সৈয়দা রাশিদা বারী: মা মানেই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ। শ্রেষ্ঠ বন্ধু। সেটা পুত্র কন্যা উভয়ের জন্যই। জীবনের সমস্ত নিরাপত্তা মায়ের কাছেই। সবাই বিশ্বাস করে, কি করে না, তাদের ব্যাপার, তবে এটাই সত্যি। সাধারণত সমাজে তারপরও বৃদ্ধকালে মায়েদের বেশ কষ্টের মধ্যে পড়তে হয়, অবজ্ঞা অবহেলা অপমানিত জীবন বইতে হয়। সন্তানদের মধ্যে মায়ের প্রয়োজনকে ঘিরে। ভাগ করে বা ঠেলাঠেলি করে কি প্রকৃত প্রয়োজন অনুসারে সেবা করা হয় নাকি? না সব প্রয়োজনই মেটে? মা কি শিশু সন্তানকে ভাগ করে, আড়ি পেতে জন্ম দেন এবং মানুষ করেন কখনো? নাকি মা একাই তার সন্তানের সম্পূর্ণ দেখভাল করার দায়িত্ব পালন করেন? অর্থাৎ যখন জন্ম দেন, আদর যত্ন করে বড় করেন, দুধ বার্লি সাবু খাওয়ান, কোলে নেন, বিছানা পত্র পরিষ্কার করেন ইত্যাদি, ভাগ করে করেন নাকি?? একজন মা অনেকগুলো সন্তানকে বিনা অনিহায়, স্নেহ ভালোবাসায়, ভরিয়ে দিয়ে, সমানভাবে যাবতীয় প্রয়োজন, যাবতীয় চাহিদা মিটিয়ে মানুষ করলে। একটি মাকে অনেকগুলো সন্তান মিলে তবুও মায়ের প্রয়োজনীয় চাহিদার কমতি থাকে সবদিকে থাকে অবনতি, পূরণ হয় না কেন? সন্তানরা মায়ের যা কিছু দিতে এবং সেবা যত্ন সহযোগিতা করতে অক্ষম থাকেন কেন?? ভালোবাসা শ্রদ্ধা মাকে দিতে এত অনিহা থাকে কেন?? মা তো ঠিকই প্রাণ দিয়ে ভালবেসে, আদর স্নেহের কমতি না রেখে মানুষ করেন। একটাই কারণ ভাগ। অমুক ৫০০ দিয়েছে, আমিও ৫০০ টাকা দিলাম। অমুক ৫মিনিট সময় দিয়েছে, আমিও ৫মিনিট সময় দিবো। কিছুই আমি ওর থেকে বেশি দিব না। তবে ও আবার যা দেবে, আমিও তাই দেবো! আর আমার কাছে একভাবে থাকা নয়, ওর কাছেও সমান দিন করে থাকা লাগবে। নইলে আমার তো সংসারটা ভেঙে বসবে। টিকবে না। এই যে এই ধরনের ব্লাকমেইল, এই জিনিসটাতে কিন্তু মাকে অনেক কষ্ট দেওয়া হয়। এর উপরে আবার বেশিরভাগ গবেট পুত্র, স্ত্রীর সাথে তাল মিলিয়ে, নিজ মাকে ব্যথিত করবার জন্য, অনেক অন্যায় কথাও বলে। এখানে মায়ের থেকে স্ত্রীর বেশি গুরুত্ব দেওয়া, তারপরও বুঝাই যেন মা কালহাবাতি-রাক্ষসী ছন্নছাড়া, কোন যশ বরকত মায়ের হাতে নাই। যে কারণে লাগে বেশি, খাই বেশি, খরচ বেশি ইত্যাদি বলে যখন খোটা দেয়, সেটাও কিন্তু মায়ের আঘাতের আর একটা কারণ। যখন সব ছেলেরা চাকরি করে নাই, লেখাপড়া করেছে। মা কিন্তু তাদের সব প্রয়োজন মিটিয়েছেন, একা একা রোজগার করে। সাশ্রয়ী না হয়ে ছন্নছাড়া হলে কি সবাইকে সব প্রয়োজন মেটাতে পারতেন? আরো জমাজমি অন্যান্য ঠেকাতে বা নতুন করে বাড়াতে পারতেন? তখন তো মা খাননি বেশি, ওরাই বলেছে মা তুমি তো কিছু খাও না। সব আমাদের দিয়ে দাও। সেই সন্তানরায় তাদের স্ত্রীর পলিটিক্সে ও পাল্টানে পড়ে, মাকে ঐসব বলে! সন্তানদের এত বড় গুনি মাকে, এইগুলো বলতে একটুও বুক কাপে না?! যে কাকে কি বলছি!!? বাবা ছাড়ায় যে মা ফেলে চলে না গিয়ে, মানুষের মতো মানুষ করেছে, তাকে তো এটা বলা অধমের সামিল! ব্যাখা অনেক। পুত্র এটাও বলে, এখন আমার আপনি কেউ না। স্ত্রী, শালী, শালা শাশুড়ি পুত্র কন্যা- ওরাই আপন। ওদের জন্যই তো আমি কামাই রোজগাড় করি। মাসের এক লাখ টাকাই ওদের পিছনে চলে যাক, সব চলে যাক, কিন্তু আপনাকে ৫০০ টাকা কেন ৫টাকা দিলেও আমার লস। যা দেবো সেটাই আমার লস। ইত্যাদি। ভালো সন্তানরা বিয়ে করে বউ শাশুড়ি ঘরে এনে সেটেল করার পরে যখন এরকম বিয়াক্কল হয়ে যায়। তখন মায়ের মন কেমন লাগে?? তবে বাবাদের বেলায় এতটা হয় না। কেননা বাবাদের তো নামে কিছু না কিছু পৈতৃক সম্পদ থাকে। ওইটা বাবার বৃদ্ধ বয়সে তার নিদান কালের প্রয়োজন, চাওয়া পাওয়ার সিকিউরিটি হয়। পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষই নগদ স্বার্থের কাছে কাবু এবং দায়বদ্ধ থাকে। বিশেষ করে ইয়াং জেনারেশন, প্রাপ্ত বয়সের তাদের কাছে। ঠিক এই সময়ই মা মানুষেরা পরিবারের প্রজন্ম সদস্যদের থেকে বয়সে এবং শরীর স্বাস্থ্যে ঢুলে পড়েন। আর পরিবারের সদ্য বয়সে টগবগে নতুন রক্তের জের প্রাপ্ত ব্যক্তিগণ তাকেও (বৃদ্ধ মাকেও) হেয় করার বা নিচু ভাবার সুযোগ পায়। বয়সের ভারের দুর্বলতায় এবং মা তো সন্তান মানুষ করার সময়, নিজের শেষ বয়সের কথা না ভেবে, তার মাতৃক পিতৃক কুলের যতটুকু যা পায়, ভাইদের দিয়ে বিনিময়ে পয়সা নিয়ে এসে সন্তানদের পিছনে ফুড়িয়ে ফেলে। তখন ভাবে ওরা বড় হয়ে কামাই করলেই তার হবে। তখন তো আর তার কোন সমস্যা থাকবে না। কিন্তু বিয়ের পরে পুত্র তো স্ত্রী এবং শাশুড়ির কাছে জিম্মি হয়ে যায়। তাই উল্টো হয়ে পড়ে। আমি এমনও দেখেছি, পুত্রবধূ তার নিজের থেকে অনেক বেশি যোগ্য এবং বহু গুণে গুণান্বিত শাশুড়িকে বলেছে, ওর দেখলে আমার বমি আসে, ঘৃণা করে। যা স্বামীর সামনেও এবং স্বামীর কাছেও বলে। ওই স্বামী করে না তার কোনই প্রতিবাদ!! কারণ টসটসে চামড়ার কাছে পৃথিবীর সব মানুষ আমার মনে হয় দূর্বল। তাই চামড়া কুঁচকে গেলে, যৌবনের সৌন্দর্য থাকে না। কাজ করতে ও চলতে ফিরতেও জোরে পারেন না। আবার ঘর সংসারে তার নেতৃত্ব কর্তৃত্ব হারাবার ফলে কাউকে ডেকে কিছু কাজ করিয়ে পুষিয়ে নিতেও পারে না। ফলে তার কাপড়চোপড় বিছানাপত্র ঘর নিশ্চয় সম্মানীয় উনার মনের মত উনিও পরিচ্ছন্ন রাখতে অপারগ থাকেন। ইয়াং পুত্র বধু যদি কোন কাজ করে না দেয়, আবার উল্টো করে নিজের কাজের সাথে বৃদ্ধ শাশুড়িকে তুলনা করে, এসব বলে, তাহলে কেমন হয়? একটু ময়লা তার পরনের কাপড় তো হতেই পারে, যেহেতু কাপড় কাঁচতেও তো জোর লাগে। আগে পারলেও সব সময় তো মানুষ একরকম পারে না। কাজেই এটা পুত্রবধূ মেনে নিতে না পারলেও, ঘৃণা করে বলবে কেন? ৩০-৪০ বছর পরে তারও যে ওই রকম হবে, সে সেটা অনুধাবন করার ধারে কাছেও আসে না! ইত্যাদি। এই আমিই দেখেছি, বিপথগামী অযোগ্য গুনহীন নোংরা এবং খারাপ চরিত্রের একজন কিছু পৈত্রিক সম্পত্তি প্রাপ্তীদার পুরুষকে তার পুত্রবধূ ঐ সম্পদের লোভে, আব্বা আব্বা করে ডাকতে। এই কসাই শ্বশুর মশাইকে, আদর যত্ন করে ভালোবাসতে। তার স্বামীর জীবনের পিছনের কথা শুনেও ভুলে, তাকে মাথায় তুলে রাখতে অর্থাৎ যে শ্বশুর তার নবজাতক পুত্র সন্তান ও আতুর ঘরের অসুস্থ স্ত্রীকে ফেলে, হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে আনতে হবে, সেই পয়সা ড্রয়ার ভেঙে লুকিয়ে নিয়ে- অন্য নারীর হাত ধরে চপ্পল দিয়েছিলো। তাকেই বহুত আদর যত্ন করতে এবং ওই শশুরের উপর সন্তুষ্ট থাকতে। তাই বাবারা মায়েদের মত সমস্যায় পড়েন না। তার নিদানে দ্বিমত পোষণ এবং ঠেলাঠেলির হয়না। খালি হাড়ি তো কুকুরেও চাটে না, এখানে সেটাই প্রমাণ। সম্পদ না থাকাই গুণী শাশুড়ি হেও অপমানিত অবজ্ঞা অবহেলার শিকার হন। সম্পদ থাকায় বদমাইশ শশুর আদর যত্ন ভালবাসায় সম্মানিত হয়। আমি এটা লিখলাম কারো ছোট করার জন্য নয়। কারো অসম্মানিত করার জন্য নয়। লিখলাম ভুল থাকলেই সংশোধন আছে। আর ভুল তো মানুষই করে। এরকম ভুল যদি কোন মানুষের মধ্যে থাকে, সংশোধন হলে তো তার সেই মাটি সুখে থাকবেন সেই প্রত্যাশায়। সংশোধিত হলে সেই সব সম্মানিত মায়েরা একটু তো শান্তি পাবেন সেই প্রত্যাশায়। আমি আশা প্রত্যাশা করছি, পৃথিবীর সকল পুত্র তাদের মাকে সর্বোচ্চ মর্যাদায় অবিহিত করবে। সম্মানিত করবে। শ্রদ্ধা ভালোবাসায় ভরিয়ে দিয়ে, মায়েদের জীবন। রমজান নাকি মানুষের সুধরাতে আসে, সংযমী হতে শিখায়। তাহলে মায়েদের প্রতি দায়িত্ব পালনে পুত্র তার মাকে আল্লাহর পরেই সম্মান দিতে শিখুন। পৃথিবীর উপরে মা শ্রেষ্ঠ বন্ধু, সেই স্বীকৃতিতে মায়ের ভরণ পোষণ সময় দিতে সঙ্গ দিন নিঃস্বার্থে। আর কারো সাথে ভাগ না করে, ঠেলাঠেলি না করে। প্রত্যেকে আপনারা আপনাদের মায়ের কষ্টের সাথী হন। মা তো একজনই। কতই তার লাগবে বলুন তো? এটা বলার অর্থ স্ত্রীকে অপমান করা নয় বরং স্ত্রীর যোগ্য মূল্যায়ন করার শিক্ষা দেওয়া। যা আপনারই উদ্ধার বলেন আর দায়িত্ব বলেন করতে হবে। যেহেতু সমাজে আপনি পুরুষ বলে দাবীদার। আর পুরুষই নাকি ঘরের নারীর অভিভাবক। সে মা হোক, বোন হোক, স্ত্রী কন্যা যেই হোক। তাইতো একজন পুরুষ কর্তা হিসেবে সংসারের নারীদের ভালো-মন্দ আপনারই দেখা এখতিয়ারে আসে। কেননা ৩০/৪০ বছর পরে আপনার স্ত্রীও আপনার পুত্র কর্তৃক শ্রদ্ধা ভালোবাসা পেয়ে শান্তিতে দিনাতিপাত করবে। সেটাও আপনার দেখতে বা এখনই ঠিক করে রাখতে হবে। তখন আপনার স্ত্রীও আনন্দে শিক্ত হবে, ধন্য রবে। সেই প্রেরণায় স্ত্রীকে উৎসুক করা আপনার দায়িত্ব। যেহেতু সন্তানরাও তো বাবাকে দেখেই মায়ের প্রতি কর্তব্য পালন শিখবে। মায়ের ভালো থাকাও বুঝবে। বাবার আদর্শই তো পুত্র পাবে। আমি এখানে তার কন্যাকে আনবো না। কারণ কন্যাকে তো আর এক বাড়িতে পাঠানো হয়, সেখানে তার স্বামী সন্তান শশুর শাশুড়ির প্রতি কর্তব্য পালন করতে। দায়িত্ব পালন করতে। যদিও পুত্র কন্যা ভেদাভেদ না করে ইসলামে মা বাবার প্রতি সন্তানের ৮টা নির্দেশনা বিশেষভাবে লক্ষণীয়: ১. পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্বব্যবহার করা এবং তাদের প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করা। ২. সুন্দর ও মার্জিত ভাষায় কথা বলা। ৩. তাদের সুখ-শান্তির জন্য ধন সম্পদ ব্যয় করা। ৪. তাদের সঙ্গে বিনম্রভাবে চলাফেরা করা। ৬. যে কোনো বিষয়ে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করা। ৭. তাদের সঙ্গে কর্কশ ও বিশ্রী বাক্যে কথা না বলা। ৮. পিতা-মাতার মৃত্যুর পর তাদের জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে মাগফিরাতের দোয়া করা। তাদের ঋণ পরিশোধ করা। তাদের নছিয়ত ওসিয়তগুলো পূর্ণ করা। আসলে আমি চাই পৃথিবীর সব মায়ের জীবনে ছড়িয়ে পড়ুক এই রমজান থেকে তাদের সানমের বাকিসব দিনের জন্য, শান্তির আলো। মায়েরা ভালো থাকুন, ধন্য থাকুন, জীবন-মৃত্যু সরোবরে। জন্ম হলে মৃত্যু অবধারিত। তাই আমরা প্রত্যেকে প্রস্তুত থাকবো নিঃস্বার্থে বাবা-মায়ের শ্রদ্ধা ভালোবাসায় নিজেকে অটুট রাখতে। কেননা মা তো গায়ের রক্ত পানি করেছিলেন, মাথার ঘাম পায়ে ফেলেছিলেন, আদরের সন্তান তার একদিন বড় হলে, সকল দুঃখ কষ্ট যাতনা ঘুচে যাবে সেই প্রত্যাশায়। সেইদিন সে অনেক সুখে থাকবেন। অপার আনেন্দে ভাসবেন এমনটায় আশা ভরসায়।