টাইমস ২৪ ডটনেট: ইউরোপের বাইরের দেশগুলো থেকে কর্মী আনার কোটার সংখ্যা ২০২৫ সালে প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে হাঙ্গেরি সরকার। বড়দিনের আগে এই সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ করা হলেও এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত বিস্তারিত জানায়নি দেশটি। এদিকে এমন খবরে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন চাকরির ভিসা নিয়ে হাঙ্গেরিতে যেতে আগ্রাহী বাংলাদেশের কর্মীরা।
ইউরোপের দেশ হাঙ্গেরির একটি এমপ্লয়মেন্ট এজেন্সি থেকে সম্প্রতি নিয়োগপত্র পেয়েছিলেন বাংলাদেশের মশিউর (ছদ্মনাম)। প্রথমে তাকে নিয়োগপত্রের একটি সফট কপি পাঠানো হয়। এরপর ডাকযোগে তার কাছে নিয়োগপত্র এবং ভিসার আবেদনের জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য কাগজপত্রের মূলকপি পাঠানো হবে বলে জানানো হয়। ইউরোপে বড়দিনের ছুটি শুরু হয়ে যাওয়ায় চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানটির কাগজপত্র পাঠাতে সময় লাগছিল বলে জানান তিনি।কাগজপত্রের অপেক্ষায় থাকা মশিউর বাংলাদেশে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিএলএসের মাধ্যমে হাঙ্গেরির ভিসার জন্য আবেদনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। বিএলএস বাংলাদেশ থেকে হাঙ্গেরিতে যাওয়ার জন্য ভিসার আবেদন জমা নিয়ে থাকে।
মশিউর বলেন, জন্মসনদ, শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ, ব্যাংক একাউন্টসহ প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র প্রস্তুত করে তিনি ভিসা আবেদনের অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু বড়দিনের ছুটির পর তিনি জানতে পারেন, আপাতত ভিসা আবেদন করা যাচ্ছে না।শুধু মশিউরই নন, কাজ নিয়ে হাঙ্গেরিতে যেতে আগ্রহী বাংলাদেশিদের বিভিন্ন ফেসবুক পেইজেও এমন অভিযোগ করছেন অনেকেই। বিদেশ থেকে কর্মী আনার বিষয়ে নতুন নিয়ম জারি করেছে হাঙ্গেরি সরকার। এ বিষয়ে বড়দিনের আগে নতুন এক গেজেট প্রকাশ করে দেশটি। সেই গেজেটে ২০২৫ সালে বিদেশি কর্মীর কোটার সংখ্যা প্রায় অর্ধেক কমিয়ে আনার কথা বলা হয়।
• হাঙ্গেরি সরকারের নতুন আইন
ভিক্টর অরবান সরকারের প্রকাশিত নতুন গেজেটে ইউরোপের বাইরের দেশ অর্থাৎ তৃতীয় দেশ থেকে কর্মী নিয়োগের বিষয়ে দু’টি পরিবর্তন আনা হয়েছে। এর একটি হলো গেস্ট ওয়ার্কার বা বিদেশ থেকে আনা কর্মী সংক্রান্ত বিধি আর অপরটি এমপ্লয়মেন্ট বেইজড রেসিডেন্স পার্মিট বা কর্মসংস্থানের ভিত্তিতে বসবাসের অনুমতি সংক্রান্ত বিধি।
• গেস্ট ওয়ার্কার রেসিডেন্স পারমিট
তৃতীয় দেশ থেকে অর্থাৎ ইউরোপের বাইরের দেশ থেকে কর্মী আনার লক্ষ্যে ২০২৩ সালের শেষ দিকে গেস্ট ওয়ার্কার রেসিডেন্স পারমিট নামে কর্মসূচি চালু করেছিল হাঙ্গেরি সরকার। কর্মসূচির আওতায় ১০টি দেশ থেকে শ্রমিকদের চাকরির সুযোগ দেওয়া হয়। দেশগুলো হলো, ব্রাজিল, কলম্বিয়া, জর্জিয়া, ইন্দোনেশিয়া, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, মঙ্গোলিয়া, ফিলিপাইন, ভেনেজুয়েলা এবং ভিয়েতনাম। তবে এই তালিকায় নাম ছিল না বাংলাদেশের।
হাঙ্গেরি সরকারের নতুন গেজেট অনুযায়ী, ২০২৫ সালে দু’টি দেশ থেকে গেস্ট ওয়ার্কার কর্মসূচির আওতায় কর্মী নিয়োগ দিতে পারবে হাঙ্গেরির প্রতিষ্ঠানগুলো। দেশ দু’টি হলো জর্জিয়া এবং আর্মেনিয়া। অর্থাৎ, ২০২৫ সালে শুধু ওই দু’টি দেশ থেকেই গেস্ট ওয়ার্কার কর্মসূচির আওতায় হাঙ্গেরিতে কাজ করার সুযোগ পাবেন কর্মীরা।
• এমপ্লয়মেন্ট বেইজড রেসিডেন্স পার্মিট
হাঙ্গেরি সরকারের একটি উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি হলো এমপ্লয়মেন্ট বেইজড রেসিডেন্স পার্মিট। শর্ত পূরণ সাপেক্ষে এই কর্মসূচির আওতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে হাঙ্গেরিতে কাজ করার সুযোগ পান বিদেশিরা। হাঙ্গেরি সরকারের নতুন গেজেটে এই কর্মসূচিতে কোনও পরিবর্তন আনা হয়নি।
• কমানো হয়েছে কোটা
তবে সরকারের গেজেট বলছে, দুই কর্মসূচি মিলিয়ে ২০২৫ সালে ৩৫ হাজার কর্মীকে হাঙ্গেরিতে কাজের সুযোগ প্রদান করা হবে। ২০২৪ সালে এই সংখ্যা ছিল ৬৫ হাজার। অর্থাৎ ২০২৫ সালে কর্মীর সংখ্যা প্রায় অর্ধেক কমিয়ে আনছে হাঙ্গেরি। গেজেট বিষয়ক ঘোষণায় হাঙ্গেরির নাগরিকদের সুবিধা বাড়ানোর লক্ষ্যের কথা বলা হয়।
ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবান বলেন, হাঙ্গেরি হাঙ্গেরিয়ানদের জন্য। আমি চাই না হাঙ্গেরি গেস্ট ওয়ার্কারদের দেশ হয়ে উঠুক। এ কারণেই আমরা অভিবাসীদের আসতে দিই না। আর গেস্ট ওয়ার্কার হিসেবে আমাদের যতটুকু দরকার।
তিনি বলেন, বিশাল সংখ্যার গেস্ট ওয়ার্কারদের মাধ্যমে হাঙ্গেরির অর্থনীতির শ্রম সংকটের সমস্যা সমাধান করা খুব সহজ। কিন্তু এই পরামর্শ দিই না। চলুন সর্বশেষ হাঙ্গেরিয়ান খুঁজে বের করি, তাকে কাজ দিই এবং মজুরি দিই। চলুন তার কাজের স্বীকৃতি দিই।
গেস্ট ওয়ার্কার কোটার মতো এমপ্লয়মেন্ট বেইজড রেসিডেন্স পার্মিট প্রদানের বিষয়টিও নির্দিষ্ট কিছু দেশের জন্য সীমিত করে দেওয়া হবে কি না, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনও নির্দেশনা পাওয়া যায়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, হাঙ্গেরি সরকার বিষয়টি নির্দিষ্ট কিছু দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ করতে পারে।
হাঙ্গেরির ব্যবসা ও অভিবাসন-বিষয়ক পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান ‘হেলপারস’ বলেছে, এমপ্লয়মেন্ট বেইজড রেসিডেন্স পারমিট ২০২৪ সালের শেষ পর্যন্ত ইউরোপের বাইরের সব দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য থাকলেও নতুন বছরে তা নির্দিষ্ট কিছু দেশের জন্য সীমিত হয়ে পড়তে পারে।
প্রতিষ্ঠানটির মতে, বিষয়টি নির্ভর করবে সেসব দেশের ওপর যাদের হাঙ্গেরিতে দপ্তর রয়েছে এবং তাদের নাগরিকদের আইন অনুযায়ী নিজ দেশে ফেরত যেতে কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখছে তার ওপর।
• বাংলাদেশিদের উদ্বেগ
হাঙ্গেরি সরকারের এমন ঘোষণার পর বাংলাদেশের যেসব কর্মী চাকরি নিয়ে দেশটিতে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাঙ্গেরিতে চাকরিপ্রার্থীদের বিভিন্ন গ্রুপে এ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের তথ্য ছড়িয়ে পড়তেও দেখা যায়।
অনেকেই দাবি করছেন, বাংলাদেশে অবস্থিত হাঙ্গেরি কনস্যুলেট আপাতত কোনও আবেদন জমা নিচ্ছে না। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে হাঙ্গেরি সরকারের বাংলাদেশ কনস্যুলেটে ই-মেইল করা হলেও কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি।
হাঙ্গেরিতে চাকরি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন মুজাহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, বাংলাদেশের যে এজেন্সির মাধ্যমে তিনি চেষ্টা করছিলেন সেই এজেন্সি তাকে কিছুদিনের মধ্যে নিয়োগপত্র পাওয়া যাবে এমন আশ্বাস দিয়েছিল।
নতুন পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন মুজাহিদুল হাঙ্গেরির ভিসা প্রক্রিয়ার যাচাই-বাছাইয়ে নিয়োজিত বিএলএসে ই-মেইল করেন। উত্তরে তাকে জানানো হয়েছে আপাতত কোনও ভিসা আবেদন গ্রহণ করা হচ্ছে না।
এদিকে, আরেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ভিএফএস তাদের ওয়াবসাইটে এই বিষয়ে দেওয়া ঘোষণায় বলেছে, হাঙ্গেরি সরকারের নতুন গেজেটের প্রক্ষিতে দেশটিতে যেতে প্রয়োজনীয় কাজের ভিসার আবেদন আপাতত গ্রহণ করা হচ্ছে না। উল্লেখ্য, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ভিএফএস বিশ্বের অনেক দেশের ভিসা আবেদন প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে সহযোগিতা করে থাকে।
এ বিষয়ে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, হাঙ্গেরি সরকারের নতুন গেজেটে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের শ্রম বাজারের উপরও প্রভাব পড়তে পারে। হাঙ্গেরিতে বাংলাদেশের স্থায়ী কোনও দূতাবাস না থাকায় ভিয়েনায় অবস্থিত দূতাবাসই দেশটিতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে।
বর্তমানে ভিয়েনায় অবস্থিত বাংলাদেশ দূতবাসে কোনও রাষ্ট্রদূত নেই। তবে খুব দ্রুতই বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে একজন রাষ্ট্রোদূত পাঠানো হবে। দূতাবাস সূত্র জানায়, তারা হাঙ্গেরি সরকারের নতুন গেজেটের বিষয়টির ওপর নজর রাখছেন। ইনফোমাইগ্রেন্টস।