টাইমস ২৪ ডটনেট, ঢাকা: গত কয়েকদিনে টানা বর্ষণ, পাহাড়ি ঢল ও জোয়ারের জলে বাংলাদেশে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের নিম্নাঞ্চল ডুবে গেছে। জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে পুরো পার্বত্য অঞ্চলে। জলাবদ্ধতার গত ৩০ বছরের রেকর্ড ভেঙ্গে গেছে চট্টগ্রাম ও বান্দরবান। জলে তলিয়ে গেছে বসতঘর-আবাদি জমি। কক্সবাজারে কয়েক লাখ মানুষ জলবন্দি। বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। চলমান প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী উদ্ধার কাজ করছে। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের সর্বোচ্চ ২৬৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে বান্দরবানে। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে অনেক এলাকা। ভোগান্তিতে পড়েছেন হাজারো মানুষ।
জানা গেছে, গত ৭ দিনের টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় চট্টগ্রাম নগরী, চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, লোহাগড়া, পটিয়া ও চন্দনাইশ জলে ডুবে গেছে। জলবদ্ধতার কারণে কয়েক লক্ষাধিক মানুষ জলবন্দি হয়ে রয়েছেন। এসব এলাকায় বন্যা ভয়াবহ পরিস্থিতি ধারণ করছে। ভেসে যাচ্ছে ঘরবাড়ি, দুর্ভোগ পোহাচ্ছে বানভাসি মানুষেরা। তবে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছেন, গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম ও বান্দরবানে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। মানুষ পানিবন্দি হওয়ার পাশাপাশি ভূমিধসের জন্য আশঙ্কা দেখা দিয়েছে বিস্তৃত এলাকায়। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় দুই জেলায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করা এসেছে। চট্টগ্রাম ও বান্দরবানে বন্যা পরিস্থিতি ও ভূমিধস মোকাবিলায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় বান্দরবান সদর, রুমা, আলীকদমসহ জেলার বেশিরভাগ এলাকা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়েছে। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে টানা বৃষ্টিতে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। প্রাণ বাঁচাতে অনেকে সাইক্লোন সেন্টারে আশ্রয় নিয়েছেন।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, জেলার প্রধান দু’টি পাহাড়ি নদী সাঙ্গু ও মাতামুহুরির ন্যাব্যতা কমে যাওয়া এবং এই নদীর তীরবর্তী এলাকা ঘিরে গড়ে ওঠা প্রধান শহর, উপজেলা শহর এবং জনবসতিপূর্ণ গ্রামগুলো অল্প বৃষ্টিতেই পানিতে তলিয়ে যায়। জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে দুর্ভোগের শিকার হতে হয়। শুধু বান্দরবান নয়, মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় দুইশ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। নিকলিতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ২৩৫ মিলিমিটার, বগুড়ায় বৃষ্টিপাত হয়েছে ২১৩ মিলিমিটার এবং ভোলায় ২১০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। তবে আগামী তিনদিনে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা কমতে পারে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর। মঙ্গলবার সকাল থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাসে এ তথ্য জানানো হয়েছে। ঢাকায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ৫৪ মিলিমিটার। জলে ডুবে সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বান্দরবানের সদর উপজেলা। এই উপজেলার ৮০ শতাংশ এলাকা এখন জলের নিচে। নেই বিদ্যুৎ ও মোবাইল ইন্টারনেট। সংকট দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ জলের।
জানা গেছে, টানা সাত দিনের লাগাতার বৃষ্টির কারণে ডুবেছে বান্দরবানের বেশিরভাগ নিম্নাঞ্চল। বৃষ্টি না থামার কারণে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। রবিবার রাত থেকে শহর বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এতে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। ভারী বর্ষণের ফলে পাহাড় ধসের আশঙ্কাও জেগেছে। বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে সাঙ্গু নদীর জল। প্লাবিত এলাকা ও পাহাড় ধসে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মানুষরে জন্য খোলা হয়েছে ১৯২টি আশ্রয়কেন্দ্র। এর মধ্যে সদরেই খোলা হয়েছে ২৪টি আশ্রয় কেন্দ্র।
বান্দরবান বিদ্যুৎ বিভাগে কর্মরত আবু তাহের রানা বলেন, চট্টগ্রামের দোহাজারীর সাবস্টেশন থেকে রবিবার রাত থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বর্তমানে শহরের কোথাও বিদ্যুৎ নেই। কখন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে তাও জানি না।
রাঙামাটিতে গত বুধবার থেকে শুরু হয়ে টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলের কারণে বাঘাইছড়ি উপজেলার বেশ কিছু ইউনিয়ন ও পৌর এলাকা জলে তলিয়ে গেছে। মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত খবর নিয়ে জানা যায়, উপজেলার বঙ্গলতলী, বাঘাইছড়ি, রূপকারী, মারিশ্যা, আমতলী ও খেদারমারা ইউনিয়নসহ বাঘাইছড়ি পৌরসভার ১,২,৪, ৬ ও ৭নং ওয়ার্ডের নিচু অঞ্চলের বসতবাড়ি, আবাদি জমি ও রাস্তা পাহাড়ি ঢলের পানিতে তলিয়ে জনজীবনে দুর্ভোগ দেখা দিয়েছে। বাঘাইছড়ি ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য দিদারুল আলম বলেন, আমাদের পূর্ব লাইল্যাঘোনা এলাকাটি ভৌগোলিকভাবে নিচু এলাকা যার ফলে দ্রুত কাচালং নদীর জল বাড়ি-ঘরে ঢুকে যায়। আমরা ইতোমধ্যে সবাইকে নিরাপদে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে এসেছি।
সূত্র আরও জানায়, রাঙামাটিতে টানা সাত দিনের মাঝারি ও ভারী বর্ষণে পাহাড় ধসে ৩৮১ বসতঘর ধসে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে আহত হয়েছে ১০ জন। গতকাল মঙ্গলবার সকালে ভারী বর্ষণে বাঘাইছড়ি, জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি ও বরকল উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ।
এদিকে ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজারের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টার টানা বৃষ্টিতে আরও নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ায় জেলার ৭ উপজেলা এখন প্লাবিত। এসব উপজেলার অন্তত ৪ লাখ মানুষ জলবন্দি হয়ে পড়েছেন। জলের কারণে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী কুতুবদিয়ায় ৭০০ পরিবার, পেকুয়াতে ১০ হাজার পরিবার, মহেশখালীতে ৫০০ পরিবার, চকরিয়ায় ৫০ হাজার পরিবার, কক্সবাজার সদরে ১ হাজার পরিবার, ঈদগাঁও উপজেলায় ১৫০ পরিবার জলবন্দি রয়েছে।
টানা বৃষ্টিতে চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলায় ডুবে গেছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক। এতে মঙ্গলবার ভোর থেকে এ সড়কের কসাইপাড়া পাঠানিপুল এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সড়ক বন্ধ থাকায় দুই পাশে কমপক্ষে দুই কিলোমিটার যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। কিছু কিছু যানবাহন বিকল্প সড়ক বাঁশখালী হয়ে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম শহরে আসা যাওয়া করছে।
জেলা প্রশাসক শাহীন ইমরান আরও বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অনেক জায়গায় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। এসব এলাকাসহ উদ্ধার কার্যক্রমে সেনাবাহিনী যোগ দিয়েছে। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, কুতুবদিয়ায় ৭০০ পরিবার, পেকুয়াতে ১০ হাজার পরিবার, মহেশখালীতে ৫০০ পরিবার, চকরিয়ায় ৫০ হাজার পরিবার, কক্সবাজার সদরে ১ হাজার পরিবার ও ঈদগাঁও উপজেলায় ১৫০ পরিবার জলবন্দী রয়েছে।
জানা গেছে, খাগড়াছড়ির মাইনী নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় প্লাবিত হয়েছে নিচু এলাকা। মেরুং ইউনিয়নে বেইলি ব্রিজ ডুবে যাওয়ায় খাগড়াছড়ির সঙ্গে লংগদুর সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। গত মঙ্গলবার রাত থেকেই সড়কটিতে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে বলে জানিয়েছে মেরুং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহমুদা বেগম লাকি।
অতি বৃষ্টি ও বন্যা পরিস্থিতির কারণে বুধ ও বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামসহ চার জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। বাকি তিন জেলা হলো-বান্দরবান, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি। মঙ্গলবার রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে এইচএসসি পরীক্ষা নিয়ে আয়োজিত ব্রিফিংয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এ তথ্য জানান। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, সেখানে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। এজন্য কাল ও পরশু বান্দরবান, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রাম জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে।