বাংলাদেশ

খিলক্ষেতে ধর্ষক সন্দেহে গণধোলাই, মব-জাস্টিসের বিপদ ও অপরাধের দায়

এস.এম.নাহিদ, বিশেষ প্রতিনিধি :ঢাকার খিলক্ষেতের মধ্যপাড়া এলাকায় একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে।১৮ই মার্চ (মঙ্গলবার)রবিউল ইসলাম জান (আনু:১৩) নামের এক কিশোরকে ধর্ষক সন্দেহে উত্তেজিত জনতা গণপিটুনি দিয়েছে। আশংকাজনক অবস্থায় বর্তমানে ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন রয়েছে ছেলেটি। কিন্তু ঘটনার রহস্যের গভীরে রয়েছে গুরুতর কিছু প্রশ্ন – শিশুটির বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ সত্য ছিল কিনা? কিংবা ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছিল নাকি শুধু ভিত্তিহীন গুজবে কিংবা কারো স্বার্থ হাসিলের কারণে এত বড় একটি ঘটনা ঘটল? অভিযুক্ত ছেলেটি মারা গেলে সে দায়ভারই বা কার ছিল?এইসব প্রশ্নের উত্তর এখনও মেলেনি তবে উত্তেজিত জনতা তাদের রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি এবং অভিযুক্ত কিশোরকে পুলিশ হেফাজত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গণপিটুনি ও পুলিশের ওপর হামলা এবং গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় ২জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত পাঁচ হাজার জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেছে খিলক্ষেত থানা পুলিশ।

এদিকে অভিযুক্ত কিশোরের খালার দাবি, রোজার ১০ দিন আগে ওই মেয়ে শিশুটির মামা নয়নের সঙ্গে তার ভাগিনার তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল।আমার ভাগিনাকে সে মারধর করেছিল। সেই ঘটনার প্রতিশোধ নিতেই আমার ভাগিনাকে পরিকল্পিতভাবে মারধর করেছে। আমি এর সুষ্ঠু তদন্ত চাই।ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান,ক্ষুব্ধ জনতা এক কিশোরকে ধর্ষক সন্দেহে মারধর শুরু করে এবং পুলিশ তাকে উদ্ধার করতে গেলে পুলিশের গাড়ি ও সদস্যদের ওপর হামলা চালায়। পুলিশ তাকে থানায় নিয়ে আসার চেষ্টা করছিল কিন্তু বিক্ষুব্ধ জনতা তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে গণপিটুনি দেয়।

মব-জাস্টিস বা জনতার হাতে বিচারের এই ধরনের প্রবণতা কোনোভাবেই ন্যায্য হতে পারে না। আইন অনুযায়ী যেকোনো অপরাধের বিচার আদালতে হওয়া উচিত জনগণের হাতে নয়। এটি একটি বিপজ্জনক দৃষ্টিভঙ্গি যেখানে আইন ও নিয়ম ভেঙে মানুষ-হত্যার মতো গুরুতর অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে কোনও অভিযোগের ভিত্তিতে মানুষকে হত্যা করা বা হত্যার উদ্দেশ্যে নির্যাতন করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তাই এই ঘটনাটি কি সত্যিই ধর্ষণের ঘটনা ছিল, নাকি ছিল শুধু গুজব বা বিভ্রান্তি? ঘটনার সার্বিক বিষয় মাথায় নিয়ে ইতিমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকেও তদন্ত শুরু হয়েছে বলে সুত্রে জানা যায়।

এই ধরনের ঘটনা শুধু খিলক্ষেতের জন্য নয়, পুরো সমাজের জন্য এক মারাত্মক অশনী সংকেত। যেকোনো অভিযোগে উত্তেজিত জনতার আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার এমন আচরন শুধু অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার বিষয় নয় বরং পুরো সমাজের কাঠামো এবং নৈতিকতার জন্যও বিপজ্জনক। যে সমাজে এভাবে মব-জাস্টিসের প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয়, সেখানে আইনের শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে এবং অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যায়। আমরা যতই সমাজে উন্নয়ন কিংবা আইনশৃঙ্খলা প্রসারের কথা বলি, যদি জনগণ নিজের হাতে বিচার প্রতিষ্ঠা করতে থাকে, তাহলে সমাজে বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতা তৈরি হবে। এ ঘটনার পর প্রশাসনকে আরো দৃঢ়ভাবে এই ধরনের অপরাধের মোকাবিলা করতে হবে এবং জনগণকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করতে হবে।

মব-জাস্টিসের ঘটনা কখনই সমর্থনযোগ্য নয়। গণপিটুনি দিয়ে কাউকে হত্যা করা বা হত্যার চেষ্টা করার মতো ঘটনা সমাজের কাঠামো ও মানবিকতার প্রতি গভীর আঘাত হানছে। প্রত্যেকের অধিকার রয়েছে সঠিক বিচার পাওয়ার এবং আদালতই একমাত্র জায়গা যেখানে একজন ব্যক্তির অপরাধ বিচার করার উপযুক্ত স্থান। তাই খিলক্ষেতের এই ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং প্রশাসনকে আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা আর না ঘটে এবং সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত থাকে।

Related Articles

Back to top button