সারাদেশ

র‌্যাব পুলিশ ও আনসার পাচ্ছে নতুন পোশাক

টাইমস ২৪ ডটনেট, ঢাকা: বাংলাদেশে র‌্যাব, পুলিশ ও আনসার সদস্যরা পাচ্ছে নতুন পোশাক। নতুনভাবে পুলিশের জন্য আয়রন কালারের পোশাক, র‌্যাব এর জন্য গ্রিন অলিভ এবং আনসারদের জন্য গোল্ডেন হুইট পোশাক নির্বাচন করা হয়েছে। জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুলিশ বাহিনীর সংস্কারসহ তাদের পোশাক পরিবর্তনের দাবি উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত গতকাল সোমবার আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে পুলিশ, র‌্যাব ও আনসার বাহিনীর সদস্যদের নতুন পোশাক পাওয়ার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অথচ সারা দুনিয়ার মানুষ ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে পুলিশ শব্দটির সঙ্গে। ইতিহাস সমৃদ্ধ এই পুলিশ বাহিনী যুগে যুগে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দিচ্ছে, তাদের নিয়ে রয়েছে নানা সমালোচনাও। পুলিশের প্রতি মানুষের রাগ-ক্ষোভ, দুঃখ-আহাজারি, ঘৃণা যেমন আছে; তেমনি অন্যদিকে গর্ব, ভালোবাসা ও সম্মানও রয়েছে।
জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর ৭ দিন পুলিশকে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। তাদের মনে যেমন ভয়-আতঙ্ক ছিল, তেমনি কাজে ফিরতে বিভিন্ন ধরনের দাবিও উত্থাপন করেন তারা। এরই মধ্যে পোশাক ও লোগো পরিবর্তনসহ অন্তর্বতী সরকার থেকে নানা আশ্বাস পেয়ে কাজে ফিরেছে পুলিশ। গতকাল সোমবার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির সভায় তিন বাহিনীর পোশাক পরিবর্তনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.) এ সময় পুলিশ, র‌্যাব ও আনসারের জন্য পোশাক সিলেক্ট করেন। ১৮টি পোশাক পরিহিত পুলিশ, আনসার ও র‌্যাবের প্রতিনিধিদল বৈঠকে উপস্থিত হয়। এই ১৮টি পোশাক থেকে তিন বাহিনীর জন্য তিনটি পোশাক চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়।
এর আগে গত ১১ আগস্ট পুলিশের ইউনিফর্ম ও লোগো পরিবর্তন করা হবে বলে জানিয়েছিলেন অন্তর্বতী সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেছিলেন, পুলিশের ইউনিফর্ম, লোগো সব পরিবর্তন করা হবে। অনেকের মন ভেঙে গেছে, এই ইউনিফর্ম পরে পুলিশ আর কাজ করতে চাইছে না। খুব দ্রুতই তা পরিবর্তন করা হবে। এসব বিষয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তিনি আরও জানিয়েছিলেন, পুলিশ কমিশন হওয়া উচিত। সেই কমিশনের অধীনে পুলিশ পরিচালিত হবে। তারা কোনো রাজনৈতিক দলের অধীনে থাকবে না। পুলিশকে যেন রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার না করা হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
গতকাল সোমবার আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর পুলিশ বাহিনী সংস্কারের দাবি উঠে। একইসঙ্গে পুলিশের পোশাক পরিবর্তন দাবি উঠে। পুলিশের পোশাক হবে লোহার (আয়রন) রংয়ের। র‌্যাবের পোশাক হবে জলপাই (অলিভ) রংয়ের। আর আনসারের পোশাক হবে সোনালি গমের (গোল্ডেন হুইট) রংয়ের। পুলিশ, র‌্যাব ও আনসারের পোশাক পরিবর্তনের কারণ জানতে সম্পর্কে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, সবার মন-মানসিকতা পরিবর্তন করা জরুরি। সে জন্য পুলিশ, র‌্যাব ও আনসারের পোশাক পরিবর্তন করা হচ্ছে। কবে থেকে পোশাক পরিবর্তন হবে, তা জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ধীরে ধীরে পরিবর্তন হবে। পুলিশকে জনবান্ধব করতে হলে বাহিনীটির প্রশিক্ষণে পরিবর্তন আনতে হবে বলে মন্তব্য করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। এ সময় অন্যদের মধ্যে সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী খোদা বখস চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।
সূত্র জানায়, এক সময় বাংলাদেশ পুলিশের পোশাকের রং ছিল খাকি। এই রঙের পোশাকের ইতিহাস ব্রিটিশ আমলের সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশে যখন ব্রিটিশ শাসিত ছিল তখনই পুলিশ ব্যবস্থা চালু হয়েছিল, তবে প্রথম দিকে কোনো নির্ধারিত পোশাক ছিল না। কিছু সময় পর তাদের জন্য সাদা পোশাক করা হয়। কিন্তু এই পোশাক নিয়েও একটা সমস্যা দেখা দেয়, সেটা হল, পুলিশ সদস্যদের সাদা ইউনিফর্ম ডিউটি করার সময় খুব তাড়াতাড়ি নোংরা হয়ে যেত। এতে ব্রিটিশ পুলিশের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা খুবই বিচলিত হয়ে পড়তেন। ফলে নোংরা আড়াল করতে পুলিশ সদস্যরা তাদের ইউনিফর্ম বিভিন্ন রঙে রাঙাতে থাকে, যা ছিল বিব্রতকর। ১৮৪৭ সালে ব্রিটিশ অফিসার স্যার হ্যারি লুমসডেনের পরামর্শে, পুলিশের ইউনিফর্মটি হালকা হলুদ এবং বাদামি রঙে রাঙানো হয়েছিল। তারপর চা পাতা, পানি ব্যবহার করে সুতির কাপড়ের রং রঞ্জকের মতো তৈরি করে ইউনিফর্মের ওপর লাগানো হতো। যার ফলে পোশাকের রং খাকি হয়ে যায়। সেই বছরই পুলিশে খাকি রঙের পোশাক গৃহীত হয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ও বাঙালি পুলিশ সদস্যরা খাকি রঙের পোশাক ব্যবহার করেন। অনেকে অবশ্য ‘সাদা পোশাকেও’ লড়াই করেছেন পাক সেনাদের বিরুদ্ধে। তবে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ পুলিশের পোশাকে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসে ২০০৪ সালে। সেই বছর পুলিশের পোশাক পরিবর্তন করে মহানগরগুলোয় হালকা জলপাই রঙের করা হয়। জেলা পুলিশকে দেওয়া হয় গাঢ় নীল রঙের পোশাক। র‌্যাবের কালো ও এপিবিএনের পোশাক তৈরি করা হয় খাকি, বেগুনি আর নীল রঙের মিশ্রণে। এমনকি ২০০৯ সালেও কিছুটা পরিবর্তন আসে।
কোটা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে পুলিশ বাহিনীর কর্মকাণ্ডের জন্য ক্ষুব্ধ পুরো দেশের মানুষই। তাই অনেক পুলিশ সদস্য পোশাক নিয়ে অস্বস্তির কথাও জানিয়েছেন। এবার নিশ্চিত পরিবর্তন হলেও এই প্রসঙ্গটা পুরনো। ২০২০ সাল থেকেই বাংলাদেশ পুলিশের পোশাক পরিবর্তনের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছিল। ২০২১ সালের শুরুর দিকে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের জন্য বেশ কয়েকটি পোশাকের ট্রায়ালও হয়। তারপরও নানা কারণে নতুন পোশাক পায়নি বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরা।
সম্প্রতি পুলিশের পোশাক ও লোগো পরিবর্তনের বিষয়ে দশ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে পুলিশ সদর দফতর। উন্নত বিশ্বের ১০-১৫টি দেশের পুলিশের ইউনিফর্ম বিশ্লেষণ করছে বাংলাদেশ। এসব দেশের পুলিশের কাপড়ের মান বিবেচনায় রেখেই নতুন ইউনিফর্মের মান নির্ধারণ করা হচ্ছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী নতুন ইউনিফর্মেও থাকছে হাফ ও ফুলহাতা শার্টের ব্যবস্থা। বিশ্বজুড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাক দুই ভাবে নির্ধারণ করা হয়। দেশ-কালের ওপর ভিত্তি করে সেবাসংস্থাগুলোর পোশাক নির্ধারণ করা হয় বেশিরভাগ সময়েই। যেমন শীতপ্রধান দেশগুলোর পুলিশের পোশাকের রং হয় কালো রঙের। সেখানে তাপমাত্রা ধরে রাখার একটা বিষয় পোশাকে যুক্ত থাকে। গরম বা নাতিশীতষ্ণদেশগুলোতে পুলিশের পোশাক সাদা, খয়েরি বা হালকা রঙের দেখা যায়, যা কিনা তাপ শোষণ কম করে। ভারত বা এই অঞ্চলে বিভিন্ন সেবাসংস্থার পোশাক খাকি হওয়ার আরেকটি কারণ ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ইতিহাস। ব্রিটিশ পুলিশ হাফ প্যান্ট এবং সাদা রং নির্বাচন করেছিলেন। কারণ এই রংটি সূর্যের তাপকে প্রতিফলিত করে গরমের থেকে রক্ষা করে। বিশেষ করে উষ্ণ আবহাওয়ার কারণে তারা হাফ প্যান্ট পরতো। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনেক আগেই তা বদলে গেছে।
বাংলাদেশ পুলিশের সদস্য সংখ্যা প্রায় দুই লাখ। বাহিনীর পক্ষ থেকেই সকল পুলিশ সদস্যকে পোশাক সরবরাহ বা অর্থায়ন করা হয়। ফলে এই বিপুল সংখ্যক সদস্যের পোশাক পরিবর্তন বাবদ একটা বড় অঙ্কের অর্থ খরচ করতে হবে। এমনকি লোগো পাল্টাতে গেলেও বাড়তি ব্যয় হবে। কারণ স্থাপনা, যানবাহনসহ অনেক ক্ষেত্রে নতুন লোগো প্রতিস্থাপন করতে হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম জানান, বাংলাদেশ পুলিশ, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) ও আনসারের পোশাক পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে অন্তর্বতী সরকার। এ নিয়ে নিজের অভিমত জানিয়েছেন তার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক প্রোফাইলে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে। ওই স্ট্যাটাসে সারজিস আলম বলেন, স্বভাব, চরিত্র, খাসলত পরিবর্তন না করে পোশাক পরিবর্তনে কোনো লাভ নেই। সমস্যা পোশাকে না, পুরো সিস্টেমে।

Related Articles

Back to top button