মিয়ান আরেফি:বাংলাদেশকে স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য গত দুই বছরে আমি বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। এই সময়কালে বাংলাদেশে থেকে জনগণের দুর্দশা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বাস্তব চিত্র প্রত্যক্ষ করেছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গিয়ে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য আমি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করেছি। নিচে এই প্রচেষ্টার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হলো।
প্রথমবার আমি আমার মাতৃভূমি বাংলাদেশ দেখতে গিয়েছিলাম ২৩ মার্চ ২০২২। আমি সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলাদেশে ছিলাম এবং ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসার পর ২৩ ডিসেম্বর ২০২২-এ আমি মিস কালা, স্টেট ডিপার্টমেন্ট ওয়াশিংটন ডিসি-তে একটি ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম এবং বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট সরকার ও তাদের শাসন সম্পর্কে তাকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছিলাম। মিস কালা সব শুনলেন এবং একটি বড় নোট নিলেন। আমি তাকে বলেছিলাম যে আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশকে বাঁচাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের কাছ থেকে তড়িৎ সাহায্য প্রয়োজন।
বাংলাদেশে থাকাকালীন প্রায় ছয় মাস আমার সফর সুখকর ছিল না। অহংকারী ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকারের শাসন এবং তার গুন্ডারা অন্যদিকে শাসন করায় সেখানে আইন-শৃঙ্খলা, মানবাধিকার, বাক-স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং জননিরাপত্তা কিছুই ছিল না।
একজন মার্কিন নাগরিক এবং ডাই-হার্ড ডেমোক্র্যাট সমর্থক হিসেবে আমি অনুভব করেছি যে, বাংলাদেশের গণতন্ত্রপ্রিয় জনগণের জন্য বাংলাদেশে পরিবর্তন আনার জরুরি কাজ করতে হবে।
সবকিছু দেখে ও পর্যবেক্ষণ করার পর আমি সমস্ত বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে দেখা করা শুরু করি, যারা অত্যন্ত সৎ ও বিশ্বস্ত। সবার কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া পেয়েছি যে, আমাদের ফ্যাসিবাদী প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকে পরিবর্তন করতে হবে এবং একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে যা সমস্ত বাংলাদেশী ভাই-বোনের কাছে গ্রহণযোগ্য।
ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসও পরিদর্শন করেছি এবং আমাদের স্টেট ডিপার্টমেন্টের মিস সোফিয়া (ফরেন অ্যাফেয়ার্স অফিসার) এবং মি. ম্যাথু বেহ (রাজনৈতিক কর্মকর্তা)-এর সঙ্গে আমেরিকান ক্লাবে একাধিকবার ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার নিয়েছি।
আমি অনেক সামরিক ও বেসামরিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি। এছাড়াও আমি ঢাকার বিভিন্ন থানা, পাবনা ও উল্লাপাড়া উপজেলা পরিদর্শন করেছি। জনগণ এবং পুলিশ অফিসারদের (ওসি) দ্বারা দুর্নীতি, চাঁদাবাজি এবং নির্যাতনের ঘটনাও প্রত্যক্ষ করেছি।
শুধুমাত্র আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশকে বাঁচানোর জন্য ২০২২ এবং ২০২৩ সালে আমি ওয়াশিংটন ডিসি এবং বাংলাদেশের মধ্যে চার-পাঁচবার ভ্রমণ করেছি। বিভিন্ন ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার নিয়েছি এবং সবার একটাই মতামত পেয়েছি—আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশকে বাঁচাতে হবে।
বাংলাদেশে থাকাকালীন এক পর্যায়ে আমি একজন সৎ ও বিশ্বস্ত ব্যক্তি লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) ড. সারওয়ার্দীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সুযোগ পাই এবং আমরা এক পরিবারের সদস্য হয়ে যাই। লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) ড. সারওয়ার্দী এবং তার স্ত্রী মিস ব্রাউনিয়া ফ্যাসিবাদী প্রধানমন্ত্রী হাসিনার দ্বারা নানা ভাবে নির্যাতিত হয়েছেন। আমরা প্রায় প্রতিদিনই তার বাসভবনে আলোচনা করেছি—কীভাবে আমরা আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশকে বাঁচাতে পারি।
সারওয়ার্দীর বিরোধী দলের অনেক সৎ নেতাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রয়েছে। তার বাসভবনে আমরা অনেক মিটিং করেছি এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, আমরা বড় সমাবেশ করব এবং ঢাকা শহরের প্রতিটি রাস্তা অবরোধ করব। আমরা হাসিনার পদত্যাগ চাইব এবং তিনি পদত্যাগ না করা পর্যন্ত আমাদের বিক্ষোভ চালিয়ে যাব।
আমরা অবশেষে ২৮ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে সমাবেশের তারিখ নির্ধারণ করি এবং বিএনপির কাছে সাহায্য ও সমর্থন চেয়েছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে তারেক জিয়াকে হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠাই এবং মির্জা ফকরুল ও মির্জা আব্বাসের সঙ্গেও যোগাযোগ করি।
অক্টোবর ২৮ তারিখে আমাদের সমাবেশে হাসিনা সরকারের নৃশংস হামলার পর আহত জনতাকে দেখতে আমি ব্যক্তিগতভাবে সমাবেশস্থলে যাই। বিএনপির আহত কর্মীদের দেখতে তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও গিয়েছি এবং বাংলাদেশের গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছি। এ সময় আমি যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশের প্রতি প্রত্যাশা, হাসিনার পাতানো নির্বাচন এবং আসন্ন রাজনৈতিক পরিবর্তন সম্পর্কে কিছু কথা উল্লেখ করেছি।
২৯ অক্টোবর ২০২৩-এ যখন আমি ওয়াশিংটন ডিসির উদ্দেশ্যে রওনা হই, তখন ঢাকা বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন সার্ভিস আমাকে আটক করে। পরদিন লে. জে. সারওয়ার্দীকেও আটক করা হয়। আমরা দুজনেই প্রায় দশ মাস বাংলাদেশের কারাগারে বন্দি ছিলাম।
ডিবি হারুনের হেফাজতে থাকাকালীন আমার বিরুদ্ধে গুজব ও মিথ্যা সংবাদ ছড়ানো হয় যে, ‘মিয়াঁ আরেফি একজন ভুয়া ব্যক্তি।’ এটি আমার পারিবারিক জীবন এবং সততাকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য করা হয়েছিল। উল্লেখ্য, আমি মার্কিন প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য, তবে রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের ব্যক্তিগত উপদেষ্টা নই।
ডিবি হারুন অত্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত এবং অহংকারী। তার প্রচুর কালো টাকা রয়েছে, যা তাকে একজন কুখ্যাত অপরাধী বানিয়েছে। তবে আজ কোথায় সেই আওয়ামী লীগ এবং তাদের ফ্যাসিবাদী সরকার?
জুন ২০২৪-এর শেষ দিকে বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হলে সরকার আন্দোলন দমন করতে দেড় মাসে প্রায় ২,০০০ মানুষ হত্যা করে। এর পর সারা দেশের মানুষ রাস্তায় নেমে এলে ৫ আগস্ট ২০২৪ ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান।
হাসিনার পদত্যাগের পর আমি এবং লে. জে. সারওয়ার্দী কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগার এবং ঢাকা কারাগার থেকে মুক্তি পাই।
বাংলাদেশের জনগণের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অসাধারণ সদিচ্ছা ও সমর্থন অব্যাহত থাকবে।
লেখক: ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল কমিটির সদস্য, ওয়াশিংটন ডিসি, যুক্তরাষ্ট্র