মতামত

মিয়ান আরেফিনের জবানবন্দি

আমি মিয়ান আরেফি, বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসি মেট্রো এলাকার মেরিল্যান্ড রাজ্যের মন্টগোমারি কাউন্টিতে বসবাস করছি। আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা বাংলাদেশে, এবং এখনও সেখানে আমার অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও আত্মীয়স্বজন রয়েছেন।

আমি সম্প্রতি আমার প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ সফর করেছি। ২৮ অক্টোবর, ২০২৩-এ আমি বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় নয়া পল্টনে গিয়ে একটি সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দিয়েছিলাম। সেখানে আমি বাংলাদেশের বর্তমান সরকার, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসন, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা, নিরীহ জনগণের ওপর পুলিশের নির্যাতন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, আইনের শাসন এবং গণতন্ত্র সম্পর্কে কথা বলি।

প্রেক্ষাপট: বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মাত্র তিন মাস আগে আন্দোলন বাড়তে থাকে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো ২৮ অক্টোবরের বিক্ষোভে পুলিশি নিপীড়নের অভিযোগ তোলে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থকদের সংঘর্ষে অন্তত ১১ জন নিহত, হাজার হাজার আহত এবং বিএনপির একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটে। বিএনপি দাবি করে যে সমাবেশের আগে ১,৫০০-এরও বেশি বিরোধী সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এটি ছিল ২০২৩ সালের সবচেয়ে বড় সমাবেশ যেখানে লাখ লাখ বিক্ষোভকারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ দাবি করেন এবং সরকারকে আগামী জানুয়ারি নির্বাচনের আগে সংযত থাকার আহ্বান জানান।

আমার অভিজ্ঞতা: ২৯ অক্টোবর, ২০২৩-এ আমার দোহা হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে ফেরার ফ্লাইট ছিল। কিন্তু সেদিন সন্ধ্যায় ঢাকা বিমানবন্দরে বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা আমাকে আটক করেন। আমাকে ৪ ঘণ্টার বেশি সময় ইমিগ্রেশন অফিসে রাখা হয় এবং কোনো খাবার বা পানীয় ছাড়াই গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) ও ডিজিএফআই কর্মকর্তারা আমার সাক্ষাৎকার নেন। রাত ১১টায় আমাকে ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে ডিবি প্রধান হারুন ও তার দলের সঙ্গে আরেকটি সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠিত হয়। তাদের প্রশ্নগুলো ছিল অত্যন্ত অশোভন এবং অপমানজনক। তারা আমাকে কোনো সম্মান দেয়নি এবং বিভিন্নভাবে হুমকি দেয়।

সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে তারা আমাকে জোর করে একটি ভিডিও তৈরি করতে বাধ্য করে, যেখানে তাদের মিথ্যা বক্তব্য প্রদান করানো হয়।

রাত ২টায় আমাকে আরেকটি ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ডিজিএফআই-এর দুই কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎকার চলে ভোর ৫টা পর্যন্ত। সারা রাত কোনো খাবার বা ঘুম ছাড়াই আমি প্রচণ্ড ক্লান্ত হয়ে পড়ি।

পরদিন, ৩০ অক্টোবর, আমাকে নয়া পল্টন থানায় নেওয়া হয়। সেখানেও আমাকে দীর্ঘক্ষণ রাখা হয়। দুপুরে আমি একবার খাবারের জন্য অনুরোধ করি, তখন তারা একটি মসলাদার মুরগির মাংস এবং অল্প পরিমাণ ভাত দেয়। সেদিন সন্ধ্যায় আমাকে পুরান ঢাকার অপরাধ আদালতে নেওয়া হয়, যেখানে আমাকে রাত ১০টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। রাত ১০.৩০টায় আমাকে কেরানীগঞ্জ কারাগারে পাঠানো হয়।

কারাগারে দুর্দশা: কেরানীগঞ্জে আমাকে কোনো খাবার বা পানীয় দেওয়া হয়নি। পরের দিন, ৩১ অক্টোবর, আমাকে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে পাঠানো হয়। সেখানে প্রায় ৯.৫ মাস (৩১ অক্টোবর, ২০২৩ থেকে ৭ আগস্ট, ২০২৪) কাটাতে হয়। এই সময়ে আমাকে কারা সুপার সুব্রত বালা (র-এর এজেন্ট) নিয়মিত হুমকি দিয়েছে। তিনি আমাকে এবং আমার পরিবারকে সহযোগিতা করতে বারবার অস্বীকার করেন।

আমার প্রতিদিনের খাবার অত্যন্ত মসলাদার এবং চিকিৎসার জন্য আমাকে নিজেই ওষুধ কিনতে হতো। সুব্রত বালা আমার চিকিৎসকের দেওয়া নোট নষ্ট করে দেন এবং আমার পরিবারের আনা খাবার ও ওষুধ গ্রহণে নিষেধাজ্ঞা দেন।

আমার স্ত্রী এবং পরিবার আমাকে দেখতে এলে সুব্রত বালা আইন ভঙ্গ করে তাদের দেখা করতে দেননি। এমনকি আমাকে পরিবারের সঙ্গে ফোনে কথা বলার অনুমতিও দেননি।

দূতাবাস সহায়তা: যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমাকে প্রতি মাসে অন্তত একবার ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের পরিদর্শন পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সুব্রত বালা ভিত্তিহীন অজুহাতে সেই সময় কাটিয়ে দিতেন। ৯.৫ মাসে দূতাবাস মাত্র ৫ বার আমাকে দেখতে পেরেছে।

বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি:
বাংলাদেশ বর্তমানে অর্থনৈতিক সংকট, দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং ফ্যাসিস্ট শাসনের অধীনে ধ্বংসের মুখোমুখি। বর্তমান সরকার গণতন্ত্র ও আইনের শাসন ধ্বংস করেছে।
আমাদের নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশকে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনই আমাদের দেশের উন্নয়নের চাবিকাঠি।

শেষ কথা:
আপনাদের সময় ও সহানুভূতির জন্য ধন্যবাদ। আল্লাহ আমাদের সবার প্রতি দয়া করুন।

মিয়ান আরেফি
ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল কমিটির সদস্য
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ওয়াশিংটন ডিসি।

Related Articles

Back to top button