topজাতীয়

মার্চ ফর গাজা : এ যেন এক অন্য ঢাকা

টাইমস ২৪ ডটনেট: গাজায় ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর বর্বরোচিত হামলার প্রতিবাদ ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের জনগণের প্রতি সংহতি জানিয়ে ‘মার্চ ফর গাজা’ গণসমাবেশে লাখো মানুষের ঢল নামে। রাজধানী ঢাকার প্রাণকেন্দ্র সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘প্যালেস্টাইন সলিডারিটি মুভমেন্ট বাংলাদেশ’ ব্যানারে আয়োজিত এ কর্মসূচিতে বাংলাদেশ ও ফিলিস্তিনের পতাকা হাতে অংশ নেন জনতা। কর্মসূচি থেকে ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে জায়নবাদী ইসরায়েলের গণহত্যার বিচার আন্তর্জাতিক আদালতে নিশ্চিত করা, গণহত্যা বন্ধে কার্যকর সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণ করার দাবি জানানো হয়েছে। এছাড়া ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও শান্তি কামনায় কর্মসূচিতে বিশেষ মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়েছে।
শনিবার (১২ এপ্রিল) বিকেল ৩টা থেকে কর্মসূচির সময় নির্ধারণ করা থাকলেও ভোর থেকেই জড়ো হতে থাকেন মানুষজন। ফ্রি ফ্রি প্যালেস্টাইন স্লোগানে মুখরিত এ জনসমাগমে তিল ধারনের জায়গা ছিল না উদ্যানে। দুপুরের আগেই পুরো উদ্যান পরিণত হয় জনসমুদ্রে। জনস্রোত ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের এলাকায়। সোহরাওয়ার্দীতে জায়গা না পেয়ে রমনা পার্কসহ আশেপাশের এলাকায় অবস্থান নেন অনেকে। গণসমাবেশে অংশ নেন নারী-শিশু-বয়স্করাও। ভেদাভেদ ভুলে এক কাতারে দাঁড়ান দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা।‘তুমি কে আমি কে, ফিলিস্তিন ফিলিস্তিন’ স্লোগানের পাশাপাশি ‘গাজা উই আর উইথ ইউ’, ‘স্টপ জেনোসাইড ইন গাজা’সহ বিভিন্ন স্লোগান সম্বলিত ব্যানার ও প্ল্যাকার্ড বহন করেন মানুষজন। পাশাপাশি তারা ফিলিস্তিনের পতাকা উড়িয়ে প্রতীকী প্রতিবাদ জানান।এরপর পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে বিকেল সোয়া ৩টার দিকে ‘মার্চ ফর গাজা’র আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়।
‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচি থেকে ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে জায়নবাদী ইসরায়েলের গণহত্যার বিচার আন্তর্জাতিক আদালতে নিশ্চিত করা; যুদ্ধবিরোধী নয়, গণহত্যা বন্ধে কার্যকর সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণ করার দাবি জানানো হয়েছে। পাশাপাশি ১৯৬৭ সালের পূর্ববর্তী ভূমি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য বাধ্যবাধকতা তৈরি করতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। এটি পাঠ করেন আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান।
তিনি বলেন, আল্লাহর নামে শুরু করছি, যিনি পরাক্রমশীল, যিনি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেন, যিনি মজলুমের পাশে থাকেন এবং জালিমের পরিণতি নির্ধারণ করেন। আজ আমরা বাংলাদেশের জনতা, যারা জুলুমের ইতিহাস জানি, প্রতিবাদের চেতনা ধারণ করি। আজকে আমরা সমবেত হয়েছি মৃত্যু ভয়হীন ফিলিস্তিনের গাজার জনগণের পাশে দাঁড়াতে।
গণসমাবেশে অংশ নিয়ে ইসলামিক স্কলার ড. মিজানুর রহমান আজহারী বলেন, জনতার এই মহাসমুদ্র ফিলিস্তিন ও আল আকসার প্রতি আমাদের ভালোবাসার প্রকাশ। ভৌগোলিকভাবে আমরা তাদের থেকে দূরে থাকলেও আজকের এই বিপুল উপস্থিতি প্রমাণ করে আমাদের প্রত্যেকের হৃদয়ে বাস করে একটি করে ফিলিস্তিন।
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও শান্তি কামনায় ‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচিতে বিশেষ মোনাজাত করা হয়। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব আবদুল মালেক পরিচালিত মোনাজাতে অংশ নেওয়া লাখো মানুষের চোখে ছিল অশ্রু। ইসরায়েলি বাহিনীর অব্যাহত হামলা, শিশু ও নারীদের মৃত্যু, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া গাজা উপত্যকার করুণ বাস্তবতা হৃদয়ে নিয়ে মানুষ প্রার্থনা করেন শান্তির জন্য। বিকেল সোয়া ৪টার দিকে এই বিশেষ মোনাজাত করা হয়। মোনাজাতে বলা হয়, ইসরায়েল ফিলিস্তিনে যে নৃশংসতা চালাচ্ছে, তা মানবতার ওপর চরম আঘাত। আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি, যেন তিনি নির্যাতিত মুসলমানদের রক্ষা করেন এবং ফিলিস্তিনকে স্বাধীনতার আলো দেখান। একইসঙ্গে মোনাজাতে গাজায় চলমান ইসরায়েলি হামলা বন্ধ হওয়া, ধ্বংসস্তূপে আটকে পড়াদের উদ্ধার ও আহতদের সুস্থতা, শিশু ও নিরীহ নাগরিকদের জীবন রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ, বিশ্ব নেতাদের বিবেক জাগ্রত হওয়া, নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের ওপর অব্যাহত আগ্রাসনের বিচার চেয়ে দোয়া করা হয়। কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া মানুষের কাছে ইসরায়েলি পণ্য বর্জনের আহ্বানে লিফলেট বিতরণ করছে বিভিন্ন সামাজিক ও ছাত্র সংগঠন। লিফলেটে সবাইকে ইসরায়েলি স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোম্পানির পণ্য বর্জনের আহ্বান জানানো হয়েছে।‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচিতে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন এলাকা থেকে লাখো মানুষ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গণসমাবেশে অংশ নেন। গণসমাবেশে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা অংশ নেন।
এতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, আব্দুস সালাম আজাদ, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সেক্রেটারি শফিকুল ইসলাম মাসুদ, উত্তরের রেজাউল করিম; বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক; লেবার পার্টির একাংশের চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান; গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর; গণঅধিকার পরিষদের একাংশের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান; জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ; এবি পার্টির চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান মঞ্জুসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা অংশ নেন। এক সময় তাদের মঞ্চে দাঁড়িয়ে হাতে হাত ধরে একাত্মতা প্রকাশ করতে দেখা যায়।
সব বয়সী মানুষের এই গণজমায়েতে সবার দৃষ্টি কাড়ে একদল শিশু। তারা কেউ মাথায় ব্যান্ডেজ, কেউ হাত-পা বেঁধে , কেউবা হাতে করে নিয়ে এসেছিল ছোট কফিনে মোড়ানো ‘শিশু লাশ’। এভাবেই ‘আহত ফিলিস্তিনি’ সাজে মিছিলে অংশ নেয় সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠী নামক একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের শিশু শিল্পীরা।শিশুরা সাদামাটা অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তুলে ধরে গাজার শিশুদের যন্ত্রণাদায়ক বাস্তবতা। একজন শিশু ‘বাবা’ সেজে কাঁধে করে নিয়ে আসেন নিজের সন্তানের প্রতীকী মরদেহ। এসব দৃশ্য দেখে অনেক পথচারী আবেগে কেঁপে ওঠেন, কেউ কেউ ফেলেছেন চোখের পানি। আবার এমন দৃশ্যে কেউ বা গগনবিদারী চিৎকারে দিয়েছেন ‘নারায়ে তাকবির,আল্লাহু আকবর’ স্লোগান।
এই কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন জুলাই বিপ্লবে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীনরাও। ফিলিস্তিনের পতাকা হাতে মিছিল-সমাবেশে যোগ দেন বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন জুলাই বিপ্লবে আহতরা। এসময় সাধারণ মানুষদের সঙ্গে তাদেরকেও নারায়ে তাকবিরসহ বিভিন্ন স্লোগান দিতে দেখা যায়। আহতদের একজন জরিফুল ইসলাম, মাথায় ফিলিস্তিনের পতাকা বেঁধে হুইল চেয়ারে করে শাহবাগে এসেছিলেন। নিজে আহত হয়েও কেন এসেছেন, জানতে চাইলে জরিফুল ইসলাম বলেন, আমরা হয়তো হাঁটতে পারছি না, কিন্তু গাজার মানুষের পাশে দাঁড়াতে শরীর নয়, লাগে মন। সেই মন আমাদের এখানে এনেছে। ফিলিস্তিনবাসীর জন্য আমরা আমাদের জীবনটাও উৎসর্গ করে দিতে পারি। মীর সারওয়ার হোসেন নামের আরেকজন বলেন, হাসপাতালের বেডে শুয়ে ছিলাম। কিন্তু পাশেই গাজবাসীদের পক্ষ নারায়ে তাকবির স্লোগান শুনে আর শুয়ে থাকতে পারলাম না। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে একবার আহত হয়েছি, এবার সুযোগ পেলে ফিলিস্তিনের পক্ষে যুদ্ধ করে শহীদ হয়ে যাবো।
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতিবাদে ডাকা ‘মার্চ ফর গাজা’য় কর্মসূচিতে সংহতি জানিয়ে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এসেছিলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজারো শিক্ষার্থী।দুপুর সোয়া ২টায় মিছিল নিয়ে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজারো শিক্ষার্থী ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আসেন। এ সময় শিক্ষার্থীদের হাতে ফিলিস্তিন ও বাংলাদেশের পতাকা দেখা যায়। মুখে মুখে ছিল প্রতিবাদী স্লোগান। রাজধানীর আফতারনগর থেকে মিছিল নিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা ফিলিস্তিনের সমর্থনে ঐতিহাসিক গণজমায়েতে অংশ নেন।ব্র্যাক, নর্থ-সাউথ, ইমপেরিয়াল, ইস্ট-ওয়েস্ট, কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটিসহ বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে মিছিল নিয়ে ফিলিস্তিনে গণহত্যার প্রতিবাদ জানাতে কর্মসূচিতে অংশ নেন।
ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর গণহত্যা, ট্রাম্প প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা এবং আরব বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধানদের হামলায় নিশ্চুপ থাকার ঘটনা নিয়ে প্রদর্শনী করেছেন কয়েকজন ছাত্র। প্রদর্শনীতে দেখা যায়, নেতানিয়াহুর মুখোশ পরা একজন রক্তের বাটি হাতে নিয়ে হাঁটছেন যার পুরো শরীরে ফিলিস্তিনি মানুষের রক্ত। তার পাশেই ট্রাম্পের মুখোশ পরা একজন নেতানিয়াহুকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। তারও শরীরজুড়ে রক্তের দাগ। অন্যদিকে আরব নেতারা তাদের দুজনের আশপাশে ঘোরাফেরা করছেন এবং তাদের হাতে চুমু খাচ্ছেন, আনুগত্য প্রকাশ করছেন। তাছাড়া, তাদের ঠিক পেছনেই সাদা কাফনে মোড়ানো অসংখ্য লাশের প্রতিকৃতি রাখা হয় যা নেতানিয়াহু, ট্রাম্প ও তার সহযোগী আরব বিশ্বের নেতারা টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
আয়োজকদের একজন বলেন, আমরা দেখছি ফিলিস্তিনে দখলদার ইসরায়েলি বাহিনী গণহত্যা চালাচ্ছে যার প্রত্যক্ষ মদত দিচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন। তাছাড়া আরব বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধানরা এসব দেখেও একেবারে নিশ্চুপ। অর্ধ লক্ষাধিক নিরীহ মুসলিমের রক্তেও তাদের ঘুম ভাঙছে না। তাই আমরা এর প্রতিবাদ হিসেবে এই প্রদর্শনীর আয়োজন করেছি।
কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে আসা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিনামূল্যে পানি বিতরণ করেছেন রামপুরা বনশ্রীর একদল যুবক। দুপুর ১টার দিকে সোহওয়ার্দী উদ্যান সংলগ্ন মৎস্য ভবন মোড়ে ট্রাকে করে হাফ লিটারের ৫ হাজার বোতল পানি বিতরণ করা হয়। প্রচণ্ড রোদে বিনামূল্যে পানি পেয়ে খুশি হন প্রতিবাদী সাধারণ জনতা। পানি বিতরণ করতে আসা বনশ্রীর যুবক সাব্বির আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ফিলিস্তিনে মুসলিম ভাই বোনদের ওপর ইসরায়েলি বাহিনী নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা কিছুই করতে পারছি না। বাংলাদেশের আলেম সমাজ আজ মার্চ ফর গাজার ডাক দিয়েছেন। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে এখানে এসেছি। আমরা কয়েক বন্ধু নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে ৫ হাজার বোতল পানি নিয়ে এসেছি। পিপাসার্ত মানুষের মধ্যে এই পানি বিতরণ করছি।

Related Articles

Back to top button