জাতীয়বাংলাদেশ

বঙ্গবাজার শুধুই পোড়াস্তূপ

টাইমস ২৪ ডটনেট, ঢাকা: বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার বঙ্গবাজার এখন শুধু পোড়াস্তূপ। গত সোমবার যেখানে রঙিন কাপড়গুলো মোড়ানো ছিল স্বচ্ছ পলিব্যাগে, বুধবার সেই সব কাপড়ের রঙ একই কালো। গত সোমবার ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাকে যে বাজার ছিল জমজমাট বুধবার সেখানে ধ্বংসস্তুপ আর ব্যবসায়ীদের হাহাকার। বঙ্গবাজারের ভয়াবহ আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের বঙ্গ ইসলামীয়া মার্কেট, বঙ্গ হোমিও কমপ্লেক্স, বঙ্গবাজার মার্কেট, এনেক্সকো টাওয়ার, মহানগর শপিং কম্প্লেক্স, আদর্শ মার্কেট, গুলিস্তান মার্কেটে। এইসব মার্কেটের কিছু মালামাল ব্যবসায়ীরা বের করতে পারলেও পুড়ে গেছে বেশিরভাগ মালামাল। ব্যাংক ঋণ পরিশোধে সরকারের কাছে বিনা সুদে ঋণ সহায়তা চেয়েছেন বঙ্গবাজারের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি একই স্থানে পুনরায় ব্যবসা পরিচালনার ব্যবস্থা করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
জানা গেছে, রাজধানীর বঙ্গবাজারে ভয়াবহ আগুন ছড়িয়ে পড়ে পাশের সাততলা এনেক্সকো টাওয়ারে। অগ্নিকাণ্ডের পর দুইদিন পেরিয়ে গেলেও এনেক্সকো টাওয়ারের জল ছেটানো অব্যাহত রেখেছে ফায়ার সার্ভিস। এনেক্সকো টাওয়ারের ৩য়, ৪র্থ ও ৫ম তলা থেকে একের পর এক বস্তা ফেলা হচ্ছে নিচে। অগ্নিকাণ্ডের পর অবশিষ্ট কাপড়সহ যেসব মালামাল রয়েছে মূলত সেগুলোই বস্তায় করে নিচে ফেলা হচ্ছে। চারদিকে অসংখ্য উৎসুক মানুষের উপস্থিতি। অসংখ্য উৎসুক মানুষের ভিড়িও বিভিন্ন মালামাল চুরি করে নিচ্ছে একটি গ্রুপ। এছাড়াও আগুনে পুড়ে যাওয় টিন, রড ও লোহার গেইট চুরি করে নিচ্ছে। মাঝে মধ্যে সাধারন মানুষ ও পুলিশ চোরকে ধরে মারধর করে ছেড়ে দিতে দেখা গেছে। কথায় আছে ‘কারো পৌষ মাস কারো সর্বনাশ’। এই প্রবাদ বাক্যের বাস্তব চিত্র যেন ফুটে উঠেছে বঙ্গবাজারে। একটি চক্র জিনিসপত্র যে যেভাবে পারছে সেভাবেই নিয়ে যাচ্ছে। কেউ এসে দেখলে মনে করবে এখানে হরিলুট চলছে। ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে থাকা ভুক্তভোগী সালমা বেগম বলেন, দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে যা দেখলাম এ বিষয়ে আর কী বলবো। দেখতেই তো পারছেন অনেকে এসে জিনিসপত্র খুলে নিয়ে যাচ্ছে। কেউ কিছু বলছে না।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বঙ্গবাজারের নিরাপত্তার দায়িত্ব থাকা পুলিশ কর্মকর্তা চকবাজার জোনের সহকারী পুলিশ কমিশানার শাহিনুর যিয়াদ বলেন, মালামাল নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে যাদেরই জিজ্ঞেস করেছি তারাই বলছে এখানে তার দোকানে রয়েছে। এজন্য সেভাবে আমরা কিছু বলতে পারছি না। যাদের মালামাল তারাও নিচ্ছে। এদের ফাঁকে অন্যজনরাও নিচ্ছে। এতোগুলো মানুষের মধ্যে বোঝা মুশকিল প্রকৃত মালিক কে। সব মিলিয়ে মানুষের চিৎকার-চেঁচামেচির চেনা আবহেও অপরিচিত এক বঙ্গবাজার দাঁড়িয়ে আছে ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষত নিয়ে। নতুন কাপড়ের গন্ধের বদলে সেখানে শুধুই পোড়া গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। রাস্তার ওপর পড়ে থাকা সেসব পোড়াস্তূপেই ভালো কাপড় খুঁজে বেড়াচ্ছেন ছিন্নমূল কয়েকশ’ মানুষ। ছিন্নমূলরা দাবি করেছে এসব পোড়া জামাকাপড় কেউ পরবেন, কেউবা বিক্রি করবেন। আবার কেউ ঘরের দরজা জানালার পর্দা তৈরির কাপড় সংগ্রহ করছেন।
বঙ্গবাজার মার্কেটসহ আশপাশের মার্কেটে কুলির কাজ করতেন আক্কাস আলী নামে একজন। তিনি বলেন, এখন ঈদের বাজার, এই সময় এসব মার্কেটে মানুষে গমগম করত। সারা দেশ থেকে বিক্রেতারা পাইকারি মাল নিতে আসত। খুচরা বিক্রিসহ বিদেশি ক্রেতাদের আনাগোনা থাকত এসব মার্কেটে। সব দোকানে কাস্টমারদের ভিড় লেগে থাকত, আমরা তাদের মালামাল এক স্থান থেকে অন্য স্থানে এনে দিতাম। কিন্তু সব থেমে আছে, চারদিক থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। সবার মালামাল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ক্রেতা বিক্রেতার কোনো ব্যস্ততা নেই। আমরাও এখন বেকার, সবার ক্ষতি।
এনেক্সকো টাওয়ারের পাশেই অস্থায়ী চায়ের দোকান ছিল সাহাবুদ্দিন মিয়ার। তিনি বলেন, প্রতিদিন সকাল থেকে মানুষের ভিড়, ব্যস্ততা লেগে থাকত। কিন্তু সব পুড়ে গেছে, কিছুই নেই, নেওয়ার মতো আর কিছু নেই। ক্রেতা-বিক্রেতার কারও ব্যস্ততাও নেই। আগুনে সব শেষ করে দিয়েছে এখানকার সবার। ছাই আর ধোঁয়া ছাড়া আর কিছু নেই, ব্যবসায়ীরা পথে বসে গেছে আজ।
ব্যবসায়ী নূর আলম বঙ্গবাজারে মেয়েদের থ্রিপিস, শাড়িসহ বিভিন্ন ধরনের জামা বিক্রি করতেন। আগুনে তার দুটি দোকানের ৮০ লাখ টাকার সব মালামাল পুড়ে ছাই হয়েছে। সব হারিয়ে পুড়ে যাওয়া দোকানে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদছেন নূর আলম। বন্ধু-বান্ধব, আশপাশের দোকানদার কেউ তার কান্না থামাতে পারছে না। বুধবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় নূর আলমের দোকানের আর কোনো চিহ্ন নেই, পড়ে আছে শুধু ছাই। সেই ছাইয়ের ওপর দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদলেন নূর আলম। ভাই শাওন আলম তাকে থামানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু কিছুতেই শান্ত হচ্ছেন না নূর আলম। নূর আলমের দোকানের নাম ছিল মল্লিকা গার্মেন্টস। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, এই মার্কেটে আমার দুটি দোকান ছিল। এখন একটি দোকানও নেই। নগদ টাকা যা ছিল বস্তায় ভরেছিলাম। সব কিছু পুড়ে ছাই, এখন কিছু নেই। তিনি আরও বলেন, আগুন লাগার পর আমি মাল সরাতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু এক সুতা কাপড় নিতে পারিনি। কারণ কাপড়ের বস্তার নিচে আমার পা পড়ে গিয়েছিল। তিনি বলেন, আমার দুটি সন্তান, বাসায় এক কেজি চাল নেই ঘরে। আমার স্ত্রীকে বলছি, আজকে চলো, কালকে দেখবোনি। নূর আলম জানান, ঈদ ঘিরে স্ত্রীর গহনা, জমি বন্ধক এবং ব্যাংক ঋণ নিয়ে ৬০ লাখ টাকার মালামাল কিনেছিলেন তিনি। সব মিলে দোকানে এক কোটি টাকার মালামাল ছিল। এখন আর কিছু নেই।
তবে ব্যাংক ঋণ পরিশোধে সরকারের কাছে বিনা সুদে ঋণ সহায়তা চেয়েছেন বঙ্গবাজারের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি একই স্থানে পুনরায় ব্যবসা পরিচালনার ব্যবস্থা করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা। গতকাল বুধবার পুড়ে যাওয়া বঙ্গবাজার মার্কেটের সামনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে এ আহ্বান জানান ব্যবসায়ীরা।
পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ব্যবসায়ী দিদার মিয়া বলেন, আমার বাড়ির জমি দেখিয়ে ঈদের আগে ব্যাংক থেকে ১৫ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলাম। অন্যান্য মালের সঙ্গে আগুনে আমার তিনটি দোকানের মালামাল পুড়েছে, আমি এখন নিঃস্ব, পথের ফকির। ব্যাংকের কিস্তি যে দেব তার কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই সরকারে কাছে ব্যাংক ঋণ পরিশোধের জন্য বিনা সুদে ঋণ সহায়তা চাচ্ছি। সেই সঙ্গে একই স্থানে প্রয়োজনে তাঁবু টাঙিয়ে পুনরায় দোকান বসানোর অনুমতি দেওয়া হোক। যাতে করে যেসব ব্যবসায়ীর গুদামে কাপড় আছে তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারেন।
১৯৯৭ সাল থেকে বঙ্গবাজারে ব্যবসা করে আসা জুয়েল হোসেন বলেন, জীবনের সবকিছু দোকানে বিনিয়োগ করেছি। সব পুড়ে ছাই, এখন চলব কীভাবে জানি না। জমি বন্দক রেখে ২৮ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলাম। সেই টাকা দিতে না পারলে জেলে যেতে হবে। তাই সরকারের কাছে অনুরোধ বিনা সুদে ঋণ দেওয়ার জন্য।
ব্যবসায়ী নূর আলম বলেন, বঙ্গবাজার ও ইসলামপুর মার্কেট মিলে আমার চারটি দোকান রয়েছে। এখানে দুটি দোকানে রয়েছে। ঈদকে কেন্দ্র করে ৪৫ লাখ টাকার মালামাল কিনেছি। এর মধ্যে ব্র্যাক ব্যাংক থেকে ১১ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছি। ঘরে চাল নেই, এখন ঋণের এক টাকা দেওয়ার মতো অবস্থা নেই। সরকারে সহায়তা ছাড়া এখন আমাকে জেলে যেতে হবে।
রাফা গার্মেন্টসের মালিক ফারুক দিদার বলেন, আমার দোকানে ১০ লাখ টাকার বেশি মালামাল ছিল। ক্যাশে ছিল নগদ ১ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। সব পুড়ে ছাই হয়েছে। ব্যবসায়ীদের বাঁচাতে সরকারকে এগিয়ে আসার বিকল্প কোনো পথ নেই।
ব্যবসায়ী কালাম মিয়া বুঝে উঠতে পারছেন না এখন তিনি কি করবেন। বঙ্গবাজারে ১০ বছরের বেশি সময় ধরে ব্যবসা করে আসছিলেন মধ্যবয়সী এই ব্যবসায়ী। ভয়াবহ আগুনে পুড়ে যাওয়া বঙ্গবাজারের সামনে কথা হচ্ছিল তার সঙ্গে। প্রায় বাকরুদ্ধ কালাম মিয়া বলেন, ‘রাতে রেখেছিলাম লাখ টাকার বান্ডিল। আগুনে পোড়ার পর পেলাম শুধু ছাই। এমন হবে ভাবতে পারিনি। আমার সবই শেষ হয়ে গেছে এটাও ভাবতে পারছি না।’
ফায়ার সার্ভিসের কর্মী আসিফ খান জানিয়েছেন, আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে বঙ্গবাজারের কয়েক হাজার ব্যবসায়ির দোকান ও প্রতিষ্ঠান। অগ্নিকাণ্ডের দুইদিন পরও ধুঁকেধুঁকে জ্বলছে আগুন, উঠছে ধোঁয়া। এরমধ্যে দুটি ভবন পুড়ে কঙ্কাল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই ভবনগুলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। আগুনে পুড়ে যাওয়ায় দেয়ালগুলোতেও ফাটল ধরেছে। যেকোনো মুহূর্তে দেয়াল ধসে পড়তে পারে। ভবন দুটি ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের বিপরীত দিকে অবস্থিত। এই ভবনগুলোতে মার্কেটের জেনারেটর ছিল।
তিনি আরও জানান, আগুনে সবচেয়ে বেশি পুড়েছে ভবনগুলো। এখন তো আর আগের মতো শক্তিশালী নয়। দেয়াল ফাটল ধরেছে, স্বাভাবিকভাবেই ঝুঁকিপূর্ণ। পিলারগুলো দাঁড়িয়ে থাকলেও দেয়াল ধসে পড়তে পারে, তাই ঝুঁকিপূর্ণ।
ফায়ার সার্ভিসের আরেক কর্মী মুবিন বলেন, আগুনে পুড়ে যাওয়া ভবনটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তাই ভেঙে পড়ার আশঙ্কা আছে। আগুনে পুড়ে ভবনটির দেয়ালে ফাটল ধরেছে দেখা যায় স্পষ্টভাবে। এ বিষয়ে সতর্ক থাকা ভালো। আগুনে পুরো যাওয়া ভবনের বিষয়ে একটু পরপরই পুলিশ মাইকিং করে সাধারণ মানুষকে সতর্ক করছে, যাতে ভবনের আশপাশ দিয়ে কেউ চলাচল না করে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, বঙ্গবাজারের আগুনে ব্যবসায়ীদের দুই হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। সরকারের কাছে আমরা সহায়তা চেয়েছি। সরকার আমাদের আশ্বাস দিয়েছে। আশা করছি, ক্ষতিপূরণ পাব।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি ও নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেল বলেন, অতীতের অগ্নিকাণ্ডের যথার্থ কারণ অনুসন্ধান করে প্রতিকারের ব্যবস্থা না নেওয়ার ফলে বিভিন্ন কারখানা, বাজার কিংবা ভবনে অগ্নিকাণ্ড একটা নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তারা বলেছেন, বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ড কাদের অবহেলা ও অব্যবস্থাপনার কারণে এ ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে তা চিহ্নিত করে দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। অবিলম্বে ক্ষতিগ্রস্তদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।

 

 

Related Articles

Back to top button