টাইমস ২৪ ডটনেট, ঢাকা: বাংলা ভাষার প্রতি আকুল ভালোবাসা জানান দিতে এবার বিপুল সংখ্যায় ভারতীয় বাঙালিরা বাংলাদেশে এসেছেন। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ি অন্তত ৪০ জন ভারতীয় বাংলাদেশে এসেছেন। ঢাকায় শহীদ মিনারে গিয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। গতকাল মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের শহীদ বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান তারা। ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানানোর জন্যই বছরজুড়ে পরিকল্পনা করেছেন বলে জানান তারা। তাদের মধ্যে ৩২ জন জানান, তারা ১২ দিন আগে বাংলাদেশে আসেন। কুমিল্লা ও ঢাকার দর্শনীয় স্থান ও মন্দির ঘুরে দেখেন। এ সময় বাংলাদেশিদের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়েছেন বলেও জানান তারা।
গত মধ্যরাত ১২টা এক মিনিটে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। অমর একুশের ঐতিহাসিক অমর গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি… আমি কি ভুলিতে পারি’ গানটি বাজানোর সময় রাষ্ট্রপতি হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধীরালয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বেদির দিকে এগিয়ে যান।
এদিকে দূষণমুক্ত পরিবেশ গড়তে ও ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বাইসাইকেল চালিয়ে হুগলী থেকে বাংলাদেশ এসেছেন আট তরুণ-তরুণী। শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে রানাঘাট থেকে এসেছেন কবি শ্যামল কুমার মজুমদার, সাংবাদিক পুলক বোস, পাপিয়া চক্রবরতী, রাজু শেখ। হুগলী জেলা থেকে পর্যটক দলটি বৃহস্পতিবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) রাতে পাবনা শহরে পৌঁছায়। তারা সাইকেল চালিয়ে ১৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পৌঁছান। এরপর ভাষা শহীদদের প্রতি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানান।
পর্যটক দলের একমাত্র নারী সদস্য মহুয়া ব্যানার্জি বলেন, শুধু মুখের ভাষা আর সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনই নয়, এপার বাংলা ও ওপার বাংলায় রয়েছে আমাদের পরস্পরের আত্মীয়তা। আত্মার এ সম্পর্ক থেকেই বাংলাদেশের মানুষের মতো বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ২১ ফেব্রুয়ারির মহান ভাষা আন্দোলন নিয়ে আমরাও গর্বিত। বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা ও দূষণমুক্ত পরিবেশের জন্য সাইকেল চালিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশ ভ্রমণে এসেছেন বলে জানান মহুয়া।বাংলাদেশ ভ্রমণে পর্যটক দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন শৈবাল ব্যানার্জি। মহুয়া ব্যানার্জি তার স্ত্রী। তারা জানান, বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে (১৪ ফেব্রুয়ারি) হুগলীর চন্দননগর থেকে যাত্রা শুরু করেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি রানাঘাট হয়ে দর্শনা-আলমডাঙ্গা দিয়ে কুষ্টিয়া প্রবেশ করেন। ১৬ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ার কুমারখালী হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ি দর্শন করে শিলাইদহ ঘাট হয়ে নদীপথে পাবনা শহরে প্রবেশ করেন।তারা পাবনা শহরের দর্শনীয় স্থান, সুচিত্রা সেনের বাড়ি, পাবনা মানসিক হাসপাতাল, অবতার ঠাকুর অনুকুল চন্দ্রের জন্মস্থান, তাড়াশ ভবন পরিদর্শন শেষে কাজীরহাট ফেরিঘাট দিয়ে ঢাকায় পৌঁছান।
ভাষা আন্দোলনে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করার জন্য ভারত থেকে পায়ে হেঁটে বাংলাদেশে এসেছেন মৃণাল দাস (৫৫)। বায়ো সাইন্সে লেখাপড়া করা এ ‘চিরকুমার’ পায়ে হেঁটে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরেই ঢাকায় শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। মৃণাল দাস জানান, তিনি গত ৭ ফেব্রুয়ারি কলকাতার লেক গার্ডেন থেকে রওনা হয়ে পায়ে হেঁটে সাতক্ষীরার ভোমরা স্থল বন্দর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। সেখান থেকে হেঁটে বাংলা ভাষার অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রথম প্রবর্তক মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মভূমি যশোরের কেশবপুরে সাগরদাঁড়িতে যান। সেখানে কবির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে মহাকবির স্মৃতি বিজড়িত কপোতাক্ষ নদ পারের বিদায় ঘাট, বুড়ো কাঠবাদাম গাছ তলা, জমিদার বাড়ির আম্রকাননসহ মধুপল্লী ঘুরে দেখেন। তিনি জানান, ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে ভারত থেকে পায়ে হেঁটে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন। তিনি একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আগরতলায় গিয়ে পদযাত্রা শেষ করবেন।
অপরদিকে, আধিপত্য বিস্তারের জের ধরে শহিদ মিনারে ফুল দেওয়া নিয়ে বাংলাদেশে নানাস্থানে সংঘর্ষ ঘটেছে। ঢাকার অদূরে মানিকগঞ্জে ভাষা শহীদের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য শহীদ মিনারে ফুল দেওয়াকে কেন্দ্র করে শাসকদলেন যুবলিগ, স্বেচ্ছাসেবক লিগ ও শ্রমিক লিগের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটেছে। এ সময় ৬ জন আহত হয়েছেন। মঙ্গলবার জেলার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এই কাণ্ড ঘটে। পরে জেলা আওয়ামি লিগের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ ও পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। নেতাকর্মীদের আধা ঘন্টা পাল্টাপল্টি ধাওয়ার ঘটনায় শহীদ মিনারে ফুল দিতে আসা সামাজিক, স্বাংস্কৃতিকসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও প্রতিষ্ঠান প্রধানদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পরে অনেকেই ফুল না দিয়ে চলে যান।পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার সকাল ৯টার দিকে জেলা আওয়ামি লিগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ শহীদ মিনারে ফুল দিতে আসেন। আওয়ামী লীগের পক্ষে ফুল দেওয়ার পর শ্রমিক লিগের এক পক্ষের নাম ঘোষণা করলে অন্যপক্ষ বাধা দিলে হট্টগোল শুরু হয়। একপর্যায়ে উভয় পক্ষের নেতাকর্মীদের মধ্যে কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে সংঘর্ষ বাঁধে।
এদিকে দেশের পশ্চিম জনপদ জেলা ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে মহান শহীদ দিবসে ফুল দেওয়াকে কেন্দ্র করে বিএনপি ও ছাত্রলিগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ঘটে। মঙ্গলবার জেলার সরকারি মাহতাব উদ্দিন কলেজের পেছনে এ ঘটনা ঘটে।এ সময় ছাত্রলিগ কর্মী ইরফান রেজা রুকু ও ইউনিয়ন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আল আমিনসহ ৬ জন আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে ছাত্রলিগ কর্মী ইরফান রেজা রুকুকে যশোর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভতি করা হয়েছে।
কালীগঞ্জ উপজেলা ও পৌর বিএনপির পক্ষ থেকে শহরের সরকারি মাহতাব উদ্দিন কলেজের শহীদ মিনারে ফুল দিতে যায়। এ সময় তারা শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে কলেজের পেছন গেট দিয়ে শ্লোগান দিতে দিতে বেরিয়ে যান। সে সময় কলেজে ছাত্রলিগের নেতাকর্মীরাও শ্লোগান দিতে থাকে। পরে বিএনপির নেতাকর্মীরা কলেজের পেছনের সড়কে চলে গেলে তাদের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে ছাত্রলিগের নেতাকর্মীরা। পরে বিএনপির নেতাকর্মীরাও ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। একপর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে শুরু হয় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া। এ সময় একটি ককটেল বিস্ফোরণের শব্দও শোনা যায়। এ ঘটনার পর পুরো শহরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পরে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এরপর শহরে মহড়া দেয় ছাত্রলিগ ও যুবলিগের নেতাকর্মীরা। কালিগঞ্জ থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুর রহিম মোল্ল্যা জানান, ঘটনা জানার পর পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এ ঘটনায় উভয় পক্ষের ৬ জন আহত হয়েছেন।