টাইমস ২৪ ডটনেট: সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের নেতৃত্বের সরকারের পতন হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে দেশটিতে বাশার ও তাঁর পিতা হাফিজ আল-আসাদের ৫৪ বছরের শাসনের অবসান হয়েছে। আর এই পতনে সশস্ত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে ইসলামপন্থী জোট হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) এবং তুরস্ক-সমর্থিত সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (এসএনএ) এবং অন্যান্য আরও কয়েকটি ছোট ছোট দলের সমন্বয়ে গঠিত একটি গোষ্ঠী।
সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে এ দুই গোষ্ঠীর অবস্থান বেশ শক্তিশালী। গত ২৭ নভেম্বর তারা আকস্মিক হামলা চালিয়ে সিরিয়ার বৃহত্তম শহর আলেপ্পো এবং চতুর্থ বৃহত্তম শহর হামা দখল করে নেয়। এরপর ক্রমেই রাজধানী দামেস্কের দিকে এগিয়ে এসে আজ রোববার অবশেষে তাঁরা বাশার আল-আসাদের পতন ঘটায়। আল-আসাদ একটি ব্যক্তিগত বিমানে করে পালিয়ে গেছেন বলে দাবি করেছে বিদ্রোহীরা।
এইচটিএস-এর প্রতিষ্ঠাতা আবু মুহাম্মদ আল-জোলানি এক সময় মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে ইরাকের প্রতিরোধ লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিলেন। সে সময় তিনি যে সশস্ত্র গোষ্ঠীর হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন সেটিই পরে ইসলামিক স্টেটে (আইএস) পরিণত হয়। কিন্তু জোলানি আইএসের আনুগত্য স্বীকার করেননি। ইরাক যুদ্ধের সময় জোলানি ৫ বছরের মতো কারাগারে বন্দী ছিলেন।পরে ২০১১ সালে আরব বসন্তের সময় তিনি দেশে ফিরে বাশার আল-আসাদ বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে সশস্ত্র গোষ্ঠী জাবহাত আল-নুসরা বা আল-নুসরা ফ্রন্ট গঠন করেন। প্রথমে এই গোষ্ঠী আল-কায়েদার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও পরে ২০১৬ সালে তারা প্রকাশ্যে আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং নিজেদের নতুন করে হায়াত তাহরির আল-শাম নামে পরিচিত করে। এইচটিএস বর্তমানে সিরিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী বিদ্রোহী গোষ্ঠী।
এদিকে, বাশার আল আসাদের পতনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া আরেকটি বড় গোষ্ঠী হলো সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি। সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি যা আগে ফ্রি সিরিয়ান আর্মি নামে পরিচিত ছিল, ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। সিরিয়ার সেনাবাহিনীর একদল কর্মকর্তা এই বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন। তুরস্ক সরাসরি এই বাহিনীকে সমর্থন দেয়। এইচটিএস এবং সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি সময়ের পরিক্রমায় কখনো মিত্র, আবার কখনো প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে অবস্থান নিয়েছে এবং তাদের লক্ষ্যও একাধিক সময়ে ভিন্ন হয়েছে। কিন্তু বাশার আল-আসাদের পতনের ব্যাপারে উভয় পক্ষই একমত।
তুরস্ক-সমর্থিত এই সশস্ত্র গোষ্ঠীর তুর্কি সীমান্তের সিরিয়ার অঞ্চলে একটি বাফার জোন তৈরি করার স্বার্থ রয়েছে। আঙ্কারা মনে করে এই বাফার জোন সিরিয়ার কুর্দিদের সঙ্গে তুরস্কের কুর্দিদের বিচ্ছিন্ন করে রাখবে। ফলে তুর্কি কুর্দিরা সিরিয়ার মাটি ব্যবহার করে তুরস্কে হামরা চালাতে পারবে না। তুরস্ক দীর্ঘদিন ধরে আসাদ সরকারকে উৎখাতের লক্ষ্যে লড়াই করা যোদ্ধাদের সমর্থন দিয়ে আসছে। তবে সম্প্রতি তারা মীমাংসার আহ্বান জানিয়েছিল এবং বর্তমান অভিযানে কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছে।বাশার আল-আসাদবিরোধী আন্দোলনে সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস (এসডিএফ) নামক কুর্দি বিদ্রোহীদের একটি দলও আছে। এসডিএফ প্রধানত কুর্দি যোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত, যারা পিপলস প্রোটেকশন ইউনিটস (ওয়াইপিজি) নামক একটি গোষ্ঠীর সদস্য। তুরস্ক এই গোষ্ঠীকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করে। সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে দেশটির দ্রুজ ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যোদ্ধারাও লড়াইয়ে যোগ দিয়েছে।এ ছাড়া, সিরিয়ায় ২০১২ সাল থেকেই বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে দেশটির উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের কুর্দি সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলো থেকে বিদ্রোহ শুরু হয়। ২০১২ সালে অঞ্চলটি থেকে সরকারি বাহিনী সরে যাওয়ার পর কুর্দিরা স্বশাসন প্রতিষ্ঠার সুযোগ পায়। তারা ধীরে ধীরে তাদের এলাকা প্রসারিত করে, কারণ মার্কিন-সমর্থিত কুর্দি নেতৃত্বাধীন যোদ্ধারা ইসলামিক স্টেট জিহাদিদের সঙ্গে লড়াই করেছিল এবং ২০১৯ সালে তাদের উৎখাত করে। কুর্দিরা অনেক আগে থেকেই উত্তর-পূর্ব সিরিয়া দখলে রেখেছে।একটি বিষয় উল্লেখ্য যে,২০১১ সালের পর সিরিয়ায় বেশ কয়েকটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। পরে সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে কিছু গোষ্ঠী আইএসের সঙ্গে যোগ দিয়ে একপ্রকার নিঃশেষ হয়ে যায়। আবার কিছু গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম এবং সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মির মতো বড় গোষ্ঠীর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে শুরু করে।
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, বিবিসি, এএফপি ও রয়টার্স।