মতামত

সন্তানের স্থায়িত্ব সিআইডি মা

সৈয়দা রাশিদা বারী:অন্তত প্রায় ৩০ বছর আগে হবে। একজন পুত্রের মাকে তদন্ত করতে গিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম ‘আপনি তো ছেলের মা, কি করে আপনার ছেলে একটি মেয়েকে বের করে নিয়ে আসলো আর আপনি তাদের আশ্রয় দিতে পারলেন?! ওই মেয়ের মা বাবার কি হবে, সেই কথা কি একটুও মনে পড়েনি? আপনি কেমন করে পারলেন আপনার ছেলেকে সহযোগিতা করতে, ওই অন্যের মেয়ের আনার ব্যাপারে? আর তাদের আপনার ঘরে স্থান দিলেন!! এই কাজটি করতে আপনার বিবেক বিবেচনায়, মনন মানবতায় একটুও কি বাধা আসেনি? বাধা আসলে, মেয়ের মা বাবার সম্মানের দিকে তাকালে, অবশ্যই তো এটা করতেন না? অন্যের মেয়ের আপনার ঘরে স্থান দিতেন না? স্থান দিয়েছেন ছেলের একজন গার্জিয়ান হয়ে, ছেলের সাথে আপনিও তাই অপরাধী! এবার জবাব পুত্রের জন্মদাত্রী মা, যা দিয়েছিলেন তা এই: ‘আমার বিবেক বিবেচনা জ্ঞান মনুষ্যত্ব, মেয়ের মায়ের সম্মান জ্ঞান, মনুষ্যত্ব বিবেচনার মতো নয় বলেই, ওদেরকে আশ্রয় দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। যদি আমি কন্যার মা বাবার মতো বিবেকহীন হৃদয়হীন মনুষত্বহীন ইত্যাদিহীন হতাম, তাহলে মেয়ের মা বাবার মতো আমিও দুজনকে বের করে দিতে পারতাম। কিন্তু আমি পারি নাই কারণ আমার জ্ঞান মেধা বিলুপ্তি হইনি বা লোপ পাই নি, সবকিছু ঠিকঠাক আছে। যখন দেখলাম মিশুছাড়া শিমু অস্তিত্বহীন। শিমু ছাড়াও মিশু অস্তিত্বহীন! একে অপরে ছাড়া ওদের চেতনা শক্তি অচল! ওরা বিকল! কেউ কারো ছাড়া বাঁচবে না! তখন আমি বাধ্য হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ওদের দুজনকে বাঁচালাম!! ওদের যে বাচালাম এটাই তো আমার অপরাধ?? যদি ওরা মারা যেত তাহলে আমিও অপরাধী হতাম না। কেউ অপরাধী হতো না। ওরাও আমার কিছু বলতো না। শুধু আমার ২৭ বছর লালন পালন করা পুত্রকে হারাতাম। আর ওরা হারাতো ওদের কন্যাকে। প্রশ্ন করেছিলাম আপনি কি করে বুঝলেন এটা হতো? :আমি যখন আমার ছেলের বিরুদ্ধে কমপ্লেন পাই ওই মেয়ের ব্যাপারে, তখন থেকেই আমি আমার ছেলের পিছনে আর ওই মেয়ের পিছনে লেগেছিলাম ঠিক সিআইডির মতো। আমি ওই মেয়ের গার্জিয়ান মা-বাবার পিছনেও লিখেছিলাম। কারণ আমার কষ্টের পুত্রের, বিষয় আশ্রয় ঘটনা এবং সে কারো ব্ল্যাকমেইলে জড়িত কেনা? বা সে কাকে চুস করছে। তাকে কার হাতে তুলে দেবো। সেটা কি তদন্ত করে দেখবো না? তুমি তো আজ সাংবাদিকতা করতে এসেছো, আমার পুত্র মেয়ে বের করে এনে আমার ঘরে রেখেছে, এই তদন্তে। আমার পুত্রকেও তো কন্যার মা তার ঘরে স্থান দিতে পারতো কিন্তু তা দেয়নি কেন??? তারা আমাকেও জানায়নি কেন?!! আমি তো ছয় মাস ধরে, তদন্ত করেছি, আমার প্রাণপ্রিয় ছেলের, ছেলের প্রিয়তমা শিমুর ও শিমুর নির্মম নিষ্ঠুর মা-বাবার। তারা আমাকেও তো জানায়নি! উইদাউট নলেজ থেকে আমি জেনেছি! তারপরে মোটামুটি তদন্তে সব উদ্ধার করেছি!

:কিভাবে? :কিভাবে শুনতে চাও? ১. ছেলেকে শাসন করেছি। ২. মেয়েকে শাসন করেছি। ৩.যখন পারিনি, শাসন হেরে গিয়েছে, তখন সারারাত না ঘুমিয়ে তাদের সবাইকে জানতে তাদের ঘরের পিছনে পাতা দিয়েছি। ৪. অন্যদের থেকে জানতে চেষ্টা করেছি। ৫. ওদেরকেও যার যার মত আলাদা কথা বলে ব্যক্তিগতভাবে জেনেছি। এবং ওদের দুজনকে মেয়ের মা বাবার পা জড়িয়ে ধরা দেখেছি!!! ওরা বাঁচবে না একে অপরের না পেলে, তাদেরকে ওরা সেটাও বলেছে! কিন্তু তারা পাত্তা দেয়নি! বিষয়টাকে গুরুত্ব দেয়নি! আমি সেটা দেখেছি উপলব্ধি করেছি!! মেয়ের মা বাবার কাছে আত্মসমর্পণ করে হেরে যাওয়ার দুই দিন বাদে, ওরা যখন, মৃত্যুর শপথ করে, পদক্ষেপ নেয়ার উপক্রম! পরিস্থিতি মোকাবেলায়, আমিই মৃত্যুর সম্মুখীন বাধা দিয়ে, ওদেরকে ঘরে নিয়ে এসেছি! উপায়ান্ত না পেয়ে নিজ সিদ্ধান্তে তাৎক্ষণিক, আমার দুই ভাইকে অনুরোধ করে হাজির এবং সাক্ষী রেখে বিয়ে দিয়েছি!! কারণ অবিবাহিত অবস্থায় আমার ঘরে আমি আনতে চাইনি। পুত্রের বাবাকে ওই মুহূর্তে জ্বালাইনি জানাতে পারি নাই! তবে পরে জানিয়েছি!! আমার ছেলে উচ্চ শিক্ষিত সরকারি কর্মকর্তা। ক্লাস ওয়ান চেহারা। আমড়াও ফার্স্ট ক্লাস ফ্যামিলি। ওদিকে মেয়ে মাস্টার্স পড়ে। চেহারা সাধারণ, আমার ছেলের সাথে যায়না! তুলনা করার প্রশ্নই নাই!! বংশের দিক থেকেও আমাদের ধারে কাছেও তারা নাই! তাহলে বিষয়টা কেমন হয়ে দাঁড়ালো না? উল্টো আমি যেটা করবো বা আমারই যেটা করা উচিত। তারাই সেটা করতে চায় !!! অমানুষ বলেই তো!!! বাড়াবাড়ির একটা সীমারেখা থাকা প্রয়োজন। কে জিতেছে, আমিই তো ঠকেছি। আমার ছেলে ঠকেছে আজন্মের ঠকা! আমি নিঃসন্দেহে ব্যাংকার ও ম্যাজিস্ট্রেট মেয়ে পেয়ে বসে আছি, আমাদের মতই উচ্চ বংশের। কিন্তু আমার ছেলে নিম্ন বংশের ওইটাকে নিলো। ছেলের পছন্দ ও সুখের কথা ভেবে আমিও মেনে নিয়েছি। এখন তুমি সাংবাদিক এসেছো কন্যার মা-বাবার পক্ষে তদন্তে। আইনি আশ্রয় নিতে বলো গে। আমি করেছি ৬মাস পর্যন্ত তদন্ত, পুত্র কন্যা ও কন্যার মা বাবাকে। তাদের উদ্দেশ্য বিধেয় সবকিছুকে ধারণ এবং শ্রবণ করেছি। জেনেছি। বলে পুত্রের মা তার তদন্তকৃত ধারণ করা মোবাইল ভিডিও গুলোকে আমায় দেখালো। একাধিক সিডি বানিয়ে রেখেছে। বললেন :তুমি স্থির হয়ে বসে সিডি পেলে দেখে, রেজাল্ট বের করো এবং জানাও আমাকে, কে অপরাধী??!! জন্ম দিলে যেমন জনক হওয়া যায় কিন্তু পিতা হওয়া যায় না। পিতা হতে হলে লালন পালন করা লাগে। একজন মা জন্ম দিলেও মা নয়। মা হতে হলে সন্তানের সব কিছুর সাথে অতপরিত: জড়িত হতে হয়। সন্তানের আত্মার সাথে একনিষ্ঠ থাকতে হয়। তাতে যদিও সামাজিকভাবে মানুষের চোখে সৃজনশীলতা ক্ষুন্ন হয়! দৃষ্টিকটু লাগে! অশ্লীল দেখা যায়। কিন্তু প্রকৃত মা হতে হলে, সন্তানের মঙ্গল চাইলে, কল্যাণ কামনার্থে, অশ্লীল দেখা গেলেও, দৃষ্টিকটু লাগলেও, সেটাই করতে হয়! সেটাই করা লাগে! বাঞ্ছনীয়ও তো বটে। অতএব সন্তানকে সন্তানের মতো আগলে রাখতেই জন্মদাত্রী মাকে হতে হয়, স্বয়নে স্বপনে জাগরণে এবং বাস্তবায়নে স্থায়িত্ব সিআইডি।

২৪. ৫.২০২৫ ইং, দুপুর ২টা, শনিবার।

Related Articles

Back to top button