আন্তর্জাতিকপ্রবাস

বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রত্যাশা

ফাতেমা নাসরিন, টাইমস ২৪ ডটনেট, ঢাকা: ১৭৬০ সালের ইউরোপের শিল্পবিপ্লবের পর থেকেই মূলত পৃথিবীতে কার্বন নিঃসরণ শুরু হয়, যা বাতাসের উষ্ণতা ও বায়ুদূষণের প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শুধু গত এক শতকেই পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রায় ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, জলবায়ুর এ পরিবর্তনের প্রভাবে ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বেড়ে যাবে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এ ধারা অব্যাহত থাকলে একবিংশ শতাব্দী শেষে বিশ্ব থেকে অন্তত ৪৩টি দেশ সমুদ্রপৃষ্ঠে হারিয়ে যাবে! বাংলাদেশেরও একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ডুবে যাবে। অথচ যেসব দেশ এজন্য দায়ী, তারা এখনো নির্বিকার। পরিসংখ্যানে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত ও রাশিয়া পৃথিবীব্যাপী ৫৫ শতাংশেরও বেশি কার্বন নিঃসরণ করছে। অন্যদিকে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর দায় একেবারেই নগণ্য। বাংলাদেশের দায় তো এ ক্ষেত্রে মাত্র ০.৪৭ শতাংশেরও কম। জলবায়ুতে মানুষের সৃষ্টি ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় ১৫৪টি দেশ ১৯৯২ সালে জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনে স্বাক্ষর করে। এরপর থেকে জলবায়ুবিষয়ক সম্মেলন (কপ) প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৯২ সালে জাতিসংঘে প্রস্তাব পাসের পর ১৯৯৫ সালে জার্মানিতে প্রথম সম্মেলনের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়। এটিই বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন বা কপ (কনফারেন্স অব পার্টিস) নামে পরিচিত। এরপর ধারাবাহিকভাবে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে (করোনার কারণে ২০০০ সাল ছাড়া) বিভিন্ন দেশে। ইউএনএফসিসিসির (ইউনাইটেড ন্যাশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ) মূল দায়িত্ব নির্ধারণ করা হয়েছিল গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে আনা বা প্রশমন।

আজারবাইজানের বাকুতে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন (কপ-৩০) নভেম্বর শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। প্রতি বছরের মতো এবারও বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধি দল তাতে যোগ দিবে। কপ ৩০-এ বাংলাদেশের কিছু ভালো অর্জন রয়েছে। জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা, অর্থের সহজলভ্য এবং জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর সঙ্গে ন্যায্য প্রাপ্তির পক্ষে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ অভিযোজন ও প্রশমনের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ তহবিল বরাদ্দের জন্য জলবায়ু অর্থায়নের পক্ষে দর-কষাকষি করে অনেকাংশে সফল হয়েছে। বাংলাদেশ উন্নত দেশগুলোর ১০০ বিলিয়ন ডলারের বার্ষিক প্রতিশ্রুতি পূরণ করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছিল। জলবায়ু তহবিলের অর্থ প্রাপ্তির জটিলতার বিষয় নিয়েও কথা বলেছিল বাংলাদেশ। ৭০০ মিলিয়ন ডলার লোকসান ও ক্ষতি তহবিল প্রতিষ্ঠা ছিল কপ ২৯-এর একটি মূল অর্জন। জলবায়ুজনিত দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এই উন্নয়নকে স্বাগত জানিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর নেতৃত্বে থাকা বাংলাদেশ ন্যায়সংগত আন্তর্জাতিক অর্থায়নের পক্ষে কাজ করে আসছে। অব্যাহত প্রচেষ্টার ফলে নতুন অর্থায়ন প্রক্রিয়াগুলো কার্যকরী এবং সহজ প্রাপ্তি নিশ্চিত করার ভিত্তিও তৈরি করেছে। আশা করা যায়, এর সুফল অচিরেই মিলবে।
বাংলাদেশ এই সম্মেলনে যাচ্ছে আমূল বদলে যাওয়া এক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। সম্মেলনটি বাংলাদেশের জন্য অভিযোজন, প্রশমন এবং ক্ষতি ও ক্ষয়ক্ষতি অর্থায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা নিশ্চিত করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। সে হিসেবে কপ ৩০-এ বাংলাদেশ জলবায়ু-সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ, উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য অর্জনে বৈশ্বিক পদক্ষেপের হকদার বটে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতি নিরূপণ করার জন্য একটি ক্লাইমেট ভালনারিবিলিটি অ্যাসেসমেন্ট করা হয়েছিল। এই দলিল পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, মধ্য ও উপকূলীয় বন্যাপ্রবণ এলাকাগুলো প্রবল বৃষ্টিপাত এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বন্যা ও নদীভাঙনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। বার্ষিক বর্ষা-বন্যা বাংলাদেশের মোট ভূমির প্রায় ১৮ শতাংশ প্রভাবিত করে। ফলে বিশেষ করে নিম্নাঞ্চলের প্লাবনভূমিতে কৃষি, অবকাঠামো ও জীবিকাকে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল খরাপ্রবণ, শুষ্ক মৌসুমে তীব্র পানি সংকটের সম্মুখীন হয়। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলো ঘূর্ণিঝড়ের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ ঘটনাগুলো তীব্রতর হয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটছে। ফলে মিঠাপানির সম্পদ এবং আবাদযোগ্য জমি দূষিত হচ্ছে। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যসেবা মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। দেশে ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা চরম উষ্ণ দিনগুলোর স্থায়িত্ব বাড়িয়ে তুলতে পারে, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে। এই প্রবণতা দুর্বল জনগোষ্ঠীর জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়। সমীক্ষায় দেখা গেছে, জলবায়ু-সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডের পরিধি বাড়ানো না হলে ২০৫০ সাল নাগাদ জলবায়ু প্রভাবের কারণে বাংলাদেশের বার্ষিক জিডিপির ২ শতাংশ ক্ষতি হতে পারে। দর-কষাকষিতে দক্ষ লোকজনের স্বল্পতার কারণে প্রায়ই উপযুক্ত ফোরামে বাংলাদেশের যথাযথ চিত্র তুলে ধরা সম্ভব হয় না। তবে বাংলাদেশ জলবায়ু নীতিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। ২০২১ সালে জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান (এনডিসি) হালনাগাদ করেছে, যাতে গ্রিনহাউস গ্যাস হ্রাসের জন্য উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যগুলো সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে নবায়নযোগ্য শক্তি, শক্তি দক্ষতা এবং টেকসই কৃষিব্যবস্থা। এই লক্ষ্যগুলো অর্জন করা নির্ভর করছে উন্নত দেশগুলো থেকে যথেষ্ট আর্থিক সহায়তা এবং প্রযুক্তি স্থানান্তরের ওপর। কপ ৩০-এর কেন্দ্রীয় বিষয়ের মধ্যে তাই এটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

 

Related Articles

Back to top button