সুকুমার সরকার, টাইমস ২৪ ডটনেট, ঢাকা: রাজধানী ঢাকার অদূরে সাভার থানার শিমুলিয়া গ্রামে হরিপদ পালের। তবে এখন থিতু হয়েছেন পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী শাঁখারীবাজার কালীমন্দিরের পাশেই। সেখানে শিমুলিয়া ভাস্কর শিল্পালয় নামে প্রতিমা গড়ার ঠিকানা নিয়েছেন। ঘরের ঝাঁপ বন্ধ করে নিশ্চুপ কাজ করে চলেছেন ৮০ বছরের হরিপদবাবু। ঘরের দরজাটাই শুধু খোলা। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই ভেতরে কী কর্মযজ্ঞ চলছে। ঘরের এক কোনায় খড় আর মাটির স্তূপ। অন্য পাশে দুর্গা, গণেশ, লক্ষ্মীসহ বিভিন্ন দেবদেবীর প্রতিমা। শার্ট আর লুঙ্গি পড়ে তুলির শেষ আঁচড়ে ব্যস্ত ছিলেন হরিপদবাবু। কথা প্রসঙ্গে হরিপদবাবু বললেন, ‘অনেকের চোখে আমি হয়তো সুন্দর প্রতিমা গড়ি। কিন্তু আমি জানি, মা তার চেয়েও সুন্দর। প্রতিমা বানানোর সময় মনে মনে বলি—মাগো, তুমি সাজো। সুন্দর হও।’
কাজের মানুষ হরিপদ পাল প্রায় ৬০ বছর ধরে প্রতিমা তৈরি করছেন। কাজের সুবাদে যুক্তরাষ্ট্রেও গিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক হেনরি গ্লাসির দুটি বইয়েও ঠাঁই পেয়েছে তাঁর কাজ। এবার শাঁখারীবাজারের নবকল্লোল পূজামণ্ডপসহ ঢাকার দুটি মণ্ডপের প্রতিমা গড়েছেন তিনি। বংশপরম্পরায় প্রতিমা গড়ার কাজ হরিপদবাবুর। শৈশবে বাপ-দাদাদের দেখেছেন প্রতিমা গড়তে। হরিপদ বাবুরও হাতেখড়ি দাদুর হাতেই। তাঁর বাবা ঝরু পাল অবশ্য চাইতেন না ছেলে এই পেশায় আসুক। বলতেন, ‘ঠিকমতো লেখাপড়া করো।’ কিন্তু তাতে হরিপদের আগ্রহে ভাটা পড়েনি। হাই স্কুলে থাকতে সরস্বতীপুজোর সময় প্রতিমা বানানোর কাজটা পড়ত হরিপদবাবুর ঘাড়ে। গতানুগতিক পড়াশোনায় মন বসত না। অষ্টম শ্রেণির পর আর স্কুলের গণ্ডি মাড়াননি।
প্রতিমা গড়তে যখন যেখানে ডাক পড়েছে চলে গেছেন তিনি। নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে প্রতিমা গড়েছেন। কাজ শিখিয়েছেন শতাধিক তরুণকে। এখন ঢাকায় প্রতিমাশিল্পী হিসেবে যাঁরা তাঁদের প্রায় সবাই কোনো না কোনো সময় তাঁর কাছ থেকে কাজ শিখেছেন। প্রতিমা গড়ার নেশা হরিপদবাবুকে পেয়ে বসেছিল কৈশোরেই।
ঢাকার অদূরে নরসিংদী জেলায় তাঁর সরস্বতীর প্রতিমা সেরা হয়েছিল। নগদ পুরস্কার পেয়েছেন, সঙ্গে গোল্ড মেডেলও। বছর দুয়েকের মতো নরসিংদীতে ছিলেন। সেখান থেকে ঢাকার তাঁতীবাজারে। ১৯৬৩ সালে বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে ভর্তি হয়েছিলেন। আরো ভালোমতো কাজ শিখবেন বলে মাঝখানে একবার কলকাতাও গিয়েছিলেন। সেখানে বছরখানেক রাখাল পালের শিষ্য হয়েছিলেন। এর পরের ঠিকানা ৫২ শাঁখারীবাজার, ঢাকা।
হরিপদবাবুর বয়স এখন আশির কোঠায়। সুগারসহ নানা রোগ বাসা বেঁধেছে শরীরে। আগের মতো খাটতে পারেন না। এখন নকশাটা এঁকে দেন। কারিগররা তা ধরে কাজ করেন। তবে চূড়ান্ত ধাপের কাজটা তিনি করেন। দুর্গাপুজোয় আগে প্রায় ১০টির মতো প্রতিমার ফরমাশ নিতেন। এখন দু-তিনটির বেশি নেন না। বললেন, ‘আগে তো অনেক জায়গা থেকে অর্ডার নিতাম। এবারও প্রচুর অর্ডার এসেছিল। কিন্তু শরীরটা ভালো না। তাই সবার কথা রাখতে পারিনি। এবার কেবল দুটি প্রতিমা করছি। দুজন কারিগর তাঁকে সহযোগিতা করেন। বছরজুড়েই কমবেশি ফরমাশ থাকে তাঁর। তবে দুর্গাপুজো এলে ব্যস্ততা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। সকালে জলখাবার শেষে কাজে ডুবে শেষ হতে রাত ১২টা বেজে যায়। দুর্গাপুজো এলে রুটিন বদলে যায়। কাজ চলে রাতভর। স্ত্রী মালবিকা পাল বললেন, উনি ‘সারা দিন কাজ নিয়েই থাকেন। এর বাইরে যেন সংসারে আর কিছুই দেখার নেই।’