টাইমস ২৪ ডটনেট, আন্তর্জাতিক ডেস্ক: দখল আর পুনরুদ্ধারের লড়াই চলছে পূর্ব ইউরোপের দেশ ইউক্রেনে। হামলা চালিয়ে সাজানো-গোছানো দেশটিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার পাশাপাশি বিশাল একটি অংশ নিজেদের কব্জায় নিয়েছে রাশিয়া। অবশ্য পশ্চিমা সহযোগিতায় ইউক্রেনীয় বাহিনীর পাল্টা প্রতিরোধে রুশ সেনারা রণাঙ্গনে সুবিধা করতে না পারায় দখলকৃত ভূমির অনেকটাই এখন হাতছাড়া। যুদ্ধ নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ওয়ার ম্যাপারের তথ্য অনুযায়ী, হামলা শুরুর পর এক মাসের মাথায় ইউক্রেনের প্রায় ২৪ শতাংশের বেশি ভূমি দখলে নেয় মস্কো। পরে অবশ্য বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পিছু হটে রুশ বাহিনী। সে হিসাবে ২০২২ সাল শেষে মস্কোর দখলে থাকা অঞ্চলের পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ১৬.৫৫ শতাংশে। যার পরিমাণ ৯৯ হাজার ৮৮০ বর্গকিলোমিটার, যা উত্তর কোরিয়ার সমান। এই এক বছরের যুদ্ধে ইউক্রেন হারিয়েছে বিস্তীর্ণ কৃষিজমিও; যা ইউক্রেনকে সংকটে ফেলার পাশাপাশি খাদ্যপণ্যের দামে বিশ্বকেও করে তুলেছে অস্থিতিশীল।
ওয়ার ম্যাপারের তথ্য বলছে, যুদ্ধ শুরুর আগেই ইউক্রেনের মোট ভূখণ্ডের ৬.৪৫ শতাংশ ভূমি দখলে ছিল রাশিয়ার। আর গত ফেব্রুয়ারির পর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত নতুন করে ১০.১ শতাংশ জমি নিয়ন্ত্রণে নেয় রুশ বাহিনী। অন্যদিকে, ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে দেশটির ৮৩.৪৫ শতাংশ ভূমি। যার পরিমাণ প্রায় ৫ লাখ ৩ হাজার ৬৬০ বর্গকিলোমিটার।
রাশিয়ার পর ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র ইউক্রেন। এর আয়তন ৬ লাখ ৩ হাজার ৬২৮ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে ২৭ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের ক্রিমিয়া অঞ্চল ২০১৪ সালে দখল করে নেয় রাশিয়া। চারদিকে সমুদ্রবেষ্টিত দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় গুরুত্বপূর্ণ ওই দ্বীপ দখল করে নিয়েও ক্ষান্ত হয়নি মস্কো। ইউক্রেনের উত্তর ও পূর্বের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল দোনবাস, খেরসন, খারকিভ অঞ্চলও দখলে নেওয়ার ফন্দি আঁটতে থাকেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভদ্মাদিমির পুতিন। সর্বশেষ গত বছরের এই দিনে বিশেষ সামরিক অভিযানের নামে আগ্রাসন শুরুর ৭ মাসের মাথায় গত বছরের সেপ্টেম্বরে আরও চারটি এলাকা নিজেদের বলে ঘোষণা দেন পুতিন। এর আগে বিতর্কিত গণভোট মঞ্চস্থ করা হয় পূর্বের লুহানস্ক ও দোনেৎস্কে এবং দক্ষিণের জাপোরিঝিয়া ও খেরসনে। এসব অঞ্চল রুশপন্থি শাসকদের দ্বারা আগে থেকেই পরিচালিত ছিল। তবে, নিজেদের অংশ বলে রাষ্ট্রীয়ভাবে রাশিয়ার এই স্বীকৃতি অবৈধ বলে আসছে ইউক্রেন ও পশ্চিমা মিত্ররা। পর্যবেক্ষকদের মতে, হামলার প্রথম দিকে বিস্তীর্ণ ভূমির নিয়ন্ত্রণ হারালেও গত বছরের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে এসে জোরালো প্রতিরোধে অনেকটাই পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয় কিয়েভ। প্রথম পাঁচ দিনে বড় দখল: হামলার প্রথম পাঁচ দিনেই রাশিয়া ও এর সশস্ত্র মিত্ররা ইউক্রেনের প্রায় ১ লাখ ১৯ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ন্ত্রণ নেয়। মার্কিন গবেষণা গ্রুপ ও থিঙ্কট্যাঙ্ক দ্য ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ারের (আইএসডব্লিউ) তথ্য অনুসারে, রুশ আক্রমণ ছিল উত্তর, দক্ষিণ এবং পূর্ব দিক থেকে। এক পরিকল্পনাতেই হাতছাড়া ৪০ শতাংশ এলাকা: এক মাস পর পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনে রুশ বাহিনী। গত বছরের ৮ এপ্রিলের মধ্যে রাশিয়ান কর্তৃপক্ষ উত্তরাঞ্চল থেকে সেনা প্রত্যাহার করে পূর্বাঞ্চল দখলের দিকে জোর দেয়। তাদের এই প্রত্যাহার মোট দখলের ৪০ শতাংশই হাতছাড়া হয়। এর পর আগস্ট পর্যন্ত চার মাস কোনো অঞ্চলেই সুবিধা করতে পারেনি রুশ বাহিনী। আইএসডব্লিউর তথ্যমতে, মে এবং আগস্টের মধ্যে রাশিয়ার এলাকা দখলের পরিমাণ ছিল খুবই কম। তবে, মে মাসের মাঝামাঝি এসে ইউক্রেনের সবচেয়ে বড় কৌশলগত ক্ষতি ছিল মারিউপোল শহর হাতছাড়া হয়ে যাওয়া।
রুশ বাহিনীর পিছু হটা: সেপ্টেম্বরের শুরুতে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে হঠাৎ পাল্টা আক্রমণ জোরদার করে ইউক্রেনীয় বাহিনী। ১১ সেপ্টেম্বর ইউক্রেনের সেনারা এক রাতেই ৪ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়। এটিই ছিল এক দিনে রুশ বাহিনীকে হটানোর সবচেয়ে বড় আঘাত। এ ছাড়া দক্ষিণে জাপোরিঝিয়া এবং খেরসনে ইউক্রেনীয় সেনারা আরও অগ্রসর হয়। সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত রুশ বাহিনী ৯ হাজার বর্গকিলোমিটারের বেশি এলাকা থেকে পিছু হটে। এর পর নভেম্বরে আরও প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে ইউক্রেন। এতে পরিকল্পনা বদলাতে বাধ্য হয় মস্কো। গত বছরের ৯ নভেম্বর হঠাৎ রুশ সেনাদের খেরসন ছেড়ে ডিনিপোর নদীর বিপরীত পাশে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু। এ বিজয়ে সেখানে পতাকা উড়িয়ে উল্লাসে ফেটে পড়েন ইউক্রেনীয়রা। যে চার অঞ্চল নিজেদের বলে ঘোষণা করেছিল মস্কো, খেরসন সেগুলোর একটি।
কৃষিজমি হাতছাড়া: আবাদযোগ্য মোট কৃষিজমির প্রায় চার ভাগের এক ভাগই হারিয়েছে ইউক্রেন। গত বছরের মাঝামাঝি দেশটির উপকৃষিমন্ত্রী ট্যারাস ভিসোটস্কি জানিয়েছিলেন, রুশ হামলা শুরুর পর থেকে ১৩ জুন পর্যন্ত প্রায় ২৫ শতাংশ কৃষিজমি কমে গেছে। তিনি আরও বলেন, যুদ্ধের কারণে বিপুল সংখ্যক মানুষ দেশ ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ায় আপাতত খাদ্যের ঘাটতি না হলেও রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হবে। শস্য, উদ্ভিজ্জ তেল ছাড়াও অন্যান্য কৃষিপণ্য রপ্তানিতে বিশ্বের অন্যতম প্রধান দেশ ইউক্রেন। খবর ওয়ার ম্যাপার, সিএনএন এবং উইকিপিডিয়ার।