টাইমস ২৪ ডটনেট, ঢাকা: রুপগঞ্জের কায়েতপাড়া ইউনিয়নে বালু নদী থেকে উদ্ধার করা মৃত শিশু ওসমান গণি স্বাধীনকে (৯) খুন করা হয়েছে। জমি না দেওয়ায় একই ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও রংধনু গ্রুপের মালিক রফিকুল ইসলাম তাকে হত্যা করেন। বৃহস্পতিবার (১৪ই ডিসেম্বর) সকাল ১১টায় শিশুটির বাবা শাহিনুর রহমান শাহিন জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে শিশুটিকে হত্যা করা হয়েছে জানিয়ে অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান। এরআগে গত ১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় শিশুটি নিখোঁজ হয়। ৪ ডিসেম্বর নৌ-পুলিশের সদস্যারা শিশুটির লাশ উদ্ধার করে। শিশুটির বাড়ি কায়েতপাড়া ইউনিয়নের নাওড়া গ্রামে। অভিযুক্ত রফিকুল ইসলামের বাড়িও একই গ্রামে।
শাহিনুর রহমান বলেন, আমি শিশু স্বাধীনের হতভাগ্য পিতা। আজ আপনাদের সামনে এসেছি, কারণ আমার অবুঝ সন্তানের মৃত্যুটি স্বাভাবিক ছিল না। তাকে নৃশংসভাবে খুন করে লাশ গুম করার উদ্দেশ্যে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। আমাদের সন্তানকে খুন করা হয়েছে একজন প্রভাবশালীর নির্দেশে। অবুঝ সন্তান হত্যার বিচার পেতে আমরা থানায় গিয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারিনি। থানা তার নামে মামলা না দিয়ে অপমৃত্যুর মামলা করার পরামর্শ দেয়।
সাংবাদিকদের সহযোগিতা চেয়ে তিনি বলেন, আপনাদের সহযোগিতা ছাড়া আমরা সন্তান হত্যার বিচার পাব না। কারণ আমার অবুঝ সন্তানটির হত্যাকারী হলেন আমাদের ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও রংধনু গ্রুপের মালিক রফিকুল ইসলাম ও তার ভাই মিজানুর রহমান। তারা এলাকায় এত বেশি প্রভাবশালী যে সন্তানকে কবর দেওয়ার পর আমরা বাড়িতে থাকতে পারি না। বিচার কিভাবে পাব? তাদের লোকজন আমার সন্তানের হত্যাকান্ড নিয়ে কথা বললে আমাদেরকেও মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে। বাড়িতে পাহারা বসিয়েছে। নিজেদের জীবন বাঁচাতে বাড়ি ছেড়ে আমরা পালিয়ে বেড়াচ্ছি।
সন্তানের প্রকৃত অপরাধীদের বিচার চেয়ে শাহিন বলেন, সাংবাদিক ভাইয়েরা, আপনারা প্রয়োজনে কায়েতপাড়ার নাওড়া গ্রামে যান। নিজেরা অনুসন্ধান করেন। তাহলে বেরিয়ে আসবে আমার শিশুটির হত্যাকারীদের নাম। দয়া করে আপনারা আমার সন্তান হত্যার বিচারের ব্যবস্থা করেন। আমি আপনাদের কাছে সন্তানের প্রকৃত খুনীদের বিচার চাই। আমি একা বললে এ হত্যাকান্ডের বিচার কখনোই হবে না। কারণ রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম কায়েতপাড়া ইউনিয়য়নের সর্বত্র ভয়, আতংক আর ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছেন। আমাদের এলাকায় রফিকের শাসনই শেষ কথা। রফিকের কথা মনে হলে এই ইউনিয়নের সাধারণ মানুষ নিঃশ্বাস নিতেও ভয় পায়।
নিজের বাড়ির না দেওয়াতে রফিকুল ইসলাম সন্তানকে খুন করেছেন দাবি করে স্বাধীনের বাবা বলেন, রফিকুল ইসলাম গত ২ মাস আগে আমাদের বাড়ি নামমাত্র দামে কিনতে তার বোনকে পাঠান। তার সঙ্গে আরেকজন মহিলাও ছিল। তারা আমাদের বাড়িটি রফিকুল ইসলাম কিনতে চান বলে জানালে আমার বাবা রেজাউল করিম বলেন, মাগো বাড়ি বিক্রি করলে আমরা থাকবো কই। তারপরও যদি কখনো বিক্রি করি আমি নিজেই রফিক সাহেবের বাড়িতে গিয়ে দিয়ে আসবো, তোমাদের আর কষ্ট করে আসতে হবে না।
তিনি বলেন, এরপর থেকে রফিকুল ইসলাম শুরু করেন ক্যাডার বাহিনী দিয়ে হামলা, নির্যাতন, নিপীড়ন, চাঁদাবাজি। আমার ছেলেকে খুন করার দুই মাস আগে থেকে একাধিকবার বাড়িতে হামলা করা হয়েছে। দোকানে দুই দফা আমার বাবা এবং আমার ওপর হামলা করে মারধর করে। পরে আমাদের দোকানটি বন্ধ করে দিয়েছে। তারপরও পরিবার নিয়ে থাকার বাড়িটি বিক্রি করতে রাজি হয়নি। আমার সন্তানকে হত্যার এক সপ্তাহ আগে রফিকুলের ভাই মিজানুর রহমান উচিত শিক্ষা দিবেন বলে বাড়িতে এসে হুমকি দিয়ে যান। রফিকুল ইসলামের চিহ্নিত ক্যাডার ফারুক পিস্তল দেখিয়ে বলে এমন মারা মারবো, কবরে গিয়েও শান্তি পাবি না। এসব ঘটনার ঠিক এক সপ্তাহ পরে আমার সন্তানটি নিখোঁজ হয়। এরপর আমরা ওসমান গণি স্বাধীনের বীভৎস লাশ পাই।
শাহিনুর রহমান বলেন, অবুঝ সন্তানের এমন করুণ মৃত্যূতে ওর মা আর দাদা পাগল প্রায়। বাবা হিসাবে আমার অবস্থা কেমন তা যারা সন্তান হারিয়েছেন তারাই বুঝবেন। এখন মনে হচ্ছে ওসমান গণি স্বাধীন হত্যার জন্য আমি এবং আমার পরিবারও দায়ী! কারণ আমরা আমাদের বাড়িটি রফিকুল ইসলামকে দিয়ে দিলে আমার শিশু সন্তানটির এমন করুণ পরিণতি হত না। রফিকুল ইসলামের চাওয়া যে কত গুরুত্বপূর্ণ ও আমাদের ৩৭ শতাংশের বসতভিটিটা যে তার খুবই প্রয়োজন ছিল সেটা আমার সন্তানকে মেরে রফিকুল ইসলাম বুঝিয়ে দিয়েছেন। রফিকুল ইসলাম জায়গার জন্য এমন জঘন্য কাজ করবেন, সেটা বুঝতে পারলে অনেক আগেই বাড়িটা দিয়ে দিতাম।
আমার নয় বছরের শিশুটির লাশ যারা দেখেছেন সবাই কেঁদেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, সবাই আল্লাহর কাছে দুহাত তুলে বিচার দিয়েছেন। কারণ তার লাশ যাতে শনাক্ত না করা যায়, পুরো মুখ থেঁতলে দেওয়া হয়েছে। পুরো শরীর এসিড জাতীয় কিছু দিয়ে ঝলসে দিয়েছে। আমি অবুঝ ওসমান গণি স্বাধীনের উপর এমন হিংস্র আক্রমণের বিচার চাই। আমাদের সন্তানকে এত বেশি কষ্ট দিয়ে মেরেছে যে, আমাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল এই লাশটি আমাদেরই সন্তান। পরনের প্যান্ট দেখে আমরা ওসমান গণিকে শনাক্ত করি। লাশ উদ্ধারে অংশ নেওয়া নৌ-পুলিশের সদস্যরাও অনেক আফসোস করে বলেছেন, এমন বীভৎস ও নৃশংসভাবে কাউকে হত্যা করা লাশ এর আগে কখনো তাদেরকে উদ্ধার করতে হয়নি। প্রয়োজনে আপনারা নৌ-পুলিশের উপ-পরিদর্শক আসাদুজ্জামান সাহেবের কাছে যান। উনি আমার সন্তানের লাশ উদ্ধার করেছেন। উনি বলবেন কতটা নির্মম ছিল এ হত্যাকান্ড।
শাহিনুর রহমান বলেন, ১ ডিসেম্বর শুক্রবার সন্ধ্যায় আমার শিশুপুত্র স্বাধীন নিখোঁজ হলে আত্মীয় স্বজনসহ ২০-৩০ জন মিলে অনেক খোঁজাখুজির পরও পাই নাই। এরপর রাত আটটার দিকে তার সন্ধান চেয়ে মাইকিং শুরু করলে রফিকুল ইসলামের লোকজন এসে বাধা দেয়। তারা বলেন, রফিকুল ইসলামের নির্দেশ এ বিষয়ে কোন মাইকিং করা যাবে না। এ ছাড়া রফিকুল ইসলামের লোকজন লাশ উদ্ধারের আগে পর্যন্ত আমাদেরকে বিভিন্নভাবে বিভ্রান্ত করতে থাকে। একবার বলে অমুক জায়গায় দেখছি, আবার বলে অন্য জায়গায় দেখেছি। সন্তানকে ফিরে পাওয়ার আশায় তাদের কথামত তিন দিন আমরা দিক-বেদিক পাগলের মত ছুটে বেড়িয়েছি। অথচ তারা যেদিন নিখোঁজ হয়েছে সেদিনই আমার সন্তানকে মেরে ফেলেছে। কারণ আমার ছেলের লাশে পচন ধরে গিয়েছিল। এখন তারা সব জায়গায় বলে বেড়াচ্ছে আমার সুস্থ-সবল সন্তানটি নাকি প্রতিবন্ধী ছিল। সে পানিতে পড়ে মরে গেছে! আপনারা আমাদের এলাকায় গিয়ে খবর নেন, সে আসলে প্রতিবন্ধী ছিল কিনা!
রফিকুল ইসলামের সন্তানের লাশ দেখতে দেয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, আমার সন্তানের লাশ ময়নাতদন্ত শেষে বাড়ি নিয়ে আসি। বাড়িতে এসে দেখি রফিকুল ইসলামের লোকজন হুজুর নিয়ে অপেক্ষা করছে। বাড়িতে গাড়ি আসার পর তারা ওসমান গণি স্বাধীনের কাছে আর আমাদের যেতে দেয়নি। আমার সন্তানের মরদেহটাও শেষবারের মত কাউকে দেখতে দেয়নি। রফিকুল ইসলামের নির্দেশে পরিবারের অনুমতি না নিয়েই রাতের অন্ধকারে আমার শিশুটিকে কবর দেয়।
ভাইয়েরা আপনাদের কাছে জানতে চাই, আমার অবুঝ সন্তানের সঙ্গে এটা কি হলো? কেন এমন হলো? সে তো ফেরশতা। সে তো ন্যায়, অন্যায়, ভুল সঠিক কিছুই বুঝে না। রফিকুল ইসলাম- মিজানুর রহমান ওরে কেন মারলো? আমরা জায়গা দিই নাই, আমাদেরকে মেরে ফেলতো। আমি শুধু বলবো, আর কারো অবুঝ সন্তানের যেন এমন করুণ পরিণতি না হয়। আর কোন পরিবারকে যেন সন্তান হারানোর এমন শোক সইতে না হয়। এ জন্য এমন জঘন্য অপরাধীর ফাঁসি হতে হবে।
সন্তানের হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমীলক বিচার চেয়ে তিনি বলেন, আমি আপনাদের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ হত্যাকান্ডের বিচার চাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এমন দৃষ্টান্তমূলক বিচার করুন, যাতে করে এসব বর্বর, জানোয়ার, পাষন্ড মানুষ নামের পশুগুলো আর কারো অবুঝ সন্তানকে খুন করার সাহস না পান। আর কারো মায়ের বুক যাতে খালি না হয়।