মিয়ান আরেফি:বাংলাদেশের সংকট এবং পুনরুদ্ধারের পথ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে, আমাদের দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে বুঝতে হবে। আওয়ামী লীগ সরকারের শাসন ব্যবস্থা এবং সরকারের কার্যকলাপের কারণে নানা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়, যার প্রভাব পড়ে জনগণের ওপর।
এসব সংকট কাটিয়ে উঠতে সঠিক নেতৃত্ব, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং জনগণের অংশগ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশের পুনরুদ্ধারের পথ হলো এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে মানুষের মৌলিক অধিকার, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতা সুনিশ্চিত হবে।
২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর আমরা হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ র্যালি করি। পরের দিন, ২৯ অক্টোবর, ঢাকা বিমানবন্দর থেকে আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পর দিন গ্রেফতার করা হয় লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) ড. সারওয়ার্দীকে। আমরা দুজন কাশিমপুর এবং ঢাকা কারাগারে প্রায় ১০ মাস আটক ছিলাম।
গত বছরের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের প্রভাবশালী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যূত্য হন। ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের মুখে ভারতে পালিয়ে যান। এরপর আমরা আল্লাহর অশেষ রহমতে মুক্তি পাই। কারাগারের জীবন ছিল অত্যন্ত কঠিন এবং যন্ত্রণাদায়ক।
আমিই একমাত্র ব্যক্তি, দীর্ঘ ১৬ বছর পর ফ্যাসিবাদী সরকার হাসিনা ও তার শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছি। নিরপরাধ মানুষের রক্ষার্থে এবং বাংলাদেশকে রক্ষা করতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানাই, যাতে সঠিক মানুষ সঠিক জায়গায় থাকেন।
বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা খুবই জটিল। বর্তমানে হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। দাবি করা হয়, তারা ৫০,০০০ নিরপরাধ মানুষের প্রাণ নিয়েছে। এর মধ্যে ক্রসফায়ারের ঘটনাও রয়েছে। এ বিষয়ে জবাবদিহিতার প্রশ্ন উঠেছে।
বাংলাদেশের মানুষ যুগের পর যুগ মৌলিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামে লিপ্ত। তারা দারিদ্র্য, বেকারত্ব, ন্যায্য মজুরি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, বাসস্থান, বিচার ও নিরাপত্তার সংকটে ভুগছেন।
নিরপেক্ষ ভোটাধিকার এবং পরিবেশ সুরক্ষা নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে। দেশের বাইরের শক্তিগুলো বিভিন্ন উপায়ে রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক সংকট সৃষ্টি করছে। এতে দেশের স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়ছে।
বাংলাদেশের অগ্রগতি ব্যাহত করতে কিছু খারাপ শক্তি সক্রিয় ছিল। তারা রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে এবং দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করেছে।
২০০৭ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর বিভাজন সৃষ্টি করে তারা। ১/১১-এর সময়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনতে নির্বাচনী কারচুপি করা হয়। ২০০৯ সালে বিএডিআর হত্যাকাণ্ড ঘটে। ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলাম গণহত্যার ঘটনা ঘটে। ২০১৪ সালে ভোটবিহীন নির্বাচন হয়।
২০১৮ সালে নির্বাচনী কারচুপি, অপহরণ, গুম, ব্যাংক লুট এবং রাজনৈতিকীকরণ দেশকে ফ্যাসিবাদের দিকে ঠেলে দেয়।
২০২৪ সালে জনগণের আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়। ছাত্র আন্দোলন গণবিদ্রোহে রূপ নেয়। এতে শেখ হাসিনা দিল্লি পালিয়ে যান।
তবে, শেখ হাসিনার উস্কানিমূলক বক্তব্য দেশে অস্থিরতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে।
বাংলাদেশ পুনরুদ্ধারে সঠিক নেতৃত্ব প্রয়োজন। গণতান্ত্রিক সংস্কার এবং জনগণের অংশগ্রহণ জরুরি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া স্থিতিশীলতা ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা অসম্ভব। বিশ্বের বিপ্লব ও সংগ্রাম রাজনৈতিক মানচিত্রে গভীর প্রভাব ফেলেছে। ১৭৭৬ সালের আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম স্বাধীনতার ধারণা ছড়িয়ে দেয়। ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব ইউরোপে সমতা ও বন্ধুত্বের বার্তা বহন করে।
১৯১৭ সালে সোভিয়েত বলশেভিক বিপ্লব সমাজতন্ত্রের উত্থান ঘটায়। ১৯৪৯ সালে চীনের বিপ্লব জনগণের বিজয় প্রতিষ্ঠা করে। ভিয়েতনামের দীর্ঘ সংগ্রাম এবং কিউবার বিপ্লবও বিশ্বে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। কোরিয়া ও ইরানের সংগ্রাম তাদের জাতির ভাগ্য বদলে দেয়।
এসব বিপ্লব শুধু নিজ নিজ দেশের উন্নতি ঘটায়নি। তারা সভ্যতার ওপরও স্থায়ী প্রভাব ফেলেছে। তবে, বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান বারবার রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্যেও অধিকার হারিয়েছে।
বাংলাদেশে সম্প্রতি জুলাই-অগাস্টের গণঅভ্যুত্থান নতুন আশা দেখিয়েছে। ছাত্র, শ্রমজীবী ও সাধারণ মানুষের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম জনগণের আশা জাগিয়েছে। টাইম ম্যাগাজিন ২০০৬ সালে বাংলাদেশকে ‘উদীয়মান বাঘ’ বলে আখ্যা দেয়। সেবছর প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ৯ শতাংশ। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে দেশের অর্থনীতি দ্বিগুণ হতে পারে। কিন্তু ২০০৭ সালে ১/১১ সন্ত্রাসী অভ্যুত্থান দেশের অগ্রগতিকে থামিয়ে দেয়। বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপে পুতুল সরকার ক্ষমতায় আসে। এতে দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। জুলাই-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের রাজনীতি নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছে। দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদদের দায়িত্ব হলো- কোনো ভুল যাতে দেশকে পিছিয়ে না দেয় তা নিশ্চিত করা।
জুলাই মাসের গণঅভ্যুত্থানের পর দেশে নানা উসকানিমূলক ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনার মধ্যে ইসলামের উহুদ যুদ্ধ একটি শিক্ষণীয় উদাহরণ।
উহুদ যুদ্ধে মহানবী (সা.) নির্দেশ দিয়েছিলেন, পাহাড়ের গলি রক্ষাকারীরা গলি ছেড়ে যাবে না। কিন্তু তারা আদেশ অমান্য করে গলি ছেড়ে লুটপাটে অংশ নেয়। এই সুযোগে শত্রুরা গলি দিয়ে প্রবেশ করে পাল্টা আক্রমণ চালায়। ফলে নিশ্চিত বিজয় শোকাবহ পরাজয়ে পরিণত হয়। এই ঘটনা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার গুরুত্বকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
আমাদেরও ঘরোয়া ও বিদেশি ষড়যন্ত্র দমন করতে হবে। বিজয়ের অর্জন জনগণের দ্বারে পৌঁছাতে হবে। উন্নত দেশগুলো জনগণের মৌলিক অধিকার, শ্রমের মর্যাদা এবং মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করে উন্নয়ন করেছে। বাংলাদেশে এ বিষয়গুলো এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। স্বৈরাচারী প্রশাসন জনগণকে বঞ্চিত করেছে। রাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের সুবিধা বাড়ানো হলেও সাধারণ মানুষের অবস্থা শোচনীয়।
এই ভুল নীতির ফলে দুর্নীতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি রাজনীতিতেও দুর্নীতি সংক্রমিত হয়েছে।
জনগণ চায়, রাজনীতিবিদরা দুর্নীতি থেকে দূরে থাকুন। যারা নিজ স্বার্থে কাজ করতে চান, তারা রাজনীতি না করে অন্য পেশা বেছে নিন।
দেশের উন্নতির জন্য দরকার সৎ নেতৃত্ব এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা। বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের নেতা, কর্মী এবং সমর্থকরা দুর্নীতি ও শোষণ বন্ধ করতে চান। তারা অবহেলিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে। বাংলাদেশে অসংখ্য তরুণ, যুবক ও যুবতী সমাজের কল্যাণে এবং বৈষম্য মুক্তির লক্ষ্যে রাজনীতি করছেন। কৈশোরের আবেগ পেরিয়ে অনেক রাজনৈতিক নেতা ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।
এই পথে তারা বারবার অত্যাচার ও কারাবরণ করছেন। তবুও, অধিকাংশ নেতা ও কর্মী ব্যক্তিগত স্বার্থ ত্যাগ করে সত্যের পথে এগোচ্ছেন।
তারা হেনস্থার শিকার হচ্ছেন এবং ব্যর্থতার জন্য অভিযুক্ত হচ্ছেন। কিন্তু শত প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও তারা তাদের লক্ষ্য থেকে পিছপা হচ্ছেন না।
লাখ লাখ ছাত্র, শ্রমিক ও অবহেলিত মানুষ তাদের শ্রম, ঘাম ও জীবন দিয়ে বারবার বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন। কিন্তু যাদের জন্য এই ত্যাগ, তারাই এখন সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত।
আধিপত্যবাদ ও তাদের মিত্ররা বাংলাদেশের জনগণের অধিকার দমন করতে অপকর্ম চালাচ্ছে। পরাজিত স্বৈরাচারের মিত্ররা দুর্নীতি, নৈতিক অবক্ষয় ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে। ফলে সাধারণ মানুষ এখন সহজে কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তবুও, ছাত্র, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে নতুন ইতিহাস গড়েছে। তারা শোষণমুক্ত একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগ্রাম করছে। তাদের প্রত্যাশা, জুলাই মাসের গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনীতি সাধারণ মানুষের মুক্তির মাধ্যম হবে।
সমাজে ন্যায়, সমতা, সততা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ভিত্তিতে একটি রাষ্ট্র গড়ে উঠবে। আমাদের প্রধান লক্ষ্য, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে একটি মানবিক সমাজ গঠন করা।
লেখক: ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল কমিটির সদস্য, ওয়াশিংটন ডিসি, যুক্তরাষ্ট্র।