মতামত

বিডিআর হত্যাকাণ্ড পুনঃতদন্তে কমিশন: নেপথ্যের চিত্র ও প্রত্যাশা

মিয়ান আরেফি:২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহ বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি মর্মান্তিক ও জটিল অধ্যায়। পিলখানায় সংঘটিত এই ঘটনায় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা এবং বেশ কিছু বেসামরিক ব্যক্তি নির্মমভাবে নিহত হন। এই বিদ্রোহ শুধু বাংলাদেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে নাড়া দেয়নি, বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। দীর্ঘ ১৫ বছর পর, এই হত্যাকাণ্ড পুনঃতদন্তে সাত সদস্যের একটি কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

গত মঙ্গলবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ করা হয়। এতে কমিশনের প্রধান হিসেবে সাবেক বিজিবি মহাপরিচালক এ এল এম ফজলুর রহমানের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। কমিশনের অন্য সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন অভিজ্ঞ সামরিক ও প্রশাসনিক ব্যক্তিত্ব, যারা বিডিআর বিদ্রোহের জটিলতার গভীরে যেতে সক্ষম বলে আশা করা হচ্ছে।

বিডিআর বিদ্রোহ: পটভূমি এবং প্রতিক্রিয়া
২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি, পিলখানায় বিডিআর সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত বার্ষিক দরবারে এক অভূতপূর্ব বিদ্রোহ ঘটে। এ বিদ্রোহে সেনা কর্মকর্তাদের উপর বর্বর হামলা চালানো হয়। বিদ্রোহীরা তাদের দাবি আদায়ে সহিংস পন্থা অবলম্বন করে, যার ফলে নিহত হন সেনাবাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা।

এই ঘটনার পর পুরো দেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকারকে প্রচুর কূটনৈতিক এবং সামরিক কৌশল অবলম্বন করতে হয়। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে ঘটনাটি প্রচারিত হলে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

পূর্ববর্তী তদন্ত ও বিচার কার্যক্রম
বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় দুটি মামলা দায়ের করা হয়—একটি হত্যা মামলা এবং আরেকটি বিস্ফোরক আইনে। দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ার পর, ২০১৩ সালে আদালত ১৫২ জনের মৃত্যুদণ্ড এবং ১৬০ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে। তবে বিচার প্রক্রিয়ায় বহু প্রশ্ন উঠেছে। অনেকেই অভিযোগ করেছেন যে, প্রকৃত দোষীদের বাদ দিয়ে শুধুমাত্র ছোট পর্যায়ের কর্মচারীদের শাস্তি দেওয়া হয়েছে।

নিহত সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যরা বারবার অভিযোগ করেছেন, পূর্ববর্তী তদন্তে বিদ্রোহের মূল হোতাদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। এমনকি, উচ্চ পর্যায়ের সামরিক এবং রাজনৈতিক যোগসাজশের সম্ভাবনাকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।

পুনঃতদন্তের প্রয়োজনীয়তা
বিগত ১৫ বছর ধরে নিহত পরিবারের সদস্যরা এবং সংশ্লিষ্টরা ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন। পুনঃতদন্ত কমিশন গঠনের দাবিটি উঠে আসে মূলত পরিবারগুলোর চাপ এবং নাগরিক সমাজের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে।

হাইকোর্ট গত মাসে একটি রুল জারি করে জানতে চায়, কেন বিডিআর হত্যাকাণ্ড পুনঃতদন্তের জন্য কমিশন গঠন করা হবে না। এই রুলের পরিপ্রেক্ষিতেই সরকার কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়।

কমিশনের কাজ ও প্রত্যাশা
কমিশন গঠনের মূল উদ্দেশ্য হলো পূর্ববর্তী তদন্তের অসমাপ্ত কাজগুলো পূর্ণ করা এবং নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিদ্রোহের নেপথ্যের সত্য উদঘাটন করা। কমিশন নথিপত্র পর্যালোচনা, প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ এবং সম্ভাব্য নতুন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করবে।

কমিশনের কার্যক্রমের প্রধান দিকগুলো হতে পারে:

পূর্ববর্তী তদন্তে বাদ পড়া বিষয়গুলো পুনঃপর্যালোচনা।
বিদ্রোহে সামরিক এবং বেসামরিক ব্যক্তিদের ভূমিকা যাচাই।
জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে বিদ্রোহের প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ।
ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য সুপারিশ প্রদান।

ভুক্তভোগীদের প্রত্যাশা
কমিশন গঠনের খবরটি নিহতদের পরিবারের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। প্রাক্তন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাসান নাসির বলেছেন, এ কমিশন পূর্ববর্তী তদন্তের ভুলগুলো চিহ্নিত করে সঠিক পথে এগিয়ে যাবে।

তবে তিনি সতর্ক করে বলেন যে, এ ধরনের তদন্ত কার্যক্রমে যথাযথ স্বচ্ছতা এবং নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা জরুরি। এটি যেন শুধুমাত্র একটি আনুষ্ঠানিকতা হয়ে না দাঁড়ায়, তিনি যোগ করেন।

জাতীয় গুরুত্ব ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
বিডিআর বিদ্রোহ বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায়। এই হত্যাকাণ্ডে দোষীদের শনাক্ত এবং বিচার করা শুধু নিহতদের পরিবারের নয়, পুরো জাতির নৈতিক দায়িত্ব।

কমিশনের সঠিক কার্যক্রম নিশ্চিত করতে সরকারের পাশাপাশি নাগরিক সমাজ, সংবাদমাধ্যম এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও ভূমিকা রাখতে হবে।

নতুন কমিশন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিডিআর হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের প্রকৃত চিত্র উদঘাটিত হবে বলে আশাবাদী সংশ্লিষ্ট সবাই।

লেখক: ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল কমিটির সদস্য, ওয়াশিংটন ডিসি, যুক্তরাষ্ট্র

Related Articles

Back to top button