topআন্তর্জাতিক

সহিংস বিক্ষোভে উত্তাল পাকিস্তান

টাইমস ২৪ ডটনেট: পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) চেয়ারম্যান ইমরান খানকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে দেশটিতে সহিংস ও বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে ইমরানের সমর্থকদের সংঘর্ষে ৯ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ২৯০ জন। গ্রেফতার করা হয়েছে ১৯০০ জন বিক্ষোভকারীকে। ৭৫ বছরে শত্রুরা যা করতে পারেনি, আন্দোলন-বিক্ষোভের নামে একটি দলের বিক্ষোভকারীরা সেটিই করেছে বলে জানিয়েছে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী। পাকিস্তানে সব দলকে সহিংসতা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জাতিসংঘের।
জানা গেছে, পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) চেয়ারম্যান ইমরান খানকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে দেশটিতে বিক্ষোভ ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার পরমাণু শক্তিধর এই দেশটি জুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার পর সহিংসতায় এখন পর্যন্ত ৮ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া বিক্ষোভ দমাতে পাকিস্তানের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গণগ্রেফতার শুরু করেছে এবং এখন পর্যন্ত দেশটিতে প্রায় এক হাজার ৯শ মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
গত বুধবার থেকে পুলিশ ও পিটিআই সমর্থকরা দিনভর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পরে। এ সময় পুলিশ স্টেশনসহ বেশ কয়েকটি সরকারি স্থাপনায় ভাঙচুর চালানো হয়। গভীর রাতে কেন্দ্রীয় মহাসচিব আসাদ উমরকে হেফাজতে নেওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর পিটিআইর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ফাওয়াদ চৌধুরীকেও গ্রেফতার করা হয়। ক্রমবর্ধমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য পাঞ্জাব, খাইবার পাখতুনখোয়া ও ইসলামাবাদে সামরিক বাহিনীকে ডেকেছে সরকার। লাহোরে কর্পস কমান্ডারের বাসভবনে বিক্ষোভকারীদের হামলা এবং রাওয়ালপিন্ডিতে জিএইচকিউর একটি গেট ভেঙে ফেলার একদিন পর সামরিক বাহিনী মোতায়েনের ঘটনা ঘটে। সেনাবাহিনীর সম্পত্তির ওপর হামলার প্রতিক্রিয়ায় দেওয়া বিবৃতিতে বাহিনীটির মুখপাত্র এসব ঘটনাকে রাজনৈতিক গোষ্ঠীর ‘ভণ্ডামি’ বলে অভিহিত করেছে। তারা বলেছে, জনসাধারণকে নিজেদের স্বার্থের জন্য ব্যবহার করছে রাজনীতিকরা। তা সত্ত্বেও ইসলামাবাদের পুলিশ অফিস, লাহোরের একটি পুলিশ স্টেশন, পেশোয়ারে রেডিও পাকিস্তানের ভবন এবং লোয়ার দিরের চকদারায় স্কাউটস ফোর্টে জনতা আগুন ধরিয়ে দেয়। ইসলামাবাদ ও রাওয়ালপিন্ডিতে দিনভর বিক্ষোভ চলতে থাকে। ফেডারেল রাজধানী এবং রাওয়ালপিন্ডির বিভিন্ন স্থানে দলীয় প্রধানের গ্রেফতারের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেন অনেকে। ইসলামাবাদে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে ১৭ জনেরও বেশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য আহত হয়েছেন। বিক্ষোভকারীরা এসপি শিল্প এলাকার অফিসে আগুন দেওয়ায় পাশাপাশি রমনা থানায় হামলা চালিয়েছে। বিক্ষোভকারীরা তারনোলে একটি রেললাইনও উপড়ে ফেলে। জবাবে ইসলামাবাদ পুলিশ পিটিআই সমর্থকদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা করেছে। ফেডারেল রাজধানীতে আটক করা হয়েছে দুই শতাধিক দলীয় সমর্থককে। রাওয়ালপিন্ডিতে পুলিশ ১৫০০টিরও বেশি মামলা করেছে পিটিআই সমর্থকদের বিরুদ্ধে। সেখান থেকে আটক করা হয়েছে ১৯০ জনেরও বেশি কর্মীকে। সন্ত্রাসবিরোধী আদালতে হাজির করার পর আদিয়ালা জেলে পাঠানো হয়েছে ৫২ জনকে। লাহোরে বিক্ষোভকারীরা শাদমান থানা ঘেরাও করে থানার আসবাবপত্র এবং সরকারি গাড়ি ভাঙচুর করে। পুলিশ ও পিটিআই কর্মীদের মধ্যে সহিংস সংঘর্ষের আলোকে পাঞ্জাব, বিশেষ করে লাহোরে পরিস্থিতি ছিল উত্তেজনাপূর্ণ। পিটিআই সমর্থকদের একটি দল গভর্নর হাউজ এবং সিএম সেক্রেটারিয়েটে তাণ্ডব চালানোর চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের পিছনে ঠেলে দেয়। পুলিশ জানায়, অন্তত ২৫টি সরকারি গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ১৪টি সরকারি ভবনে হামলা হয়েছে।
এদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর দলের বিরুদ্ধে ক্র্যাকডাউনে প্রদেশজুড়ে এক হাজার ৩৮০ জনেরও বেশি বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে দাবি করেছে পুলিশ। লাহোরের ডিআইজি অপারেশন নাসির রিজভি, তিন জন এসপি এবং কয়েক ডজন এসএইচও-সহ অন্তত ১৫০ পুলিশ পিটিআই কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে আহত হয়েছেন। গুজরানওয়ালায় অজ্ঞাত ব্যক্তিরা বিক্ষোভে গুলি চালাতে শুরু করলে একজন নিহত হন, আহত হন বেশ কয়েকজন। লাহোরে ইমরান খানসহ পিটিআইর শীর্ষ নেতৃত্ব এবং গুলবার্গ থানায় ১২০০ জনেরও বেশি মানুষের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেছে পুলিশ। আসকারি টাওয়ারে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় মামলাটি নথিভুক্ত করা হয়েছিল। ওই ঘটনায় একজনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। খাইবার পাখতুনখোয়ায় প্রতিবাদকারীরা কেপি অ্যাসেম্বলির কাছে রেডিও পাকিস্তান এবং অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস অব পাকিস্তানের অফিস ভবনটি পুড়িয়ে দেয়। পেশোয়ারে পুলিশ এবং বিক্ষোভকারীদের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়েছে। সহিংসতায় সেখানে কমপক্ষে ৭ জন নিহত এবং ১২২ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন। সহিংস বিক্ষোভের ঘটনায় পুলিশ প্রদেশজুড়ে ২৭৪ জনকে গ্রেফতার করেছে। প্রাদেশিক রাজধানীতে সংঘর্ষে তিন জন নিহত এবং ৮১ জন আহত হয়েছেন। কোহাটে নিহত হয়েছেন আরও দুজন। চকদারায় মঙ্গলবার গভীর রাতে বিক্ষোভকারীরা এফসি দুর্গে হামলা চালালে সেখানে এক বিক্ষোভকারী নিহত হন, আহত হন আরও ১১ জন। সিন্ধু তুলনামূলকভাবে শান্তিপূর্ণ ছিল। কারণ, করাচি পুলিশ পিটিআইর বিক্ষোভকে ব্যর্থ করে দেয়। মিরপুর খাসে একাধিক গ্রেফতার ছাড়াও প্রাদেশিক রাজধানীতে অন্তত ২০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বেলুচিস্তানে সহিংস বিক্ষোভের একদিন পর পুলিশ কোয়েটা এবং চামানে ৬০ জনের বেশি স্থানীয় নেতা ও দলীয় কর্মীকে গ্রেফতার করেছে। পিটিআইর প্রাদেশিক নেতৃত্ব এবং গুরুত্বপূর্ণ নেতারা গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপনে চলে গেছেন। পিটিআই কাসিম সুরির বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাকে না পেয়ে তার ভাই বিলাল সুরিকে আটক করেছে পুলিশ। সাবেক পিটিআই গভর্নর জহুর আগার বাড়িতেও পুলিশ অভিযান চালিয়েছে। তাকে না পেয়ে তার দুই ভাইকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
এর আগে মঙ্গলবার ইসলামাবাদ হাইকোর্টের বাইরে থেকে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে গ্রেফতার করা হয়। আল-কাদির ট্রাস্ট মামলায় ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টেবিলিটি ব্যুরোর (এনএবি) ওয়ারেন্টে পাকিস্তানের আধাসামরিক বাহিনী রেঞ্জার্স তাকে গ্রেফতার করে। পাকিস্তানের দুর্নীতি বিরোধী সংস্থার এই পদক্ষেপে দেশজুড়ে সহিংস বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শেহবাজ শরিফের সরকার খাইবার পাখতুনখাওয়া, পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান এবং ইসলামাবাদসহ দেশের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য সেনাবাহিনীকে ডেকেছে।
জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া এক টেলিভিশন ভাষণে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, সহিংস বিক্ষোভ সহ্য করা হবে না। তিনি বলেন, ‘যে অপরাধীরা আইন নিজের হাতে তুলে নেয় তাদেরকে কঠোরভাবে মোকাবিলা করা হবে।’ এছাড়া গ্রেফতারের পর ইমরান খানের সমর্থকরা রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের সেনা সদর দপ্তর এবং লাহোরে সেনাবাহিনীর কর্পস কমান্ডারের বাসভবনে হামলা চালায়। আর তাই পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ৯ মে-কে ‘অন্ধকার দিন’ হিসেবে অভিহিত করেছে এবং রাষ্ট্রের সম্পত্তিতে আবারও হামলা হলে প্রতিবাদকারীদের ‘চরম জবাব দেওয়া’ হবে বলে সতর্ক করেছে। ইসলামাবাদে পুলিশ শিপিং কন্টেনার ব্যবহার করে রাস্তা আটকানোর চেষ্টা করেছে।
২০১৮ সালে ক্ষমতায় এসেছিলেন ইমরান খান। তবে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিজের মেয়াদের চার বছরেরও কম সময়ের মধ্যে গত বছরের এপ্রিলে পার্লামেন্ট আস্থা ভোটের মাধ্যমে ইমরানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। এরপর থেকে তিনি আগাম নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছেন। তবে ইমরানের গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানে বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট আরও চরম আকার ধারণ করেছে।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের ডেপুটি মুখপাত্র ফারহান হক এক বিবৃতিতে বলেছেন, পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে গ্রেফতারের পর সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সব দলকে সহিংসতা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান । একইসঙ্গে শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকারকে সম্মান করার প্রয়োজনীয়তার ওপরও জোর দিয়েছেন তিনি। বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে আনীত কার্যক্রমে যথাযথ প্রক্রিয়া এবং আইনের শাসনকে সম্মান করার জন্য পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস।

 

Related Articles

Back to top button