মিয়ান আরেফি:বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস জুড়ে একদিকে যেমন গোপন সংগঠন এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর ভূমিকা ছিল, অন্যদিকে একটি মাত্র শব্দ – “রাজাকার” – জাতির মানসিক ও রাজনৈতিক চেতনায় গভীর প্রভাব ফেলেছে।
গোপন সংগঠন এবং স্বাধীনতার পথচলা
১৯৫৬ সালে সিরাজুল আলম খান “নিউক্লিয়াস” নামে একটি গোপন গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন। এটি মূলত ছাত্ররাজনীতির মধ্যে দিয়ে পাকিস্তানের শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কাজ করত। নিউক্লিয়াস অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে পরিচালিত হতো এবং এই সংগঠন থেকেই বাংলাদেশে স্বাধীনতার জন্য সুদূরপ্রসারী আন্দোলনের বীজ বপন করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের হিমাচল প্রদেশের দেরাদুন সামরিক একাডেমি বিশেষ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই একাডেমিতে জেনারেল উবানের নেতৃত্বে BLF বা মুজিব বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এই প্রশিক্ষণ মুক্তিযুদ্ধের কৌশলগত দিককে শক্তিশালী করে এবং পরবর্তীতে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের কার্যকর ভূমিকা রাখার জন্য প্রস্তুত করে।
রাজনৈতিক প্রশিক্ষণের ধারা
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিভিন্ন সময়ে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়।
জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে বিএনপির প্রশিক্ষণ কেন্দ্র: ফিরোজ খান নুন এবং প্রিন্সিপাল হারুন অর রশীদের তত্ত্বাবধানে স্থাপিত হলেও এটি প্রত্যাশিত সফলতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়।
ন্যাপের বামপন্থী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র: অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ সোনারগাঁও এলাকায় একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেন। এটি রুশপন্থী আদর্শে পরিচালিত হতো এবং বামপন্থী রাজনীতিবিদদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত।
ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা এবং Tata Social Science Institute-এর মতো প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশি রাজনীতিবিদদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। এসব প্রশিক্ষণ সাধারণত ১৫ দিন থেকে ১-২ মাসের মধ্যে সম্পন্ন হতো।
“রাজাকার” শব্দের ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক প্রভাব
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে “রাজাকার” শব্দটি একটি ভয়ংকর প্রতীক। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় এটি সেইসব ব্যক্তিদের বোঝাতে ব্যবহার করা হতো যারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পক্ষে কাজ করেছে। শব্দটির আক্ষরিক অর্থ স্বেচ্ছাসেবক হলেও এর প্রতীকী অর্থ একটি জাতীয় ক্ষত হিসেবে বিদ্যমান।
১৫ বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা “রাজাকার” শব্দটি তার perceived শত্রু বা ভিন্নমতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
ভবিষ্যতের জন্য একটি পরিকল্পনা
বাংলাদেশে রাজনৈতিক কর্মীদের জন্য একটি আধুনিক Political Workers Training Institute গড়ে তোলা প্রয়োজন। এই প্রতিষ্ঠানটি কেবল দক্ষতা উন্নয়ন নয়, বরং রাজনৈতিক পরিবেশ উন্নত করার লক্ষ্যে কাজ করবে।
প্রশিক্ষণের বিষয়গুলোতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে:
রাষ্ট্রের শত্রু-মিত্র চিহ্নিতকরণ।
রাষ্ট্রীয় সম্পদের সঠিক ব্যবহার।
আধুনিক যোগাযোগ ও এটিকেট।
সমাপ্তি
গোপন সংগঠন, রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং একক একটি শব্দের প্রতীকী শক্তি বাংলাদেশকে একটি স্বতন্ত্র পরিচয় দিয়েছে। তবে আজকের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক পরিবেশ উন্নত করতে আধুনিক চিন্তাধারা, প্রশিক্ষণ এবং আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার ব্যবহার অপরিহার্য।
লেখক: মিয়ান আরেফি, ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল কমিটির সদস্য, ওয়াশিংটন ডিসি, যুক্তরাষ্ট্র