টাইমস ২৪ ডটনেট: মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। গতকাল বুধবার লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর অতর্কিত হামলায় দুই ইসরায়েলি সেনা নিহত হন। আহত হয়েছেন অন্তত ১৮ জন। হামলাটি লেবাননের সীমান্তবর্তী শহর ওদাইসেতে ইসরায়েলি সেনাদের লক্ষ্য করে চালানো হয়। ইসরায়েলি বাহিনী হিজবুল্লাহর অবকাঠামো ধ্বংস করতে লেবাননে প্রবেশের চেষ্টা করছিল। কিন্তু হিজবুল্লাহর সুপরিকল্পিত আক্রমণের মুখে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে স্থল হামলা চালাতে লেবাননে প্রবেশের চেষ্টা চালিয়েছে দখলদার ইসরায়েলের বেশ কিছু সেনা। তবে তারা মাত্র ৪০০ মিটার যাওয়ার পরই আবার পিছু হটেছে।
ইসরায়েলি বাহিনী শহরটিতে প্রবেশের আগে ব্যাপক কামান হামলা চালায়। তবে হিজবুল্লাহর আক্রমণ এতই শক্তিশালী ছিল যে, ইসরায়েলি সেনারা দ্রুত আক্রমণ বন্ধ করে পিছু হটে যায়। আলজাজিরার তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েল জানে যে লেবাননে স্থল হামলা চালানো অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং হবে। গাজায় তারা সহজেই প্রবেশ করতে পারলেও লেবাননের ভূখণ্ডে হামলা চালানো অনেক বেশি কঠিন। ইসরায়েলের সাম্প্রতিক লেবাননে হামলার ঘোষণার পর হিজবুল্লাহর সঙ্গে এটিই তাদের প্রথম সরাসরি সংঘর্ষ।
বিশ্লেষকদের মতে, হিজবুল্লাহ লেবাননে ইসরায়েলের যেকোনো স্থল হামলা প্রতিহত করার জন্য ভালোভাবেই প্রস্তুত। তারা সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদের পক্ষে লড়াই করে যুদ্ধের ব্যাপক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। এই যোদ্ধারা সরাসরি সংঘর্ষে প্রশিক্ষিত এবং তাদের অঞ্চলে তারা নিজেদের শক্ত অবস্থানে নিয়ে গেছে। এ কারণেই ইসরায়েল লেবাননে স্থল হামলা চালাতে গেলে বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে।
এদিকে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে উত্তেজনাও চরম আকার ধারণ করেছে। মঙ্গলবার ইরান ইসরায়েলের ডিমোনা পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রসহ কৌশলগত স্থাপনাগুলো লক্ষ্য করে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে। ইসরায়েলি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ডের সমন্বয়ে বেশিরভাগ ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করা হলেও ইসরায়েল এই হামলাকে বড় ধরনের উস্কানি হিসেবে দেখছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ঘটনার মাধ্যমে ইরান তাদের প্রতিপক্ষকে বোঝাতে চেয়েছে যে, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ কার্যকর নয়।
ইরানের চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি বুধবার এক হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, যদি ইসরায়েল প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে ইরান আরও শক্তিশালী আক্রমণ করবে। তিনি জানান, ইসরায়েলজুড়ে সব স্থাপনায় আঘাত হানার জন্য ইরান প্রস্তুত রয়েছে।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই পরিস্থিতিতে কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, ইরান বড় ধরনের ভুল করেছে এবং তাদের এই ভুলের জন্য চড়া মূল্য দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, ইসরায়েলের শত্রুরা যেন ভালোভাবে বুঝতে পারে, প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষেত্রে ইসরায়েল কোনো প্রকার দ্বিধা করবে না।
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে এই উত্তেজনার মধ্যেই ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরাও ইসরায়েলের সামরিক স্থাপনায় ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। হুতিদের দাবি, তাদের ছোঁড়া কুদস-৫ ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র সফলভাবে ইসরায়েলের ভেতরে আঘাত হেনেছে। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য করেনি। তবে হুতিদের এই হামলা মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতকে আরও তীব্রতর করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গত সপ্তাহে ইসরায়েল ইয়েমেনের হুতিদের নিয়ন্ত্রিত হোদেইদাহ বন্দরে হামলা চালিয়েছিল। ধারণা করা হচ্ছে, সেই হামলার পাল্টা জবাব হিসেবে হুতিরা এই আক্রমণ চালিয়েছে। এর আগেও তারা ইসরায়েলের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালানোর দাবি করেছে। হুতিরা ইরান-সমর্থিত প্রতিরোধ অক্ষের অংশ হিসেবে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমবর্ধমান সংঘাতের অবসান ঘটাতে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন। তবে ইসরায়েল তার এই আহ্বানকে উপেক্ষা করে গুতেরেসকে ‘পারসোনা নন গ্রাটা’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ জাতিসংঘের মহাসচিবের সমালোচনা করে বলেন, গুতেরেস ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার দ্ব্যর্থহীন নিন্দা করতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং এজন্য তাকে অবাঞ্ছিত ব্যক্তি ঘোষণা করা হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরান এবং ইসরায়েলের মধ্যে ক্রমবর্ধমান এই উত্তেজনা শুধু দুটি দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। ইসরায়েল যদি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর হামলা চালায়, তাহলে তা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বড় ধরনের সামরিক সংঘাতের সূত্রপাত ঘটাতে পারে। ইরান পারস্য উপসাগরের হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে, যা বিশ্ব অর্থনীতির ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে। হরমুজ প্রণালী বিশ্ব জ্বালানি তেল সরবরাহের একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ, এবং এই পথ বন্ধ হয়ে গেলে জ্বালানি সরবরাহে ব্যাপক বিঘ্ন ঘটবে। মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতের এই ভয়াবহ পরিস্থিতি যদি নিয়ন্ত্রণে আনা না যায়, তবে তা গোটা বিশ্বের নিরাপত্তা এবং অর্থনীতিকে হুমকির মুখে ফেলবে।
অপরদিকে সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে স্থল হামলা চালাতে লেবাননে প্রবেশের চেষ্টা চালিয়েছে দখলদার ইসরায়েলের বেশ কিছু সেনা। তবে তারা মাত্র ৪০০ মিটার যাওয়ার পরই আবার পিছু হটেছে।
লেবাননের সেনাবাহিনী আজ বুধবার এক বিবৃতিতে এই তথ্য জানিয়েছে। তারা বলেছে, ইসরায়েলি শত্রুদের একটি দল খিরবেত ইয়ারুন এবং আয়েদেস এলাকা দিয়ে ব্লু লাইন পার হয়ে লেবাননের প্রায় ৪০০ মিটার ভেতরে প্রবেশ করে। কিন্তু কিছুক্ষণ অবস্থানের পরই তারা আবার পিছু হটেছে। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) কাছে এ ব্যাপারে জানতে যোগাযোগ করেছিল মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন। তবে তারা কোনো বক্তব্য দেয়নি। আইডিএফ অবশ্য একটি ছবি প্রকাশ করেছে। ছবিটি যাচাই-বাছাই করে সিএনএন নিশ্চিত হয়েছে এটি দক্ষিণ লেবাননে তোলা। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা জানিয়েছে, লেবাননের ভেতর ঢোকার চেষ্টাকালে হিজবুল্লাহর ব্যাপক প্রতিরোধের মুখে পড়েছিল ইসরায়েলি সেনারা। এরমধ্যে ওদাইসে শহরে ২ সেনা নিহত ও ১৮ জন আহত হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, হেলিকপ্টারের মাধ্যমে আহত সেনাদের সরিয়ে নেওয়ার কাজ করা হচ্ছে। আলজাজিরা জানিয়েছে, আহত ওই সেনাদের হেলিকপ্টারে হাইফার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। যেখানে অসংখ্য অ্যাম্বুলেন্স অপেক্ষা করছিল। এছাড়া একই সময় ওই এলাকার তিনটি হাসপাতালকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়।