মিয়ান আরেফি:বাংলাদেশের রাজনীতি ও মানবাধিকার রক্ষার সংগ্রামের ইতিহাসে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিনে ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ঢাকায় একটি বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেই সমাবেশে অংশগ্রহণের পর গ্রেপ্তার হই আমিসহ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল ড. সারওয়ার্দী। আমাদের কারাবন্দী জীবন এবং মুক্তির পর অভিজ্ঞতার কথা আজও প্রশ্ন তুলছে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে।
*কারাবন্দী জীবন: অমানবিকতার সাক্ষাৎ*
আমি এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল ড. সারওয়ার্দী প্রায় ১০ মাস ধরে ঢাকা ও কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে আটক ছিলাম। কারাগারে থাকার সময় আমি একাধিকবার শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হই। কাশিমপুর কারাগারের সুপারিনটেনডেন্ট সুব্রত বালা, যিনি আমার মতে একটি দেশের রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার একজন গোপন এজেন্ট, আমার উপর নির্যাতনের নেতৃত্ব দেন।
আমার প্রতিদিনের খাবার এতটাই মশলাদার ছিল যে তা খাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠত। আমাকে নিজের খাবার কিনতে বাধ্য করা হতো। একজন আমেরিকান নাগরিক হিসেবে প্রতিদিন ৫,০০০ টাকা পাওয়ার কথা থাকলেও, আমি এক টাকাও পাইনি। এই অর্থ কোথায় ব্যবহৃত হয়েছে তা নিয়ে কোনো জবাবদিহিতা ছিল না।
*কারাগারের অবস্থা: মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন*
কাশিমপুর কারাগারে চিকিৎসা ও স্যানিটেশনের অবস্থা ছিল ভয়াবহ। আমার কারাগারের কক্ষে ছিল তেলাপোকা, ইঁদুর, টিকটিকি এবং বড় বড় পোকামাকড়। বাথরুমে আধুনিক কোনো সুবিধা ছিল না। হাঁটুর অস্ত্রোপচারের কথা জানার পরও কারাগারের সুপারিনটেনডেন্ট সুব্রত বালা কোনো বিশেষ সুবিধা প্রদান করেননি। বরং তিনি বলতেন, “এটা আমেরিকা নয়, এটা বাংলাদেশ। যা দেখছেন, তাই পাবেন।”
পরিবারের সদস্যরা আমাকে দেখতে এলে তাদের অনুমতি দেওয়া হতো না। এমনকি ঈদের সময় খাবার বা পোশাক নিয়ে আসার অনুমতিও দেওয়া হয়নি। ঈদের দিনগুলোতে আমার হৃদয় ভেঙে যেত।
*মুক্তি এবং নতুন জীবন*
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকার পদত্যাগ করে এবং ভারতে পালিয়ে যান। এরপর আমি এবং ড. সারওয়ার্দী কারাগার থেকে মুক্তি পাই। আমরা মনে করি, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা অর্জনের পরেও আমরা প্রকৃত অর্থে স্বাধীন হতে পারিনি। তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আমরা ‘নতুন বাংলাদেশ’ এর স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছি।
মুক্তির পর আমি আমেরিকায় পরিবারের কাছে ফিরে এসেছি। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলতে পারি, ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের শাসনকাল হিটলারের শাসনের থেকেও ভয়াবহ ছিল।
*দায়বদ্ধতার প্রশ্ন: সুব্রত বালার বিচার দাবি*
কাশিমপুর কারাগারের সুপারিনটেনডেন্ট সুব্রত বালার বিচার দাবি করছি। সুব্রত বালা একজন রক্তপিপাসু আওয়ামী লীগার। তার মতো মানুষকে জবাবদিহিতার আওতায় এনে কঠোর শাস্তি প্রদান করতে হবে।
*জনগণের ক্ষোভ এবং আওয়ামী লীগের পতন*
বাংলাদেশের জনগণ ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে তাদের তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। আওয়ামী লীগকে দেশের মাটি থেকে চিরতরে উৎখাত করা উচিত এবং তাদের দল নিষিদ্ধ করা উচিত। গত ১৬ বছরে তারা দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রকে ধ্বংস করেছে।
*‘নতুন বাংলাদেশ’ এর স্বপ্ন*
বর্তমানে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাংলাদেশের দায়িত্ব নিয়েছে। আগের সরকারের ধ্বংসযজ্ঞের কারণে দেশের পুনর্গঠনে সময় লাগবে। আমরা ড্রাকুলা হাসিনাকে গত ১৬ বছর ধরে আমাদের রক্ত শোষার সুযোগ দিয়েছি। এখন সময় এসেছে দেশের জন্য নতুন পথে এগিয়ে যাওয়ার।
*শেষ কথা*
আমার হৃদয়বিদারক অভিজ্ঞতা শুধু একজন ব্যক্তির কষ্টের কাহিনী নয়, এটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। আমার বক্তব্য দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি ও মানবাধিকার রক্ষার পথে নতুন আলো ফেলবে, এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: *ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল কমিটির সদস্য, ওয়াশিংটন ডিসি, যুক্তরাষ্ট্র*