
টাইমস ২৪ ডটনেট, ঢাকা: নিত্যনতুন কৌশলে প্রতারক চক্রের সদস্যরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রতিনিয়ত সংঘবদ্ধ চক্রের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে অনেকেই। প্রতারক চক্রে পুরুষদের পাশাপাশি নারী সদস্যও রয়েছেন। কোনো কোনো চক্রে আছেন বিদেশিরাও। শহর থেকে গ্রাম সর্বত্র বিস্তৃত এদের প্রতারণার জাল। প্রতারণার শিকার কেউ কেউ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারস্থ হচ্ছেন। আবার কেউ লোকলজ্জা, কেউ বা বাড়তি ঝামেলা এড়াতে নীরব থেকে যাচ্ছেন। এসব প্রতারক চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধে রাজধানীসহ সারাদেশে বহু মামলা রয়েছে। কিছু মামলা জমিনে থাকলেও অনেক মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি থাকার পরেও পুলিশ গ্রেফতার করছে না। কোটি কোটি টাকা প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েও ঘুরে বেড়াচ্ছে বীরদর্পে। রাজধানীতে এমনই এক প্রতারক চক্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। তার নাম মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম চৌধুরী। ইত্যেমধ্যে প্রতারণার মাধ্যমে আরিফুল ইসলাম চৌধুরী প্রায় ২শ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তার বিরুদ্ধে গোয়েন্দারা তদন্ত শুরু করেছে বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, প্রতারক মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম চৌধুরী নিজে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা সেজে প্রতারণা, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, জমি লিজ, প্লট বিক্রি, চাকরি দেয়ার নামে প্রতারণা, এমএলএল ব্যবসা, পে-অর্ডার, অনলাইন প্রতারণা ও গাড়ি বিক্রিসহ বিভিন্ন প্রতারণা এখন নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সে বিদেশ লোক পাঠানো ও বিয়ের নামে প্রতারণা করেও হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা।
মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম চৌধুরীর সিন্ডিকেটের ১৫/২০ জনের একটি শক্তিশালী গ্রুপ রয়েছে। তার দলের প্রত্যেক সদস্যই লোভনীয় চাকরির অফারে বিদেশে লোক পাঠানো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপে বন্ধু সেজে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। তাদের লক্ষ্য সাধারণত সহজসরল মানুষ। সুযোগ বুঝে নানা ছলচাতুরি ও মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে তারা প্রতারণা করছে। প্রতারক চক্রের সদস্যরা র্যাবসহ আইনশৃংখলা বাহিনীর হাতে প্রায় দিনই গ্রেপ্তার ও হচ্ছে। তবে জামিনে বেরিয়ে এসে আবারও প্রতারণার কাজ চালিয়ে যায়।
সূত্র জানায়, গত ২৩ ফেব্রুয়ারী রাজধানীর তুরাগের চন্ডালভোগ সানেক্স অটো মোবাইল ওয়ার্কসপে প্রতারক চক্রের মূলহোতা মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম চৌধুরী নিজের ব্যবহারের প্রিমিও ২০০৬ মডলের এফ প্রিমিও সাদা পাল কালারের একটি গাড়ি ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা বিক্রি করে। ওই গাড়িটি ক্রয় করেন ব্যবসায়ী মো. সোহেল (৩৫)। নগদ টাকা পরিশোধ করলেও প্রতারক মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম চৌধুরী বলে তার সাথে গাড়িতে বউ রয়েছে, তাই বউকে মিরপুরের বাসায় নামি গাড়িটি দিয়ে দিবেন। তার সাথে সানেক্স অটো মোবাইল ওয়ার্কসপের মো. নিলয় সরকারকে দেয়া হয়। কিন্তু প্রতারক আরিফুল ইসলাম কৌশলে মিরপুর এক নম্বরে একটি বাড়ির নিচে নিলয় সরকারকে বসিয়ে রেখে সে পালিয়ে যায়। এ ব্যাপারে নিলয় সরকার বাদী হয়ে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি দারুস সালাম থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলা নম্বর ১৬। এই মামলায় মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম চৌধুরী জামিনে চলে এসেছে। বর্তমানে মামলার বাদী নিলয় সরকারকে প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে। তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এছাড়াও ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী মো. সোহেল বাদী হয়ে গত ১২ ফেব্রুয়ারী তুরাগ থানায় একটি জিডি করেছেন। জিডি নম্বর ৬৪৭। তাকেও সন্ত্রাসী ও প্রতারক চক্রের সদস্যরা হুমকি দিচ্ছে।
অপর একটি সূত্র জানায়, রাজধানীর দারুস সালাম থানাধীন মাজার রোড এলাকায় অন্যের প্রতিষ্ঠানকে নিজের দেখিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের প্রায় দেড়শ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম চৌধুরীর বিরুদ্ধে। সে নিজেকে বাংলাদেশ যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য পরিচয় দেয়। অভিনব প্রতারণায় ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির পার্টনারশিপ ব্যবসায় অর্থলগ্নি করানো ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরকারি চাকরি দেওয়ার নামে প্রায় অর্ধশত ভুক্তভোগীর কাছ থেকে তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন বিশাল অঙ্কের এই টাকা। মাসের পর মাস ঘুরেও কাজ না হওয়ায় এবং টাকা ফেরত না পাওয়ায় ভুক্তভোগীরা থানা ও আদালতে মামলা ও সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন ঢাকা-১৪ আসনের এমপি এবং কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিলের প্রভাবে আরিফুলের কিছুই করতে পারেনি কেউ। উল্টো র্যাব-পুলিশ দিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে এতদিন ভুক্তভোগীদের কোণঠাসা করে রেখেছিলেন এই প্রতারক।
জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আরিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে ধানমন্ডির বাসিন্দা কেএম শাহরিয়ার হক বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র হত্যার অভিযোগে মামলাসহ অন্য ভুক্তভোগীরা বেশ কয়েকটি হত্যা মামলা করায় কিছুদিন গা-ঢাকা দিয়ে ছিলেন আরিফুল। কিন্তু সম্প্রতি ভোল পাল্টে ফের সামনে এসেছে প্রতারক আরিফুল ইসলাম। অভিযোগ রয়েছে, মিরপুরের একজন যুবদল নেতার আশ্রয়ে অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে আরিফুল ইসলাম। পাওনা টাকা ফিরে পেতে ৫ আগস্টের পর ভুক্তভোগীরা যৌথ বাহিনীর সহায়তায় আরিফুল ইসলামকে মিরপুরে আটক করেছিলেন। কিন্তু তার পক্ষ হয়ে ঢাকা মহানগর উত্তরের যুবদলের এক নেতার কারণে সে যাত্রায় বেঁচে যায়। বর্তমানে ২০০ কোটি টাকা হাতিয়েও তিনি প্রকাশ্যে বীরদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছে আরিফুল।
এদিকে দলীয় নির্দেশনা অমান্য করে আওয়ামী লীগের দোসরদের সঙ্গে যোগসাজশে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়ার কথা উল্লেখ করে যুবদল নেতাকে গত ৬ সেপ্টেম্বর কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয় ঢাকা মহানগর উত্তর যুবদলের পক্ষ থেকে। যুবলীগ নেতা আরিফুলের বিষয়ে ওই যুবদল নেতা বলেন, আরিফুল যে যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, বিষয়টি আমি জানতাম না। আর আমার মধ্যস্থতায় তাকে ছাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে, এ অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। এটি স্রেফ অপপ্রচার। অন্যদিকে অভিযোগের বিষয়ে জানতে আরিফুল ইসলামের মোবাইল ফোনে একাধিকবার চেষ্টা করা হলেও ওপাশ থেকে সাড়া দেননি তিনি।
রাজধানীর শান্তিনগর এলাকার বাসিন্দা ভুক্তভোগী মো. ইসমাইল জানান, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য বিবিএ সম্পন্ন করে স্বজনদের সহায়তায় নিজ উদ্যোগে ব্যবসা করার স্বপ্ন দেখছিলেন তিনি। পূর্ব পরিচিতির সুবাদে আরিফুলকে তিনি জানান, ব্যবসায়িক উদ্যোক্তা হতে চান। মওকা পেয়ে ইসমাইলের পরিবারকে কেন্দ্র করে প্রতারনার ফাঁদ পাতে আরিফুল। দারুস সালাম থানাধীন মাজার রোড এলাকায় জনৈক মাসুদ চৌধুরীর ম্যানুফ্যাকচারিং প্রতিষ্ঠানকে নিজের বলে জাহির করে সে। এই প্রতিষ্ঠান ছাড়াও বিভিন্ন ব্যবসায় আরিফুলের মাধ্যমে বিনিয়োগ করার প্রস্তাব দিলে ইসমাইল বিশ্বাস করে পার্টনারশিপ ব্যবস্যায় বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন। এরপর ইসমাইল ও তার পরিবারের কাছ থেকে দফায় দফায় প্রায় ৫৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় আরিফুল। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি সড়ক ও পরিবহন মন্ত্রণালয়ে টেন্ডারে ৩০ শতাংশ লভ্যাংশে বিনিয়োগের কথা বলেও ব্যাংকের মাধ্যমে ৫ লাখ টাকা নেয় সে। এ ছাড়া স্থানীয় এমপির মাধ্যমে মিরপুর কাঁচা বাজারের আড়ত ৫ বছরের জন্য ইজারা নেওয়ার কথা বলে ১২ লাখ, চায়না থেকে আসা কন্টেইনার শিপমেন্টে বিনিয়োগের কথা বলে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর ইসমাইল জানতে পারেন সব ভুয়া। একপর্যায়ে আরিফুলের কাছে সব টাকা ফেরত চাইলে তিনি যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। বিভিন্ন মাধ্যমে প্রাণনাশের হুমকি আসতে থাকে ইসমাইলদের পরিবারে। যুবলীগ নেতা হওয়ায় তার বিরুদ্ধে ৫ আগস্টের আগে মুখ খুলতেও সাহস পাচ্ছিলেন না ভুক্তভোগী মো. ইসমাইল।
খিলগাঁও বনশ্রীর বাসিন্দা ভুক্তভোগী আনিছুর রহমান জানান, আরিফুল ইসলাম ২০২২ সালে তার কাছে একটি এলিয়ন প্রাইভেটকার বিক্রির জন্য নিয়ে আসেন। গাড়িটি বিক্রির কথা বলে তার কাছ থেকে প্রায় ১২ লাখ টাকা নেন। একপর্যায়ে গাড়ির যাবতীয় ডকুমেন্ট দেওয়ার কথা বলে দারুস সালাম থানাধীন কিয়াংসি চায়নিজ রেস্টুরেন্টের সামনে কৌশলে চা খাওয়ার কথা বলে নামিয়ে গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যান আরিফুল। পরে টাকা ফেরত চাইলে আরিফুল তার সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে হামলা চালান। টাকা হারিয়েও ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পাননি এই ভুক্তভোগী।
এ ছাড়াও আরও কয়েকজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা হয় সঙ্গে। তাদের মধ্যে মো. ইসমাইলের ৭৬ লাখ টাকা, চকরিয়ার শিক্ষক মাহমুদুল্লাহ মোল্লার ২০ লাখ টাকা, চকরিয়ার ব্যবসায়ী জিয়া চৌধুরীর ৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা, আড়িয়ানের ২০ লাখ টাকা, মিথুনের ৩৩ লাখ টাকা, ভূমি অফিস ও প্রাইমারি স্কুলে সরকারি চাকরি দেওয়ার কথা বলে অন্তত ২১ জনের কাছ থেকে জনপ্রতি ১০ থেকে ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন যুবলীগ নেতা আরিফুল। শুধু তাই নয়, ১০ লাখ টাকা চেয়ে মারধরের অভিযোগ এনে আরিফুলের স্ত্রী তানজু আক্তার যৌতুকের মামলাও করেছিলেন আরিফুলের বিরুদ্ধে। কিন্তু ক্ষমতার কাছে অসহায় ছিলেন খোদ তার স্ত্রীও।
উত্তরার ব্যবসায়ী মো. সোহেল জানান, মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম চৌধুরী নিজেকে সময় সুযোগ বুঝে বিভিন্ন পরিচয় দিতো। যখন যে সরকার ক্ষতায় থাকে তখন ওই দলের পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করে আসছে। আওয়ামী লীগের প্রত্যেক মন্ত্রী, এমপি ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সাথে তার ছবি রয়েছে। ওইসব ছবি দেখিয়েও প্রতারণা করতো আরিফুল। তার কাছে গাড়ি বিক্রি করেছে। নগদ টাকাও নিয়েছে। কিন্তু গাড়ি দেয়নি। তার কাছে ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা পাই। সে গাড়িও দিচ্ছে না; টাকাও ফেরত দিচ্ছে না। উল্টো সে তার সহযোগিরা বিভিন্ন সময় হুমকি দিচ্ছে।