টাইমস ২৪ ডটনেট, ঢাকা: বাংলাদেশের সীমান্তঘেঁষা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ চলছে। এ সংঘর্ষের জের ধরে বাংলাদেশের তুমব্রু, উখিয়া ও টেকনাফ সীমান্তে কয়েকশ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। ওইসব রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কায় সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বিজিবি। বৃহস্পতিবার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ১৩০ জন রোহিঙ্গা পৌঁছেছে। এছাড়াও তুমব্রু, উখিয়া ও টেকনাফ সীমান্তের ওপারে কয়েকশ রোহিঙ্গা অবস্থান নিয়েছে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করার জন্য। মিয়ানমারে চলমান সংঘাতের কারণে বাংলাদেশ যেন কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং নতুন করে দেশটি থেকে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ না ঘটে সে বিষয়ে সরকার বিশেষভাবে নজর রাখছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বেশ কিছুদিন ধরে সেনাবাহিনীর সাথে আরাকান আর্মির তীব্র লড়াই চলছে। এর জেরে বান্দরবানের তুমব্রু সীমান্ত ও কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তে ওপার থেকে মর্টার শেল ও গুলি এপারে এসে পড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে সীমান্তের বাসিন্দাদের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। একইসঙ্গে ওইসব সীমান্ত দিয়ে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তুমব্রু, উখিয়া ও টেকনাফ সীমান্তের ওপারে কয়েকশ রোহিঙ্গা অবস্থান নিয়েছে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করার জন্য।
এদিকে বৃহস্পতিবার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আরও ১৩০ জনেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী পৌঁছেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটিতে মিয়ানমারের মুসলিম সংখ্যালঘুদের আগমন ব্যাপকভাবে বেড়েছে। মিয়ানমারের নির্যাতিত ধর্মীয় সংখ্যালঘু রোহিঙ্গারা আচেহ প্রদেশের উপকূলে নামার সময় আচেহের স্থানীয়দের কাছ থেকে উপেক্ষা এবং শত্রুতার সম্মুখীন হয়েছে। গত বছরের অক্টোবর থেকে প্রায় ২ হাজার রোহিঙ্গা দেশটিতে পৌঁছেছেন বলে ইউএনএইচসিআরের তথ্যে দেখা গেছে।
ইন্দোনেশিয়ার ইউএনএইচসিআর-এর সুরক্ষা সহযোগী ফয়সাল রহমান বলেছেন, গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে ১৩০ জনেরও বেশি রোহিঙ্গা পূর্ব আচেহ এলাকায় পৌঁছেছেন। মূলত গত কয়েক বছর ধরে রোহিঙ্গারা মিয়ানমার ছেড়ে যাচ্ছে। নিজেদের দেশেই তাদেরকে নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে এবং তাদের সাধারণত দক্ষিণ এশিয়া থেকে মিয়ানমারে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নাগরিকত্ব হারানোর পাশাপাশি মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা জাতিগত নির্যাতনেরও শিকার হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আর তাই খারাপ অবস্থা থেকে বাঁচতে রোহিঙ্গারা প্রায়ই প্রতিবেশী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে থাকে। কেউ কেউ আবার নভেম্বর থেকে এপ্রিলের মধ্যে ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়ার দিকেও যাওয়ার চেষ্টা করেন। মূলত এই সময়টাতেই সমুদ্র অনেকটা শান্ত থাকে।
তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ জানিয়েছেন, সীমান্তরক্ষীরা অনেক আগে থেকেই সেখানে সতর্ক অবস্থানে আছেন। সরকার পরিস্থিতির ওপর বিশেষ নজর রাখছে। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল এ কে এম নাজমুল হাসান সীমান্তবর্তী এলাকা পরিদর্শন করে কর্মকর্তাদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে মুখপাত্র সেহেলী সাবরীন বলেন, মিয়ানমারে চলমান সংঘাতের কারণে বাংলাদেশ যেন কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং নতুন করে দেশটি থেকে নতুন করে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ না ঘটে সে বিষয়ে সরকার বিশেষভাবে নজর রাখছে। রাখাইনে চলমান সংঘাত মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তবে এই সংঘাতে বাংলাদেশ বা আমাদের নাগরিক যেন কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে জন্য বিশেষভাবে নজর রাখা হচ্ছে। একই সঙ্গে নতুন করে যেন অনুপ্রবেশ না ঘটে সে বিষয়ে বিশেষভাবে নজর রাখা হচ্ছে। মিয়ানমারে আমাদের দুটি কূটনৈতিক মিশন রয়েছে। দূতাবাস দুইটি সার্বিক বিষয়ে পর্যবেক্ষণ এবং প্রয়োজনে মিয়ানমারের সরকারের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছে। বিদ্যমান পরিস্থিতি এবং সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে মন্ত্রণালয় সরকারের সকল কর্তৃপক্ষ এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ঢাকার মিয়ানমার দূতাবাসের সঙ্গে নিবিড় ও তড়িৎ যোগাযোগ রক্ষা করছে। এছাড়া আমাদের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর সঙ্গে মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষের যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সাবেক সেনাপ্রধান লে. জেনারেল (অব.) হারুন অর রশীদ বলেন, আমাদের এখন কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানো ছাড়া আর কিইবা করার আছে। তবে তাদের গুলি যে আমাদের দেশে পড়ছে, এটা শক্ত প্রতিবাদ জানানো উচিত। পাশাপাশি আমাদের সবচেয়ে বন্ধু দেশ ভারত ও চীন। তারা কিন্তু মিয়ানমার ইস্যুতে আমাদের পক্ষে না। এটাও তাদের বোঝাতে হবে। এখন রাখাইনে যে সংঘাত হচ্ছে, তাতে এক পক্ষ জিতবে, অন্যপক্ষকে পালাতে হবে। যারা পালাবে, তারা কোথায় যাবে? সেখানেই কিন্তু আমাদের নিরাপত্তার সংকট। অস্ত্র গোলাবারুদ নিয়ে যদি কোন পক্ষ এদেশে চলে আসে তাহলে আমাদের জন্য উদ্বেগের কারণ। পাশাপাশি রোহিঙ্গারাও যাতে আর না আসতে পারে সেটাও দেখতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাখাইনসহ মিয়ানমারের একটি বড় অংশএরই মধ্যে বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। এসব জায়গা পুনর্দখল করতে জান্তা সরকার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। এমন বাস্তবতায় যাতে ফের রোহিঙ্গার ঢল বাংলাদেশের দিকে না আসে, সেটা নিশ্চিত করতে সীমান্তে কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ বলেন, বিভিন্ন ফ্রন্টে বিরোধী সশস্ত্র গ্রুপের তুমুল প্রতিরোধের কারণে জান্তা সরকার কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি। প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা আমাদেরও কাঁধে। নতুনভাবে যাতে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ঢুকতে না পারে, এটা নিশ্চিত করতে সীমান্তে নজরদারি বাড়াতে হবে। জান্তা সরকার বা বিদ্রোহী যারাই ক্ষমতায় থাকুক, আমাদের ফোকাস হবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা। জান্তা সরকার বা বিদ্রোহী, কারও পক্ষে বাংলাদেশ অবস্থান নেয়নি। বাংলাদেশ নিরপেক্ষ ভূমিকায় আছে। এই নিরপেক্ষতা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্র জোরালো করার সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে।