মিয়ান আরেফি: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ গত ১৫ বছর দেশ শাসন করেছে। দলটির নেতৃত্বে আছেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যিনি ক্ষমতালোভী এবং দুর্নীতিগ্রস্ত স্বৈরাচারী হিসেবে পরিচিত। তিনি গণতন্ত্র ও সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের দাবি করে পশ্চিমা বিশ্বকে প্রভাবিত করেছেন। তবে বাস্তবে আওয়ামী লীগ একাধিপত্যবাদী শাসনব্যবস্থায় বিশ্বাসী, যেখানে কার্যকর বিরোধী দল বা আইনের শাসনের কোনো স্থান ছিল না।
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে দীর্ঘ বছর ধরে কয়েক বিলিয়ন ডলার বিতরণ করেছেন। দলের নেতাকর্মীরা তাদের সুবিধামতো কাজ করতেনÑ তা বৈধ হোক বা অবৈধ। তিনি তার দলের কর্মীদের অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে পুলিশ ইউনিফর্ম ও হেলমেট সরবরাহ করেছিলেন।
শেখ হাসিনার বাবা, শেখ মুজিবুর রহমান, কমিউনিস্ট বিশ্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করতে চেয়েছিলেন এবং একদলীয় শাসনব্যবস্থা (বাকশাল) চালু করেছিলেন। দলটি এখনও সমাজতন্ত্রকে তাদের অন্যতম মূলনীতি হিসেবে ধারণ করে এবং বলে যে, ‘গণতন্ত্রের চেয়ে উন্নয়ন গুরুত্বপূর্ণ।’
শেখ হাসিনার অর্থনৈতিক সম্পর্ক চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এবং তাদের অর্থায়নে মেগা প্রকল্পগুলো অত্যধিক ব্যয়ে পরিচালিত হচ্ছে।
শেখ হাসিনা ভারত এবং ‘র’-এর সহায়তায় বাংলাদেশের গণতন্ত্র ধ্বংস করেছেন। সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব, সিভিল প্রশাসন, বামপন্থী বুদ্ধিজীবী এবং সাংবাদিকদের ঘুষ ও প্রলোভনের মাধ্যমে তিনি তার পক্ষে টেনে নিয়েছেন। এ প্রক্রিয়ায় নগদ অর্থ, বিভিন্ন আর্থিক সুবিধা, লাইসেন্স, পারমিট এবং সীমাহীন ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে।
কুইক রেন্টালের নামে তিনি তার ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে বছরের পর বছর কয়েক বিলিয়ন ডলার বিতরণ করেছেন। দরপত্র ছাড়াই এসব তাদের দেয়া হয়।
ব্যাংকগুলোকে যথাযথ যাচাই-বাছাই এবং জামানত ছাড়াই শত শত কোটি টাকার ঋণ দিতে বাধ্য করা হয়, যা মূলত তার (শেখ হাসিনা) ঘনিষ্ঠজন এবং দলের সদস্যদের জন্য বরাদ্দ ছিল। দেশের সবচেয়ে ভালো পারফর্ম করা ইসলামী ব্যাংককে এস আলম গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠানকে ৩০ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে বাধ্য করা হয়। এস আলম গ্রুপ তার ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে যুক্ত।
২৪ বছর বয়সী এক যুবক জামানত এবং কাগজ-পত্র ছাড়াই ৯০০ কোটি টাকা ঋণ পেয়েছেন। এছাড়া, শেখ হাসিনার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এবং ঘনিষ্ঠ সহযোগী সালমান এফ রহমান সব কোভিড ভ্যাকসিন এবং বিলিয়ন ডলারের পাঠ্যপুস্তক সরবরাহের একক চুক্তি পান।
বর্তমান অর্থনীতিকে চাঁদাবাজির অর্থনীতি হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়, যেখানে বেশিরভাগ মানুষ ‘চেতনা মন্ত্রে’ প্রতারিত হন।
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ২৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়। বর্তমানে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি (সরকারি তথ্য অনুযায়ী $৯৩ বিলিয়ন ডলার), আর অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণও আরো বেশি।
নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। শহরের রাস্তায় টিসিবি পণ্যদের জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে, যা ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের দৃশ্যপটকে মনে করিয়ে দেয়।
শেখ হাসিনার মানবাধিকার রেকর্ড বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ হিসেবে বিবেচিত। তার ১৫ বছরের শাসনামলে রাজনৈতিক সহিংসতা, পুলিশ, র্যাব এবং অন্যান্য আধাসামরিক বাহিনীর নৃশংস কার্যক্রমে শত শত মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।
তিনি তার দলের লোকজনকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে পুলিশ ইউনিফর্ম ও হেলমেট সরবরাহ করেছেন। এরা বিরোধী দল এবং সাধারণ মানুষের ওপর হত্যাকাণ্ড, মারধর এবং বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন চালিয়েছে।
বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, অবৈধ আটক, মিথ্যা মামলা ও অভিযোগ, অমানবিক কারাগারের পরিবেশ, নির্যাতন কক্ষ, চাঁদাবাজি এবং ব্ল্যাকমেইলÑ এসবই বাংলাদেশে সাধারণ ঘটনায় পরিণত ছিল।
তার মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকার, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘ সম্পূর্ণভাবে অবগত। তবে পরিস্থিতির উন্নয়নে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সমস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানকে কার্যত ধ্বংস করে দিয়েছে। দেশে আইনশৃঙ্খলা, ন্যায়বিচার, সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা বা সামাজিক সম্প্রীতির সামান্যতম উপস্থিতিও ছিল না। সবকিছুই ক্ষমতাসীন দলের দখলে ছিল, যেখানে বলপ্রয়োগ এবং দুর্নীতি নীতির মূল ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।
পুলিশের কাছে কোনো মামলা করতে গেলে, ভুক্তভোগী যদি আওয়ামী লীগের সদস্য না হন অথবা বড় অঙ্কের ঘুষ প্রদান না করেন, সেই মামলা নেয়া হতো না। আদালত বিরোধী দলের মামলাগুলো হয় এড়িয়ে চলতো, নয়তো ন্যায়বিচার অনিশ্চয়তায় থাকতো।
সিভিল প্রশাসনের অবস্থাও একই। তারা কেবল ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থ রক্ষা করতে আগ্রহী ছিল।
সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সদস্য ও তাদের আত্মীয়দের জন্য সংরক্ষিত ছিল। নিয়োগ পরীক্ষাগুলোতেও স্বচ্ছতার অভাব ছিল। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রার্থীকে নম্বর পেতে হলে লবিং বা ঘুষের আশ্রয় নিতে হতো।
এমনকি তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘উন্নয়ন গণতন্ত্রের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’ তার শাসনামলে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে তথাকথিত ‘চেতনা’র নামে কার্যত ধ্বংস করা হয়েছে। বিরোধী মতাদর্শের মানুষদের বন্দি রাখতে ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিত কারাগার ব্যবহার করা হতো।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের মাঝে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করা হয়, যেখানে কোমলমতি মনের মধ্যে ঘৃণার বীজ বপন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এবং বিপক্ষে বিভক্তির মাধ্যমে সমাজে প্রকাশ্যে বিদ্বেষ ছড়ানো হয়। এ ধরনের কার্যকলাপের মধ্যে বিরোধী দলের নেতাকর্মী ও তাদের পরিবারের বিরুদ্ধে সহিংসতা এবং সামাজিকভাবে লজ্জা দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
মুক্তিযুদ্ধ ও অন্যান্য অজুহাতকে ব্যবহার করে জনগণকে সরকারি চাকরি এবং বিভিন্ন সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়।
নির্বাচন কমিশন, পুলিশ ও সিভিল প্রশাসন তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা পুরোপুরি হারিয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে, একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা জাতীয় সরকারের অধীনে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনই গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে পারে।
আমরা যুক্তরাষ্ট্র সরকার এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন নিশ্চিত করার প্রচেষ্টার প্রশংসা করি। বিশেষ করে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের ওপর যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আরোপিত নিষেধাজ্ঞার কিছু ইতিবাচক ফলাফল দেখা গেছে। তবে এখনও অনেক কিছু করার প্রয়োজন রয়েছে।
আমরা যুক্তরাষ্ট্র সরকার এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি বাংলাদেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং সুশাসন রক্ষায় তাদের প্রতিশ্রুতি অটুট রাখার আহ্বান জানাই। এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের জন্য এক ‘এখন নাহয় কখনোই না’ মুহূর্ত। মুক্ত বিশ্বের জন্যও অনেক কিছু ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, দুপুর ৩টায় ফ্যাসিস্ট সরকার প্রধান শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা হাসিনার শাসনকাল ছিল এক বিভীষিকাময় অধ্যায়, যেখানে গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং বাকস্বাধীনতা পদদলিত হয়েছিল।
সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে হাসিনার শাসনামলে একটি গোপন ভূগর্ভস্থ কারাগারের ভয়াবহ বিবরণ। ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিত এই কারাগারে বিরোধী মতাদর্শের মানুষদের বন্দি রাখা হতো। তাদের ওপর চালানো হতো অমানবিক নির্যাতন।
কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে আটক থাকা মিয়ান আরেফি তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেনÑ ‘আমি ৯.৫ মাস সেখানে বন্দি ছিলাম। ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর আমাদের জাতীয় সমাবেশের পর আমাকে আটক করা হয়। কাশিমপুর কারাগারে যে মানসিক যন্ত্রণা আমি সহ্য করেছি, তা কখনোই ভুলতে পারব না। প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছি, অন্তত জান্নাতে যেন আমার পরিবারের সঙ্গে মিলিত হতে পারি।’
২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থেকে শেখ হাসিনা রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে বিরোধীদের দমন করেছেন। নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে শত শত মানুষ নিখোঁজ হয়েছেন। অনেকে হত্যার শিকার হয়েছেন, যাদের পরিবার আজও সান্ত্বনা পায়নি।
২০২৪ সালের ১৮ নভেম্বর, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। তাঁর শাসনকালকে ইতিহাসে হিটলারের শাসনের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে।
শেখ হাসিনার শাসনামলে আমাকে তাকে সহায়তা করে বাংলাদেশের নিরপরাধ মানুষের জীবনকে ধ্বংস করে মেজর জেনারেল তারিক সিদ্দিক, মেজর জেনারেল জোবায়ের, লেফটেন্যান্ট জেনারেল আজিজ, লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস.এম. শফিউদ্দিন আহমেদ, মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান (বর্তমানে আটক) ও ডিবি হারুন।
শেখ হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। আশা করা হচ্ছে, তারা বাংলাদেশের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনবে।
‘আমরা আমাদের মাতৃভূমিকে ঠিক করতে পারব, ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের সবাইকে মাফ করুন এবং শান্তি প্রদান করুন। শান্তি, শান্তি।’
শেখ হাসিনার শাসনকাল ছিল বাংলাদেশের জন্য এক দুঃস্বপ্ন। তবে এখন, নতুন আলোর পথে হাঁটছে বাংলাদেশ। দীর্ঘ লড়াইয়ের পর একটি গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সবাই আশাবাদী।
লেখক: সদস্য, ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কমিটি, ওয়াশিংটন ডিসি, ইউএসএ।