বায়ু দূষণের কারণে বছরে ৪২ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যু হচ্ছে। সাম্প্রতিক গবেষণা অনুসারে, বায়ুদূষণে বাংলাদেশিদের গড় আয়ু কমেছে ৭ বছর। আর রাজধানীবাসীর গড় আয়ু কমছে ৮ বছর করে। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউটের গবেষণায় এই তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। ওই গবেষণায় বাংলাদেশকে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণের শিকার দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইপিআইসি এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স নির্ণয়ে গবেষকেরা বাতাসে পিএম২.৫ এর মাত্রা হিসাব করতে স্যাটেলাইট তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করেছেন। জানা গেছে, বাংলাদেশে ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫৪টি জেলারই বায়ুর মান আদর্শ মাত্রার চেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে। আদর্শ মাত্রার মধ্যে আছে মাত্র ১০টি জেলার বায়ুর মান। বিশেষজ্ঞদের মতে, বায়ুদূষণ একাধিক রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মত, বায়ুদূষণে পুরুষের শুক্রাণু তৈরিতে ব্যাঘাত ঘটছে এমনকি শুক্রাণুর মানও কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে নারীদের ডিম্বাণু কল্পনাতীতভাবে কমে গেছে। আবার যেসব ডিম্বাণু আছে সেগুলোও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
অপরদিকে জলবায়ুর প্রভাবে কমছে দেশের বিল এবং হাওড়ের পানি। মুক্ত জলাশয় বা বিলের বাহারি জাতের মাছ প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বর্ষাকালে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় মাছের প্রাকৃতিক উৎপাদন কমে যাচ্ছে। এর সঙ্গে চায়না দোয়ারি জালের দাপটে রেনু পোনা পর্যন্ত উজাড় হচ্ছে। এতে স্থানীয় হাট-বাজারে খুব কমই দেখা মিলছে চিরচেনা দেশি প্রজাতির মাছ। যা পাওয়া যাচ্ছে সেগুলোও আকারে খুব ছোট। পাবনার চলনবিলসহ জেলার সব বিলাঞ্চলেই একই অবস্থা। যদিও মৎস্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশি মাছ সংরক্ষণের তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন হাট-বাজারে দেশি প্রজাতির বিশেষ করে মাগুর, চাপিলা, শিং, পাবদা, টাকি, চিতল, রিটা, গুজি, আইড়, কৈ, বোয়াল, খৈলসার মতো সুস্বাদু মাছ এখন আর তেমন চোখে পড়েনা। দেশি সরপুঁটি, গজার, বাইম, টাটকিনি, তিতপুঁটি, বাঘাইড়, গুলশা, কাজলি, গাং মাগুর, চেলা, টেংরা, কানি পাবদা, পুঁটি, মলা, কালবাউশ, শোল, তারা বাইম, বেলেসহ ৪০ থেকে ৫০ জাতের মাছ প্রায় বিলুপ্তির পথে। পুকুরে চাষ করা হাইব্রিড মাছে সয়লাব বাজার। যেসব পুকুরে একসময় দেশি প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত, সেসব পুকুরে এখন বিভিন্ন প্রজাতির হাইব্রিড মাছ চাষ হচ্ছে। ফলে মিঠা পানির দেশি প্রজাতির মাছের স্থান দখল করেছে পুকুরে উৎপাদিত হাইব্রিড মাছ। বাজারগুলোতে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় চাষ করা পাঙাশ। স্থানীয়রা জানান, সাধারণত বর্ষা মৌসুমে দেশের বৃহত্তম বিল চলনবিলসহ পাবনার অন্যান্য বিল এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। ছোট-বড় সব নালা, খালও পানিতে ভরপুর থাকে। তবে এবার প্রাকৃতিক কারণে ভরা বর্ষা ঋতুতেও যথেষ্ট পরিমাণ বৃষ্টি হয়নি। ফলে বিলগুলোতে পর্যাপ্ত পানি আসেনি। যার প্রভাব পড়েছে বিলের মাছের ওপর। ক্রেতারা হন্য হয়ে খুঁজেও চাহিদামতো দেশি প্রজাতির মাছ পাচ্ছেন না। হাইব্রিড মাছেই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে তাদের। বিলের ওপর নির্ভরশীল মানুষের জীবন-জীবিকাতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। পাবনার বেশ কয়েকজন মৎস্যজীবী জানান, বিলে এবার গত বছরের তুলনায় এক তৃতীয়াংশ পানি কম। যার ফলে তারা খুব কম মাছ পাচ্ছেন। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, আর দুই মাস পরে বিলে হয়তো মাছই পাওয়া যাবে না। এত কম পানি থাকায় মাছের উৎপাদনও কম হয়েছে। তারা বিলে খুবই কম মাছ পাচ্ছেন। পাবনা জেলার মৎস্য বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, চলনবিল অধ্যুষিত পাবনা জেলা থেকে অনেক প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিলুপ্তির পথে রয়েছে ৩০ প্রজাতির মাছ। এক সময় একশো প্রজাতির ওপরে মাছ পাওয়া যেত জেলায়। পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল এবং পরিবেশ বিভাগের চেয়ারম্যান ড. রাহিদুল ইসলাম বলেন, গত ৮০ বছরের মধ্যে পাবনায় এবার সবচেয়ে কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। প্রাকৃতিক কারণে পানি কম হওয়ায় খালে-বিলে এবার মাছ কম। মুক্ত জলাশয়ে মাছ কমার জন্য মানবসৃষ্ট কিছু কারণও রয়েছে। এখন এলাকার ছোট-ছোট খাল-বিলে বাঁধ দিয়ে বা ঘের বানিয়ে অনেকে মাছ চাষ করেন। সেটা লিজ নিয়ে হোক বা জবর দখল করে হোক। এতে মুক্ত জলাশয়কে আবদ্ধ করে ফেলা হচ্ছে।
এদিকে আবারও বায়ুদূষণের শীর্ষ অবস্থানে উঠে এসেছে ঢাকা। গত মঙ্গলবার দুপুর ১টা নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের বায়ুমান পর্যবেক্ষণ প্রতিষ্ঠান এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের (একিউআই) মাত্রা অনুযায়ী, ঢাকার অবস্থান শীর্ষ অবস্থানে চলে এসেছে। এতে বায়ুদূষণের মাত্রা ছিল ২৪৬। বিশেষজ্ঞদের মতে এই মাত্রাকে বলা হয় খুবই অস্বাস্থ্যকর। একিউআই অনুযায়ী, ঢাকার পরে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তানের লাহোর, মাত্রা ২৩০। আর তৃতীয় অবস্থানে আছে দিল্লি, মাত্রা ১৩৪। বায়ু বিশেষজ্ঞরা বলেন, ১০১ থেকে ২০০-এর মধ্যে মাত্রা থাকলে তা সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য ‘অস্বাস্থ্যকর’ বলে চিহ্নিত করা হয়। শূন্য থেকে ৫০ পর্যন্ত ‘ভালো’। ৫১ থেকে ১০০ ‘মোটামুটি’, ১০১ থেকে ১৫০ পর্যন্ত ‘সতর্কতামূলক’, ১৫১ থেকে ২০০ পর্যন্ত ‘অস্বাস্থ্যকর’, ২০১ থেকে ৩০০-এর মধ্যে থাকা একিউআই মাত্রাকে ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ বলা হয়। আর ৩০১-এর বেশি স্কোরকে ‘বিপজ্জনক’ বা দুর্যোগপূর্ণ বলা হয়। এ বিষয়ে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, শুষ্ক মৌসুমের সময় বায়ুদূষণ বেড়ে যায় ঢাকাসহ যেকোনও শহর এলাকায়। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার ঢাকা শীর্ষ অবস্থানে উঠে আসার মাত্রা কমই ছিল। গত কয়েক বছর প্রায় প্রতিদিন শীর্ষ অবস্থানে ছিল ঢাকা। এবার বেশ দেরিতেই শীর্ষ অবস্থানে আসছে। এর মূল কারণ হিসেবে তিনি বলেন, মেট্রোরেলসহ অন্যান্য অনেক কন্সট্রাকশন কাজ প্রায় শেষ হয়ে গেছে। ঢাকার দূষণের বড় কারণগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে কন্সট্রাকশন।