টাইমস ২৪ ডটনেট: হামাসের আকস্মিক রকেট হামলায় ইসরায়েলের অন্তত ৪০ জন নিহত হয়েছে। তাছাড়া আহত হয়েছে আরও ৭৫০ জন। গত কয়েক বছরের মধ্যে ইসরাইলে সবচেয়ে বড় আক্রমণ চালিয়েছে ফিলিস্তিনের হামাস গোষ্ঠী। গাজা উপত্যকা থেকে ইসরাইলের দক্ষিণাঞ্চল লক্ষ্য করে পাঁচ হাজার রকেট ছুড়েছে তারা। হামাসের আচমকা হামলার জবাবে গাজা উপত্যকায় ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলও। এতে অন্তত ২০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও সহস্রাধিক। হামাসের হামলার জবাবে এবার গাজা উপত্যকায় যুদ্ধ পরিস্থিতি ঘোষণা করে বিমান হামলা শুরু করেছে ইসরাইল। শনিবার ইসরাইলের বেশ কয়েকটি শহরে আকস্মিক হামলা চালায় হামাস। ইসরাইলের ম্যাগেন ডেভিড অ্যাডম (এমডিএ) রেসকিউ সার্ভিসের মতে, হামাসের নজিরবিহীন এ হামলায় অন্তত ৪০ জন নিহত এবং ৭৫০ জনের বেশি আহত হয়েছে। নিহত বা আহতদের মধ্যে কতজন বেসামরিক নাগরিক তা সঠিক তথ্য জানায়নি। অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা থেকে শনিবার একের পর এক রকেট ছোড়া হয়েছে ইসরাইলের শহরগুলোকে লক্ষ্য করে। এ হামলায় অন্তত দুইজন ইসরাইলি নাগরিক নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে ইসরাইলের সরকারি টিভি চ্যানেল ‘কান’। অন্যদিকে টাইমস অভ ইসরাইল জানিয়েছে, হামাসের হামলায় অন্তত ৪০ জন নিহত হয়েছেন। ইসরাইলের আরেক শীর্ষ সংবাদমাধ্যম হারেৎজ ইমারজেন্সি সার্ভিসেস রিপোর্টের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, হামলায় অন্তত ৪০ জন ইসরাইলি নিহত হয়েছেন। এছাড়া ইসরাইলি সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে আল জাজিরা জানিয়েছে, এ হামলায় আহত হয়েছেন প্রায় ৭৫০ জন। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, শনিবার ভোরে হামাসের আকস্মিক হামলার পর দেশ যুদ্ধের মধ্যে রয়েছে। ইসরাইলের নাগরিকরা, আমরা যুদ্ধে আছি। কোনো অপারেশনে নয়, রাউন্ডে নয়, যুদ্ধে। ইসরাইলের সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র ড্যানিয়েল হাগারি বলেন, সকাল সাড়ে ৬টা থেকে এখন পর্যন্ত ইসরইলে ৫০০০ রকেট ছুড়েছে হামাস। এ ছাড়াও স্থল, আকাশ ও নৌপথে হামাসের সদস্যরা ইসরাইলে প্রবেশ করছেন। দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট এক বিবৃতিতে বলেছেন, ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে হামাস গুরুতর ভুল করেছে। আইডিএফ সৈন্যরা (ইসরাইলি সেনাবাহিনী) প্রতিটি অবস্থানে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় জানিয়েছে, রকেট হামলার বিষয়ে নিরাপত্তা পরিষদের প্রধানরা বৈঠক করবেন। হামলার দায় স্বীকার করে হামাসের নেতা মোহাম্মেদ দেইফ বলেন, আমরা শনিবার ইসরাইলের উদ্দেশে পাঁচ হাজার রকেট ছুড়েছি। এর মধ্য দিয়ে আমরা অপারেশন আল-আকসা স্টর্ম শুরু করে দিয়েছি। দেইফ বলেন, যথেষ্ট হয়েছে। ইসরাইলকে আমরা উপযুক্ত জবাব দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দেশপ্রেমিক সব ফিলিস্তিনিকে এই যুদ্ধে যোগ দেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। এদিকে ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছেন, দক্ষিণ ইসরাইলে ফিলিস্তিনি যোদ্ধা ও ইসরাইলি নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর মধ্যে লড়াই চলছে। যুদ্ধ শুরুর পর গাজায় মানুষজন কয়েকদিন চলার মতো জিনিসপত্র কেনার জন্য দোকানে ভিড় জমিয়েছে। অনেকেই নিজ বাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে রওনা দিয়েছেন। হামাসের সামরিক কমান্ডার মোহাম্মদ দেইফ জানিয়েছেন, ইসরাইলের উদ্দেশ্যে ৫ হাজার রকেট ছোড়া হয়েছে। এর পাশাপাশি তিনি সব ফিলিস্তিনিকে লড়াইয়ে যোগ দিতে আহ্বান জানান। অন্যদিকে ইসরাইলের পুলিশ প্রধান কোবি শাবতাই বলেছেন, ইসরাইলি বাহিনীও পাল্টা আক্রমণে হামাসের কয়েকজন যোদ্ধাকে হত্যা করেছেন। এ পরিস্থিতিতে তিনি বেসামরিক নাগরিকদের ঘরে অবস্থান করার আহ্বান জানিয়েছেন। ইসরাইলের ও ফিলিস্তিনি দ্বন্দ্ব নতুন কিছু নয়। ২০২১ সালের ১০ দিনের যুদ্ধের পর এটিই ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আরবভূমির বুকে তৈরি ইহুদি দেশটিকে জন্মলগ্ন থেকেই ধ্বংস করার চেষ্টা চালাচ্ছে পাশের মুসলিম দেশগুলো। এপর্যন্ত একাধিক যুদ্ধও হয়েছে দু’পক্ষের মধ্যে। ফের নতুন করে প্যালেস্টাইনের জঙ্গি গোষ্ঠী হামাসের হামলার পরে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গেল। অপরদিকে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় পাল্টা ইসরায়েলি বিমান হামলায় অন্তত ২০০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন এক হাজারেরও বেশি মানুষ। বিমান হামলায় এত মানুষ নিহত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ফিলিস্তিনের স্থানীয় কর্মকর্তারা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত কয়েকটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, গাজার বিভিন্ন উঁচু ভবন থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলি বের হচ্ছে।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা জানিয়েছে, ইসরায়েলের যুদ্ধবিমান বেসামরিক ভবন লক্ষ্য করেও হামলা চালাচ্ছে। ফলে বহু মানুষ হতাহত হয়েছেন। এছাড়া ইসরায়েলের বিমান হামলার তীব্রতা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে বলেও জানিয়েছে সংবাদমাধ্যমটি। আল জাজিরা আরও জানিয়েছে, গাজার হাসপাতালগুলো আহত ও নিহত মানুষে ভরে গেছে। সেখানকার স্থানীয় প্রশাসন, সাধারণ মানুষকে রক্তদানে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে।
শনিবার গাজার সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস ইসরায়েলের অবৈধ বসতি লক্ষ্য করে আকস্মিক হামলা চালায়। এ সময় তারা বেশ কয়েকজন ইসরায়েলি সেনাকে আটক করেন বা গুলি করে হত্যা করেন। এছাড়া অবৈধ বসতিস্থাপনকারী বেসামরিক অনেক মানুষকেও আটক করা হয়।
হামাসের এই হামলার পরপরই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু হুমকি দেন গাজা লক্ষ্য করে হামলা চালানো হবে। তিনি ইসরায়েলিদের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেন, এ মুহূর্তে আমি রিজার্ভ সেনাদের জড়ো করা এবং শক্তিশালী প্রতিশোধমূলক জবাব দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছি, যা শত্রুরা কখনো কল্পনা করেনি। শত্রুরা এমন মূল্য দেবে যা তারা ভাবতেও পারেনি। আমি সাধারণ মানুষকে সেনাবাহিনীর নির্দেশনা কঠোরভাবে মেনে চলার আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা এখন যুদ্ধে আছি এবং আমরা এ যুদ্ধে জয়ী হব। এই ভাষণের কিছু সময় পর থেকে গাজা উপত্যকায় হামলা শুরু করে ইসরায়েলি বিমান বাহিনী।
এদিকে, বিগত দু’বছরের মধ্যে ইসরায়েলে সবচেয়ে বড় ও প্রাণঘাতী হামলা চালাচ্ছে ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাস। এতে এখন পর্যন্ত ৪০ ইসরায়েলির মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছেন অন্তত ৭৫০ জন। বেশ কয়েকজন ইসরায়েলি সেনাকে জিম্মি করেছে হামাস যোদ্ধারা। গাজা সীমান্তের বেশ কয়েক জায়গায় গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ইসরায়েলিদের বসানো বেড়া। আল-আকসা মসজিদের অমর্যাদা এবং অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়ায় এই সামরিক অভিযান চালানো হচ্ছে বলে দাবি করেছে হামাস। তবে তাদের এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে পশ্চিমা বিশ্ব। চেক প্রজাতন্তের পুরোনো মিত্র ইসরায়েলে ‘সন্ত্রাসী হামলা’ শুরু করায় হামাসের নিন্দা জানিয়েছে প্রাগ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র প্রধান জোসেপ বোরেল ইসরায়েলের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন।
ফরাসি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘ইসরায়েল এবং এর জনগণের বিরুদ্ধে চলমান সন্ত্রাসী হামলার’ নিন্দা এবং ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পূর্ণ সংহতি প্রকাশ করছে ফ্রান্স। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রী জেমস ক্লিভারলি বলেছেন, ইসরায়েলে ফিলিস্তিনি ইসলামপন্থি দল হামাসের আকস্মিক হামলার ‘দ্ব্যর্থহীন নিন্দা’ জানায় যুক্তরাজ্য। জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক বলেছেন, তিনি ইসরায়েলে হামাসের হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডের লিয়েন বলেছেন, আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হামাস ‘সন্ত্রাসীদের’ পরিচালিত হামলার নিন্দা করছি। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন উত্তেজনা বৃদ্ধির জেরে ‘গুরুতর পরিণতি’ সম্পর্কে সতর্ক করেছে মিশর। সবাইকে ‘সর্বোচ্চ সংযম অনুশীলন এবং বেসামরিক নাগরিকদের বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া’ এড়ানোর জন্য আহ্বান জানিয়েছে তারা।
রাশিয়ার ডেপুটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিখাইল বোগদানভ জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক উত্তেজনার জেরে ইসরায়েল, ফিলিস্তিনি ও আরব দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করছে রাশিয়া। তিনি বলেছেন, এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আমরা সর্বদা সংযমের আহ্বান জানাই। ইউক্রেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, জেরুজালেম এবং তেল আবিবের বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে রকেট হামলাসহ ইসরায়েলে চলমান ‘সন্ত্রাসী হামলার’ তীব্র নিন্দা জানায় ইউক্রেন। আমরা ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার এবং তার জনগণের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করি। লেবাননের সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহ বলেছে, তারা গাজা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং ‘ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ গোষ্ঠীর নেতৃত্বের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখছে’।