
মিয়ান আরেফি:২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) সদর দপ্তরে ঘটে এক মর্মান্তিক বিদ্রোহ। দুই দিনব্যাপী এই সহিংসতার ঘটনায় প্রাণ হারান ৭৪ জন। তাদের মধ্যে ৫৭ জন ছিলেন সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ অফিসার, যারা বিডিআরে প্রেষণে নিয়োজিত ছিলেন।
বিদ্রোহের পটভূমি
বিডিআর একটি আধাসামরিক বাহিনী, যার প্রধান দায়িত্ব সীমান্ত সুরক্ষা, চোরাচালান প্রতিরোধ এবং সেনাবাহিনীর সহযোগিতা প্রদান। এই বাহিনী বাংলাদেশের সীমান্ত সুরক্ষায় দীর্ঘদিন ধরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। প্রতিবছর “বিডিআর সপ্তাহ” উদযাপন করা হয়। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ছিল বার্ষিক দরবারের দিন। ঐ দিন সকাল থেকে পিলখানার পরিবেশ ছিল উৎসবমুখর।
সকালে দরবার হলে উপস্থিত ছিলেন ১৩৩ জন অফিসার। বিদ্রোহ শুরু হয় যখন একজন বিদ্রোহী সৈন্য দরবার হলে ঢুকে ডিজি মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের দিকে অস্ত্র তাক করে গুলি চালায়। এরপর বিদ্রোহীরা সশস্ত্র অবস্থায় সদর দপ্তরের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল সেনা অফিসারদের হত্যা এবং পিলখানার নিয়ন্ত্রণ দখল করা।
বিদ্রোহীদের কর্মকাণ্ড
বিদ্রোহীরা পিলখানার অস্ত্রাগার লুট করে এবং বিভিন্ন স্থাপনা ধ্বংস করে। তারা ১৬টি গাড়ি পুড়িয়ে দেয় এবং ১৮টি গাড়ি ভাঙচুর করে। সেনা অফিসারদের বাসায় হামলা চালিয়ে পরিবারের সদস্যদের শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করে।
বিদ্রোহীরা দরবার হলে উপস্থিত অফিসারদের জিম্মি করে এবং তাদের অনেককে নির্মমভাবে হত্যা করে। বিদ্রোহের সময় বিদ্রোহীরা গণমাধ্যমে তাদের দাবিগুলো প্রকাশ করে। তবে, এসব দাবি ছিল অস্পষ্ট এবং তাদের কর্মকাণ্ডের তুলনায় অযৌক্তিক।
প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি
বিদ্রোহে ৭৪ জন নিহত হন। নিহতদের মধ্যে ৫৭ জন সেনা অফিসার, ৯ জন বিডিআর সদস্য, ৩ জন পথচারী, ১ জন পুলিশ সদস্য এবং ২ জন সেনা অফিসারের স্ত্রী ছিলেন। এ ছাড়া অনেকেই আহত হন এবং অনেক পরিবার তাদের আপনজনকে হারিয়ে শোকাহত হয়।
তদন্ত কার্যক্রম
এই ঘটনার পর সরকার ১০ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। সাবেক সচিব আনিস-উজ-জামান খানের নেতৃত্বে এই কমিটি বিদ্রোহের কারণ ও পটভূমি অনুসন্ধান করে। কমিটি বিভিন্ন সাক্ষ্য ও প্রমাণ সংগ্রহ করে এবং বিদ্রোহীদের উদ্দেশ্য এবং পরিকল্পনা সম্পর্কে বিশদ বিশ্লেষণ করে।
তদন্ত কমিটির কার্যপরিধি ছিল:
বিদ্রোহের কারণ চিহ্নিত করা।
দায়ী ব্যক্তিদের শনাক্ত করা।
ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে সুপারিশ প্রদান।
তবে, কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে ষড়যন্ত্রের মূল পরিকল্পনাকারীদের চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি।
বিদ্রোহের সম্ভাব্য কারণ
তদন্তে উঠে আসে যে, বিডিআর সদস্যদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষোভ জমে ছিল। এটি কিছু যৌক্তিক দাবির পাশাপাশি অযৌক্তিক কারণেও সৃষ্টি হয়েছিল। অনেক সদস্য মনে করতেন, তাদের প্রতি অবিচার করা হচ্ছে।
তদন্তে আরও জানা যায়, কিছু ডিএডি (উপ-সহকারী পরিচালক) তাদের বক্তব্য এবং কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সাধারণ সৈন্যদের বিদ্রোহে উস্কে দেন। বিদ্রোহীরা দাবি করেছিল, তাদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে এবং সেনা অফিসারদের পরিবর্তে তাদের নিজেদের অফিসার নিয়োগ দিতে হবে। তবে, এই দাবিগুলোর পেছনে প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল বিদ্রোহের মাধ্যমে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল।
বিচার ব্যবস্থা নিয়ে মতামত
শেখ হাসিনা বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। ২০০৯ সালের পিলখানা বিদ্রোহে, যা বিডিআর ট্র্যাজেডি বা পিলখানা গণহত্যা হিসেবে পরিচিত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদ্রোহীদের জন্য সাধারণ ক্ষমার প্রস্তাব দেন, তবে সেনা কর্মকর্তাদের হত্যার সাথে জড়িতদের জন্য এটি প্রযোজ্য ছিল না।
এছাড়া, জামায়াতে ইসলামী নেতারা অভিযোগ করেছেন যে শেখ হাসিনার নির্দেশে বিদ্রোহের নামে মেধাবী সেনা কর্মকর্তাদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। সম্প্রতি, বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় শেখ হাসিনা ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এদিকে, ইউনুস সরকারের তদন্ত শুরু হয়েছে এবং শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আবারও অভিযোগ উঠেছে যে তিনি এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিলেন।
এমন ব্যক্তিদের অবশ্যই সামরিক বিচার ব্যবস্থার সামনে দাঁড় করানো উচিত, বেসামরিক বিচার প্রক্রিয়ার সামনে নয়! কারণ ঘটনার সময় অভিযুক্ত ব্যক্তি সামরিক দায়িত্বে ছিলেন। সামরিক বিচার সহজ এবং দ্রুত। বেসামরিক বিচার খারাপ এবং আইনজীবীদের দ্বারা সহজেই প্রভাবিত হতে পারে।
আমার মনে হয়, প্রধান উপদেষ্টার আশেপাশে থাকা আমলারা এবং অপরাধীরা ড. ইউনূসকে সরাসরি ভুল পথে পরিচালিত করছে। এখন ড. ইউনূসকে অবশ্যই একজন শাসক বা রাজার মতো আচরণ করতে হবে। তাকে বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশের সুরক্ষার জন্য নির্বাচিত করা হয়েছিল। বর্তমান সংকটের সমাধান অযৌক্তিক নমনীয়তা নয়।
ভবিষ্যৎ সুপারিশ
তদন্ত কমিটি সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয় বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয়। তারা প্রস্তাব করে:
বিদ্রোহ বা শৃঙ্খলা ভঙ্গের মতো ঘটনার ক্ষেত্রে দ্রুত এবং কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
সীমান্ত সুরক্ষায় বিডিআর সদস্যদের প্রশিক্ষণ এবং মনোবল বাড়াতে হবে।
বাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা ও নৈতিকতা নিশ্চিত করতে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
জাতির জন্য শিক্ষা
পিলখানা বিদ্রোহ বাংলাদেশের ইতিহাসে এক মর্মান্তিক অধ্যায়। এটি আমাদের সীমান্ত নিরাপত্তা এবং সামরিক-বেসামরিক সমন্বয়ের গুরুত্ব সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে শেখায়। এই ঘটনার মাধ্যমে জাতি শিখেছে, বাহিনীর অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো উপেক্ষা করলে তার পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে।
জাতি আজও এই শোকাবহ ঘটনাকে স্মরণ করে এবং আশা করে, ভবিষ্যতে এ ধরনের ট্র্যাজেডি আর কখনো ঘটবে না। পিলখানা বিদ্রোহ আমাদের শেখায়, জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ঐক্যবদ্ধ থাকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক: ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল কমিটির সদস্য, ওয়াশিংটন ডিসি, যুক্তরাষ্ট্র।