topসারাদেশ

টানা বৃষ্টিতে জনজীবন বিপর্যস্ত

টাইমস ২৪ ডটনেট: সাগরে সৃষ্টি হওয়া লঘুচাপ এবং সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে রাজধানীসহ সারাদেশে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুর থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টি থামার যেন কোনও নামই নেই। অফিস ছুটির পর যানবাহন সংকট, অতিরিক্ত ভাড়া, জলাবদ্ধতা সেই সঙ্গে যানজটের মধ্যে পড়েছে নগরবাসী। ঢাকার অলিগলিতে পানি জমে গেছে। বিশেষ করে ঢাকার বাইরে ফেনী, নোয়াখালী, কক্সবাজার, বরিশাল, পটুয়াখালী, ঝিনাইদহ ও খুলনায় ভারী বৃষ্টিতে ডুবে গেছে সড়ক, দোকানপাট ও বহু গ্রাম। গত সোমবার থেকে টানা বৃষ্টিতেই পানির নিচে তলিয়ে গেল ফেনী শহরের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। কাঁচা ও আধা-পাকা সড়কগুলো পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন পথচারী ও যানবাহনের চালকরা। কোথাও হাঁটু সমান, কোথাও আবার কোমরপানি জমে জনজীবনে সৃষ্টি হয়েছে ভয়াবহ স্থবিরতা। ফেনীতে গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৪০৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। জেলায় বিগত কয়েক বছরে এটি সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত। টানা বর্ষণ ও ভারতীয় উজানের পানিতে মুহুরী ও সিলোনিয়া নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
জানা গেছে, টানা বর্ষণে ফেনী শহরের ডাক্তারপাড়া, শহীদ শহীদুল্লাহ কায়সার সড়ক, একাডেমি, পুরাতন রেজিস্ট্রি অফিস, শাহীন একাডেমি এলাকা, পাঠানবাড়ী, নাজির রোড, মিজান রোড, সদর হাসপাতাল মোড় ও পেট্রোবাংলাসহ বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। পানিতে তলিয়ে গেছে এসব এলাকার নিচু সড়কগুলো। দোকানপাটে পানি ঢুকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মালপত্র।
স্থানীয় বাসিন্দা মাহবুবুর রহমান বলেন, প্রতি বর্ষায় একই দৃশ্য। ড্রেনেজ ব্যবস্থা বছরের পর বছর অবহেলায় পড়ে আছে, কোনও স্থায়ী সমাধান নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, অপরিকল্পিত নগর উন্নয়ন, অপর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এই তিনটি কারণেই ফেনীর জলাবদ্ধতা ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। ফেনী পৌরসভার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, নতুন কিছু ড্রেন নির্মাণ করা হলেও পুরাতন ড্রেনগুলোর কোনও সংস্কার হয়নি বহু বছর ধরে। নালা-নর্দমা পরিষ্কারের নিয়মিত কার্যক্রমও অনুপস্থিত। জলাবদ্ধতার কারণে শহরের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান ও পরীক্ষার কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়। বাজারের দোকানপাটে পানি ঢুকে পণ্য নষ্ট হওয়ায় ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। দোকানি সাইফুল বলেন, দুই ঘণ্টার বৃষ্টিতে পুরো দোকান পানিতে তলিয়ে গেলো। কেউ দেখার নেই, সাহায্য তো দূরের কথা।
ফেনী পৌর প্রশাসক ও স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক গোলাম মো. বাতেন বলেন, অতিবৃষ্টি ও অপর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে শহরে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টি বন্ধ হলে পানি নেমে যাবে। ইতোমধ্যে পৌরসভার ৭টি টিম কাজ শুরু করেছে।
ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আবুল কাশেম বলেন, গতকাল বিকেল ৪টার দিকে মুহুরী নদীর পানি বিপৎসীমার ৬৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অস্বাভাবিক পানি বৃদ্ধির ফলে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধের বিষয়ে সকলকে সতর্ক করা হয়েছে
ফেনী আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মজিবুর রহমান বলেন, জেলায় টানা দুই দিন ধরে মাঝারি ও ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। গতকাল মঙ্গলবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৪০৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। যা বিগত কয়েক বছরে সর্বোচ্চ। আগামী ২-৩ দিন জেলাজুড়ে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
এদিকে নোয়াখালীতে টানা বর্ষণে নোয়াখালী সদর, সেনবাগ, বেগমগঞ্জ, চাটখিল, কোম্পানীগঞ্জ ও সুবর্ণচরের বিভিন্ন অঞ্চলের নিচু এলাকায় বৃষ্টির পানি জমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে জেলা শহর মাইজদীর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, মৎস্য অফিস, জেলা খানা সড়ক, পাঁচ রাস্তার মোড়, পৌর বাজারসহ বিভিন্ন এলাকার রাস্তাগুলো তলিয়ে গেছে। অনেক বাসাবাড়িতে পানি ঢুকে পড়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অফিসগামী লোকজনকেও ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। গতকাল সকালে স্কুলে যাওয়ার পথে একাধিক শিশু জলকাদায় পড়ে আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। বৃষ্টির কারণে বন্ধ হয়ে গেছে অনেক দোকানপাটও।
জেলা শহরের বাসিন্দা আবু সাইদ নোমান বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই জলাবদ্ধতা নিরসনে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি পৌরসভা বা উপজেলা প্রশাসন। সঠিক ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় প্রতি বছরই সামান্য বৃষ্টিতেই এমন দুর্ভোগ পোহাতে হয়। বৃষ্টিতো দুইদিন, কিন্তু গত এক বছরেও প্রশাসনের পরিকল্পিত পদক্ষেপ নেই।
মাইজদীর আরেক বাসিন্দা আবু তাহের বলেন, প্রায় এক ঘণ্টা অপেক্ষা করেছি, হালকা বৃষ্টিতেই নোয়াখালী পৌরসভা এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। রিকশা-অটোরিকশা কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। রাস্তায় পানি জমে থাকায় কেউই চলাচল করতে চায় না। বাসা থেকে অফিসে পৌঁছাতে হিমশিম খেতে হয়েছে।
সুবর্ণচরের বাসিন্দা মাইন উদ্দিন বলেন, গতবারের মতো এবারও নোয়াখালীর সেইম অবস্থা বৃষ্টির পানির, এর কারণ কাল খনন না করা ও খালে বাঁধ দেওয়া। নোয়াখালীতে নেতার অভাব নাই, কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করার ইচ্ছে আগেও ছিল না, এখনো নাই। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে জলাবদ্ধতা নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হোক। তা না হলে প্রতি বছর বর্ষায় একই দুর্ভোগ পোহাতে হবে সাধারণ মানুষকে।
জেলা আবহাওয়া কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, মঙ্গলবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ১৪০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে আরও ভারি বৃষ্টি হতে পারে। বৃষ্টিপাত আগামী কয়েকদিন থাকতে পারে। ফলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে বলে শঙ্কা করছি।
নোয়াখালী পৌরসভার দায়িত্বে থাকা পৌর প্রশাসক জালাল উদ্দীন বলেন, টানা বৃষ্টির কারণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। দ্রুত পানি নিষ্কাশনের জন্য কাজ করা হচ্ছে।
জেলা প্রশাসক খন্দকার ইসতিয়াক আহমেদ বলেন, বিভিন্ন এলাকা আমি ঘুরে দেখেছি। প্রধান সড়কগুলোতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়নি। তবে পাশের কিছু সড়ক পানিতে ডুবে গেছে। আমরা জলাবদ্ধতা নিয়ে একাধিকবার বসেছি। আমরা বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখছি। জনগণের সহযোগিতাও প্রয়োজন।
এদিকে চার দিনের অবিরাম বর্ষণে নাকাল হয়ে পড়েছে বরিশালবাসী। ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। কর্মজীবী, শিক্ষার্থী আর নিম্নআয়ের মানুষেরা পড়েছেন চরম বিপাকে। বৃষ্টিতে অনেকেই ঘরবন্দি সময় কাটাচ্ছেন। তবে বৃষ্টিতে খুশি হয়েছেন চাষিরা। ক্ষেতে ধানের বীজ বপনে উপযুক্ত সময়ে বৃষ্টিপাত মাটিকে উর্বর করবে বলে জানান তারা। মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় গত শনিবার থেকে মাঝারি পরিমাণে বৃষ্টি হতে শুরু করে। এখনো বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে।
বরিশাল নগরীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলো ঘুরে দেখা গেছে, টানা বৃষ্টিতে ড্রেন, নালা ও ডোবা পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। মৃতপ্রায় খালগুলোতে পানি আটকে ময়লা আবর্জনা পথে উঠে এসেছে। অনেক স্থানে জলাবদ্ধতারও তৈরি হয়েছে।
রূপাতলী হাউজিংয়ের বাসিন্দা আরাফাত হোসেন বলেন, সারাক্ষণ টিপ টিপ বৃষ্টিতে বাইরে বেড় হওয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাস্তাঘাটে চলাচল প্রায় অসম্ভব। ড্রেনের ময়লা রাস্তায় উঠে চলাচলে আরও অসুবিধা সৃষ্টি করছে। তিনি বলেন, রূপাতলী বাজারের মুখে পানি জমেছে। গোল চত্বরের পূর্ব পাশে পানি জমেছে।
সিটি করপোরেশনের ২নং ওয়ার্ড কাউনিয়া এলাকার বাসিন্দা সাইদুল ইসলাম বলেন, টানা বৃষ্টিতে প্রতিটি গলিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। সারা বছর ড্রেন পরিষ্কার করা হয়নি। শুধু বড় বড় কয়েকটি ড্রেন পরিষ্কার করেছে। তাতে পুরো শহরের সমস্যার সমাধান হবে না। ঘিঞ্জি যেসব এলাকা সেদিকে অতি গুরুত্ব না দিলে আমাদের ভোগান্তি কমবে না। তবে টানা বৃষ্টি চাষাবাদের জন্য উপকারী উল্লেখ করে বাবুগঞ্জ উপজেলার বাহেরচরের বাসিন্দা সোহরাফ হোসেন বলেন, ধানের বীজতলার জন্য এই বৃষ্টি খুবই উপকারী। অনবরত বৃষ্টি হলে ক্ষেত নরম হবে, আমাদের চাষাবাদে সুবিধা হবে। বৃষ্টিতে মাটির উর্বরতাও বাড়ে।
বরিশাল সদর উপজেলার সাপানিয়ার চাষি মিজানুর রহমান বলেন, গরু-ছাগল চড়াতে কিছুটা অসুবিধা হয়। বাইরে খাবার খেতে যেতে পারে না। তবে চাষাবাদের জন্য এই বৃষ্টি খুব ভালো। কৃষকরা এমন বৃষ্টিতে খুশি।
বরিশাল আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের অফিসার্স ইনচার্জ আনিসুর রহমান বলেন, সোমবার বিকেল ৩টা থেকে মঙ্গলবার বিকেল ৩টা অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টায় ৮৩ দশমিক ১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এটি মৌসুমি বৃষ্টিপাত। বর্ষায় সাধারণত এভাবেই বৃষ্টি হয়। তিনি বলেন, আবহাওয়ার পূর্বাভাস পর্যালোচনা করে বলা যায় আগামী দুই-তিন দিন এভাবে বৃষ্টি অব্যাহত থেকে কিছুটা কমতে পারে। আবহাওয়ার এই পরিস্থিতিতে সমুদ্র বন্দরকে তিন নম্বর ও নদী বন্দরকে এক নম্বর সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
পটুয়াখালীতে গত ২৪ ঘণ্টায় রেকর্ড পরিমাণ ২১৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে, যা চলতি বছরের সর্বোচ্চ। টানা বর্ষণে পটুয়াখালী পৌর শহরসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। দুর্ভোগে পড়েছেন হাজারো মানুষ। গত সোমবার দুপুরে পটুয়াখালী আবহাওয়া কার্যালয়ের উচ্চ পর্যবেক্ষক মাহবুবা সূখী এই তথ্য নিশ্চিত করেন।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস অনুযায়ী, খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলের উপর দিয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে ঘণ্টায় ৪৫-৬০ কিলোমিটার বেগে অস্থায়ীভাবে দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টি ও বজ্রবৃষ্টি হতে পারে। এজন্য মঙ্গলবার সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ নদীবন্দরগুলোকে ১ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
পটুয়াখালী আবহাওয়া কার্যালয়ের উচ্চ পর্যবেক্ষক মাহবুবা সূখী বলেন, গত রোববার বিকেল থেকে বৃষ্টিপাত শুরু হলেও ৭ জুলাই রাত থেকে শুরু হয় প্রবল বৃষ্টি, যা টানা ১৬ ঘণ্টা অব্যাহত থাকে। গতকাল জেলায় সর্বোনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ২৫.১, তবে বৃষ্টির কারণে তাপমাত্রা আরও কমতে পারে। আগামী পাঁচ দিন এই বৃষ্টিপাতের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকতে পারে।
পটুয়াখালী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিব বলেন, আমরা প্রতিটি উপজেলার খোঁজখবর রাখছি, এখন পর্যন্ত কোথাও বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্তের তথ্য পাইনি। বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা মেরামতে আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করব। বর্তমানে আমাদের কাছে ৪২০০ জিও ব্যাগ মজুদ আছে। এ ছাড়া স্বাভাবিকের থেকে প্রায় দেড় মিটার পানির উচ্চতা বেড়েছে, তাই বেড়িবাঁধের বাইরে যারা ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছিলেন তাদেরকে বেড়িবাঁধের ভেতরে আসার জন্য সচেতন করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, পরিস্থিতি নজরে রাখা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসন প্রস্তুত রয়েছে।
ঝিনাইদহে আষাঢ়ের প্রথম থেকে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত টানা বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে ৬টি উপজেলার মানুষের জীবন। এতে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে চরমে। শহরে সীমিত আকারে যানবাহন চলাচল করলেও মানুষের উপস্থিতি খুবই কম। এতে করে নিম্ন আয়ের মানুষ পড়েছেন বিপাকে।
এ ব্যাপারে ঝিনাইদহ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ ষষ্টি চন্দ্র রায় জানান, বর্ষাকালে তো বৃষ্টি হবেই। বৃষ্টির এই পানি স্বল্প সময় জমে থাকবে, তাই আমন চাষে তেমন কোনো ক্ষতির সম্ভবনা নেই।
অপরদিকে সপ্তাহব্যাপী টানা ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের পানি প্রবেশ করায় কক্সবাজারের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ৮০টিরও বেশি গ্রামের হাজারো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ইমরান হোসন সজিব বলছেন, টানা বৃষ্টিতে পুরো জেলার আনুমানিক ৮০টি গ্রামের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। মাতামুহুরী নদীর পানি উপচে পড়ায় চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলায় দুই হাজারের এর বেশি ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়েছে। এই এসব উপজেলায় অন্তত দশ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এ তথ্য জানিয়ে কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাঁকখালী ও মাতামুহুরী নদীর পানি বিপৎসীমার কাছাকাছি উঠে এসেছে। ফলে নদীর পাড়ের অনেক এলাকা প্লাবিত হয়েছে। তিনি বলেন, মহেশখালী ও কুতুবদিয়া উপজেলার কিছু বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং সেগুলোর সংস্কার কাজ চলছে।
কক্সবাজার আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ এ বি হান্নান বলছেন, জুলাই মাসের প্রথম সাত দিনে জেলায় ৬৯৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এটি ভারি বৃষ্টিপাত হিসেবে ধরা হয়, কারণ কক্সবাজারে প্রতিদিন গড়ে ৯৯ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। হান্নান বলেন, জুলাই বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের মাস। এ মাসে গড়ে ২২ দিন বৃষ্টি হয়। চলমান এই বৃষ্টির প্রবণতা ৯ জুলাই থেকে কিছুটা কমবে। এরপর ২-৩ দিনের বিরতি দিয়ে আবার বাড়তে পারে। গত বছর কক্সবাজারে জুলাই মাসে ১ হাজার ৭০৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছিল। চলতি মাসে সেই রেকর্ড ভাঙতে পারে। জেলার ছয়টি দুর্যোগপ্রবণ উপজেলার মধ্যে টেকনাফের পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মতে, উপজেলার প্রায় বহু গ্রাম প্লাবিত হয়েছে এবং অন্তত ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নে ৮টি, হ্নীলা ইউনিয়নে ১২টি, টেকনাফ পৌরসভায় ৭টি, টেকনাফ সদর ইউনিয়নে ৬টি, সাবরাং ইউনিয়নে ৭টি এবং বাহারছড়া ইউনিয়নে ১০টি গ্রাম পানির নিচে চলে গেছে।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহেসান উদ্দিন বলেন, ভারি বর্ষণের কারণে বেশ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। আমরা স্থানীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি।
টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী বলেন, তার ইউনিয়নের ১২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে চার হাজারের বেশি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। গ্রামগুলোর রাস্তাঘাট পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
টেকনাফ সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান বলেন, মহেশখালিয়াপাড়া, নতুন পল্লানপাড়া, তুলাতুলি, লেঙ্গুরবিল, খোনকারপাড়া, মাঠপাড়া ও রাজারছড়াসহ ছয়টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। সেন্টমার্টিন দ্বীপেও জোয়ার ও সাগর উত্তাল থাকায় কয়েকটি গ্রামে সাগরের পানি ঢুকে পড়েছে। টানা বৃষ্টির কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। কারণ দ্বীপে দ্রুত পানি অপসারণের মতো ড্রেনেজ ব্যবস্থা নেই বলে জানান সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দা তৈয়ব উল্লাহ। উখিয়া উপজেলায় পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত হয়েছে অন্তত ১৬টি গ্রাম। এতে প্রায় ১০ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কামরুল হোসেন চৌধুরী। তিনি বলেন, টানা বৃষ্টিতে হঠাৎ করে পানি নেমে আসায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ৫-৬ ঘণ্টার বিরতি পেলে পানি নেমে যেতে পারে। তবে উপজেলার বিভিন্ন সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
উখিয়ার রাজাপালং ইউপির ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য হেলাল উদ্দিন বলেছেন, ৩, ৭ রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও হঠাৎ বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এছাড়াও ১২ ও ২২ নম্বর ক্যাম্পেও জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। এতে প্রায় ১৫ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় এনজিওগুলো কাজ করছে বলে জানান তিনি। রামু উপজেলার ফতেখাঁরকুল, রাজারকুল ও শ্রীকুল ইউনিয়নের ১০ থেকে ১২টি গ্রাম এবং সদর উপজেলার ঝিলংজা ইউনিয়নের বাংলাবাজার ও খরুলিয়া এলাকার প্রায় এক হাজার বাড়িঘর বাঁকখালী নদীর পানি বেড়ে প্লাবিত হয়েছে বলে ইউএনও রাশিদুল ইসলাম জানিয়েছেন।
টানা ভারী বৃষ্টিতে খুলনা শহরের বেশির ভাগ সড়ক ও নিম্নাঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেছে। বাসাবাড়ি ও দোকানপাটে পানি ঢুকে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন নগরবাসী। এমন পরিস্থিতিতে জলাবদ্ধতা নিরসনে সিটি করপোরেশনের নেওয়া প্রায় ৮২৪ কোটি টাকার প্রকল্পের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
খুলনা আবহাওয়া কার্যালয়ের সহকারী আবহাওয়াবিদ মিজানুর রহমান বলেন, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে গত সোমবার বিকেল চারটা থেকে খুলনায় ভারী বর্ষণ শুরু হয়। মাত্র দুই ঘণ্টায় ৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। গতকাল মঙ্গলবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি হয়েছে ৮২ মিলিমিটার। আজ বুধবার থেকে বৃষ্টিপাত কিছুটা কমতে পারে।
খুলনা নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব বাবুল হাওলাদার বলেন, ভৈরব ও রূপসা নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি নদীতে নামতে পারছে না। উল্টো জোয়ারের সময় পানি শহরের দিকে ঠেলে আসছে। বিল পাবলা ও রায়ের মহলের মতো বড় জলাধার ভরাট হওয়ায় পানি জমার কোনো জায়গা নেই।
এছাড়াও টানা বৃষ্টি ও পদ্মা নদীর প্রচণ্ড স্রোতের কারণে শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার পদ্মা সেতু প্রকল্প রক্ষা বাঁধে নতুন করে ভয়াবহ ভাঙন দেখা দিয়েছে। গত সোমবার বিকেলেই মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে অন্তত পাঁচটি বসতবাড়ি ও পাঁচটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। নদীর তীব্র ভাঙনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে এলাকাবাসীর মাঝে, সরিয়ে নেওয়া হয়েছে আরও ১০টি দোকান।
স্থানীয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, ২০১০-১১ অর্থবছরে পদ্মা সেতু থেকে মাঝির ঘাট হয়ে পূর্ব নাওডোবা আলমখার কান্দি জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত দুই কিলোমিটার পদ্মা সেতু প্রকল্পের কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। এতে ব্যয় হয় ১১০ কোটি টাকা। গত বছরের ৩ নভেম্বর থেকে বাঁধের নাওডোবা ইউনিয়নের মাঝির ঘাট এলাকার ধস শুরু হয়। ১৬ নভেম্বর বিকেল পর্যন্ত বাঁধটির প্রায় ১০০ মিটার ধসে পড়ে নদীতে। এতে কংক্রিটের সিসি ব্লকগুলো তলিয়ে যায় পানিতে। এছাড়া আশপাশে দেখা দেয় ফাটল। পরে বাঁধটির সংস্কারে দায়িত্ব দেওয়া হয় পানি উন্নয়ন বোর্ডকে। গত বছর ওই বাঁধের যে ১০০ মিটার অংশ বিলীন হয়েছিল তা দুই কোটি ৮৭ লাখ টাকা ব্যয়ে ওই স্থানে বালুভর্তি জিওব্যাগ ও সিসি ব্লক ফেলার কাজ শুরু করা হয়। এদিকে ঈদের দিন ভোররাতে সংস্কার করা বাঁধের ১০০ মিটার অংশসহ পাশের আরও একটি স্থানে ভাঙন শুরু হয়। একদিনের মধ্যে বাঁধের আড়াইশ মিটার অংশ নদীতে তলিয়ে যায়। এরপর ক্ষতিগ্রস্ত স্থানে নতুন করে জিওব্যাগ ডাম্পি করে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
শাহিন মাঝি নামের এক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, গতকাল মঙ্গলবার বিকেল ৪টার দিকে হঠাৎ ভাঙনের খবর পাই। কিছু বুঝে উঠার আগেই চোখের সামনে কয়েকটি বাড়ি নদীতে তলিয়ে যায়। মানুষ দৌড়ে দৌড়ে মালামাল সরিয়ে নিচ্ছে।
বাজারের ব্যবসায়ী সাইদুল ইসলাম জানান, আকস্মিক ভাঙনে আমরা শ্রমিক পাচ্ছি না। পরিবার-পরিজন দিয়েই দোকানের মালামাল সরাতে হচ্ছে। অনেক ক্ষতির মুখে পড়েছি। আমরা দ্রুত ভাঙন রোধের দাবি জানাই।

Related Articles

Back to top button