টাইমস ২৪ ডটনেট: তুরস্ক ও সিরিয়ায় গত সোমবার ভোরে স্মরণকালের ভয়াবহ ভূমিকম্পের মঙ্গলবার আবারও তুরস্কের মধ্যাঞ্চলে ৫ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। এতে শত শত বাড়িঘর ধসে পড়েছে। ধসে পড়া বাড়িঘরের ধ্বংস্তুপের নিচে আটকা পড়া মানুষ বাঁচতে আহাজারি করছে। কেউ ডাক চিৎকার ও চেঁচামেচি করতে দেখা গেছে। ভূমিকম্পের বিস্তৃতি এবং ধ্বংস এতই বিশাল যে, উদ্ধারকারীরা সব জায়গায় পৌঁছাতে পারছেন না। এছাড়া তুষারপাত, বৃষ্টি এবং অতিরিক্ত ঠাণ্ডার কারণে ব্যহত হচ্ছে উদ্ধার কাজ। তুরস্কের দক্ষিণ দিকের হাতেই প্রদেশে কোনো উদ্ধার কাজ করা যায়নি। মঙ্গলবার এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তুরস্ক ও সিরিয়ায় ৫ হাজার ২১ জন মারা গেছেন।
জানা গেছে, তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর মঙ্গলবার আবারও তুরস্কের মধ্যাঞ্চলে ৫ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ (ইউএসজিএস) জানিয়েছে, গোলবাসি শহরের কাছে ভূ-কম্পনটির গভীরতা ছিল ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। ফ্রান্স-ভিত্তিক ইউরোপীয়-ভূমধ্যসাগরীয় সিসমোলজিক্যাল সেন্টার (ইএমএসসি) জানায়, গোলবাসির কাছে ৫ দশমিক ৬ মাত্রার ভূ-কম্পন হয়। এর গভীরতা ছিল ২ কিলোমিটার পর্যন্ত। উভয় সংস্থা জানিয়েছে এ দফায় ভূমিকম্প হয় মঙ্গলবার স্থানীয় সময় ৩টা ১৩ মিনিটে। তবে গত সোমবারও দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্কে কয়েক দফা আফটারশক হয়েছে।
এদিকে, গত সোমবার ভোরের দিকে যখন মানুষজন ঘুমিয়ে ছিলেন ঠিক তখনই আঘাত হানে ভয়াবহ ভূমিকম্পে। ধসে পড়েছে ২ হাজারের মতো ভবন। এখনও ধ্বংসস্তূপে আটকা বহু মানুষ। হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পে ধসে যাওয়া ভবনগুলো থেকে উদ্ধার করা হচ্ছে আটকা পড়া মানুষদের। বৈরি আবহাওয়ার মধ্যে উদ্ধারকারী দল সোমবার রাতভর অভিযান চালিয়েছে। এখনও চলছে উদ্ধার কাজ।
হাতেই প্রদেশের দানিজ নামের এক পুরুষ বাসিন্দা জানিয়েছেন, সেখানে বহু মানুষ ধ্বংস্তুপের নিচের আটকে পড়ে আছে। তারা সাহায্যের জন্য চিৎকার চেঁচামেচি করছেন। কিন্তু উদ্ধারকারীর না আসায় তারা কিছুই করতে পারছেন না। বৃষ্টির মধ্যে চোখ ভেজা কান্নারত দানিজ বলেছেন, তারা (ধ্বংসস্তুপের নিচে আটকে পড়া মানুষ) চিৎকার করছে। কিন্তু কেউ আসছে না। আমরা হতাশ, তারা আল্লাহ নাম ধরে ডাকছে, তারা চিৎকার করছে। তারা বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছে। কিন্তু আমরা তাদের বাঁচাতে পারছি না। সেখানে কেউ উদ্ধার করতে যাচ্ছে না।
১৯৩৯ সালের পর তুরস্ক এমন ভয়াবহ ভূকম্প দেখেনি। ভূমিকম্পের ফলে প্রচুর ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে তুরস্ক ও সিরিয়া। উদ্ধার হচ্ছে একের পর এক মৃতদেহ। কোনো কোনো পরিবারে সব সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। শোক পালন করার মতো আত্মীয়-পরিজন নেই অনেকের। আহত হয়েছেন আরও বহু মানুষ। অনেকে এখনো নিখোঁজ রয়েছেন।। ভূকম্পের পরে বিপর্যয় মোকাবিলা সংস্থার কর্মী এবং দমকলকর্মীরা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পৌঁছান। বিপর্যয়ের মুহূর্তের বেশ কিছু ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে ফেসবুক ও টুইটারে। এসব ভিডিওতে দেখা গেছে, তীব্র কম্পনের ফলে বাড়িঘর ভেঙে পড়ছে। প্রাণ বাঁচানোর আশায় স্থানীয়দের ছোটাছুটি করতেও দেখা যাচ্ছে। দমকলকর্মীরা উদ্ধারকাজ চালাচ্ছেন। তবে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার বাসিন্দাদের বেশিরভাগেরই মোবাইল বন্ধ। কারও মোবাইলে কল বাজলেও ধরছে না। তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে তা জানাও সম্ভব হচ্ছে না। তুরস্কের সানলিউরফা শহরের উত্তরের একটি সড়কে সারি সারি গাড়ি। এসব গাড়িতে করে আতঙ্কগ্রস্ত বাসিন্দাদের ধীরে ধীরে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। সড়কের অন্য পাশে প্রচণ্ড ঠান্ডায় বৃষ্টির মধ্যে অসহায় মানুষ মালামাল নিয়ে নিরাপদের জন্য আশ্রয় খুঁজছেন। ভূমিকম্পের পর নিরাপত্তার কথা ভেবে সবাইকে সড়কে অবস্থানের নির্দেশ দিয়েছে তুরস্ক সরকার। সে প্রসঙ্গ টেনে স্থানীয় বাসিন্দা কোয়ুনচু বলেন, আমরা বাড়ি ফিরতে পারছি না, তাই এখানে অপেক্ষা করছি। এ মুহূর্তে বাড়ি ফেরা নিষেধ। তিনি বলেন, প্রত্যেকেই আতঙ্কে আছে।
তুরস্কের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংস্থার কর্মকর্তা ওরহান তাতার জানিয়েছেন, অনুসন্ধান ও উদ্ধারকাজে ২৩ হাজার ৪০০ কর্মী যোগ দিয়েছেন। ১০টি প্রদেশে ৭ হাজার ৮০০ জনেরও বেশি মানুষকে উদ্ধার করা হয়েছে। আর ৫ হাজার ৭৭৫টি ভবন ধসে যাওয়ার খবর নিশ্চিত হয়েছে।
তুরস্ক-সিরিয়ায় সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্পে ধসে পড়া ভবনের নিচ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে এক ফুটফুটে নবজাতককে। ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে মারা গেছেন শিশুটির মা। সিরিয়ার আলেপ্পো শহরে হৃদয়স্পর্শী এ ঘটনা ঘটেছে। গতকাল মঙ্গলবার কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার ফেসবুক পেজে নবজাতকটি উদ্ধারের ভিডিওটি প্রকাশ করা হয়। সেখানে দেখা যায়, এক উদ্ধারকারী শিশুটিকে হাতে নিয়ে দৌড়াচ্ছেন। নবজাতকটিকে ঢাকতে অপর এক উদ্ধারকারী একটি চাদর ছুড়ে দেন। তবে শিশুটি বেঁচে রয়েছে কি না তা জানা যায়নি।
সর্বশেষ তথ্য মতে, তুরস্ক ও সিরিয়ায় দফায় দফায় ভূমিকম্পে ৫ হাজার ২১ জন মারা গেছেন। তুরস্কে ৩ হাজার ৪১৯ জন আর সিরিয়ায় এক হাজার ৬০২ জন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন ১৮ হাজারের বেশি মানুষ। বাশার আল আসাদ নিয়ন্ত্রিত এলাকায় কমপক্ষে ৮১২ জন নিহত হয়েছেন। আলেপ্পো, লাতাকিয়া, হামা, ইদলিব ও তার্তুস প্রদেশে এক হাজার ৪৪৯ জন আহত হয়েছেন। সিরিয়ার বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে কর্মরতরা ৭৯০ জনের মৃত্যুর সংবাদ দিয়েছে। তবে, মৃত্যুর সংখ্যা আরও অনেক বাড়বে বলে জানা গেছে। তুরস্কের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফুয়াত উকতাই বলেছেন, দুই দিনে তাদের দেশে মোট ৩ হাজার ৪১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। যারা এখনো ধ্বংসস্তুূপের নিচে আটকে আছেন, কিন্ত বেঁচে আছেন তাদের যদি উদ্ধার না করা যায় তাহলে মৃতের সংখ্যা ১০ হাজার পেরিয়ে যেতে পারে।
তুরস্কের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফুয়াত ওকতাই বলেছেন, তুরস্কের ১০টি প্রদেশে ১৪ হাজার ৪৮২ জন আহত হয়েছেন এবং ৭ হাজার ৮৪০ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। প্রায় ৩ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডরমেটরি ও অন্যান্য স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। সিরিয়ায় সর্বশেষ এক হাজার ৪৪৪ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে। দুই দেশ মিলিয়ে মৃতের সংখ্যা ৪ হাজার ৩৬৫ জনে পৌঁছেছে।
এদিকে, ভূমিকম্পে ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ায় তীব্র ঠান্ডার মধ্যে বহু মানুষকে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাতে হচ্ছে। স্থানীয়দের বরাতে বলছে, তারা ভূমিকম্পের পর সাহায্য করার জন্য স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে যাওয়ার জন্য জড়ো হয়েছেন। অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত ১০ প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে যেতে চেয়েছেন। সেখানার উদ্ধার কাজে সহযোগিতার জন্য তারা ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরে ভিড় করছেন।
তুরস্কের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুলেমান সয়োলু জানিয়েছেন, বিপর্যয় মোকাবিলা সংস্থা তাদের সাধ্যমতো চেষ্টা চালাচ্ছে। তবু আন্তর্জাতিক সাহায্যের জন্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এগিয়ে আসবে বলে অনুমান করা যায়। তাদের এমার্জেন্সি রেসপন্স কোঅর্ডিনেশন সেন্টার (ইআরসিসি)-এর কাছে সাহায্য চেয়েছেন সুলেমান।
জানা গেছে, গত সোমবারের ভয়াবহ ভূমিকম্পের সুযোগ নিয়ে সিরিয়ায় জেল থেকে পালিয়েছে অন্তত ২০ কয়েদি। তারা সবাই আইএস জঙ্গি বলে ধারণা করা হচ্ছে। বার্তা সংস্থা এএফপি’র বরাতে গত মঙ্গলবার এ তথ্য জানিয়েছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা।
এদিকে, তুরস্কে ভূমিকম্পে দেশটির আজাজ শহরে নিখোঁজ দুই বাংলাদেশির মধ্যে একজনকে উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার হওয়া নুর আলম নামের ওই বাংলাদেশি সুস্থ আছেন এবং বর্তমানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ইস্তাম্বুলে বাংলাদেশ কনসাল জেনারেল মোহাম্মদ নুরে আলম এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি জানান, তুরস্কে ভূমিকম্পে নিখোঁজ দুই বাংলাদেশির মধ্যে নুর আলম নামের এক বাংলাদেশিকে উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু মো. রিংকু নামের এক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। তারা দু’জন তুরস্কের আজাজ শহরে বসবাস করছিলেন। নিখোঁজ বাংলাদেশি রিংকুর বাড়ি বগুড়ায়। তবে তুরস্কে ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর উদ্ধার কাজের জন্য একটি দল পাঠাচ্ছে বাংলাদেশ। ১০ সদস্যের এই উদ্ধারকারী দলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের পাঁচজন করে সদস্য থাকবেন। একইসঙ্গে জরুরি চিকিৎসা সেবা দিতে আরেকটি মেডিক্যাল টিম যাচ্ছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ও জনকূটনীতি অনুবিভাগের মহাপরিচালক সেহেলী সাবরীন গতকাল মঙ্গলবার এ তথ্য জানান।
ঢাকায় নিযুক্ত তুরস্কের রাষ্ট্রদূত মোস্তফা ওসমান তুরানও এক বার্তায় জানান, বাংলাদেশ সরকার তুরস্ককে এই দুর্যোগে সহায়তা দিতে চেয়েছে। তারা আজ বুধবার উদ্ধারকারী দল পাঠাতে পারে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তুরস্কের প্রেসিডেন্টের কাছে শোকবার্তা পাঠিয়েছেন।
অপরদিকে, তুরস্ক থেকে উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ায় জাতিসংঘের সহায়তা সরবরাহ সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা, ত্রুটিপূর্ণ আবহাওয়া ও লজিস্টিক সমস্যার কারণে সহায়তা সরবরাহ বন্ধ রাখতে হয়েছে বলে জানান জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সমন্বয় কার্যালয়ের (ওসিএইচএ) মুখপাত্র মাদেভি সান-সুওনা। গতকাল মঙ্গলবার ওসিএইচএ মুখপাত্র বলেন, সীমান্তবর্তী বেশ কয়েকটি সড়কের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। তাছাড়া কিছু এলাকা বেশ দুর্গম। সবকিছু মিলিয়ে কিছু লজিস্টিক সমস্যা দেখা দেওয়ায় আপাতত সহায়তা সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। কখন থেকে পুনরায় শুরু করতে পারবো তাও স্পষ্ট করে বলতে পারছি না।
এদিকে তুরস্ক-সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পে নিহতদের স্মরণে আল-আকসা মসজিদে গায়েবানা জানাজা আদায় করেছেন ফিলিস্তিনিরা। গত সোমবার ইসলাম ধর্মের তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদটিতে নামাজ পড়েছেন কয়েকশ মুসল্লি।এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে ইসরায়েলিদের অবৈধ দখলে থাকা পূর্ব জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদে ফিলিস্তিনিদের গায়েবানা জানাজা পড়ার ভিডিও। এতে দেখা যায়, বহু মুসল্লি একসঙ্গে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করছেন।
এছাড়াও ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত তুরস্কের ১০ শহরে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট রিপেস তাইয়্যেপ এরদোয়ান শহরগুলোতে আগামী তিন মাসের জন্য এ ঘোষণা দিয়েছেন। এরদোয়ান বলেন, ভূমিকম্পে তুরস্কে এখন পর্যন্ত ৩ হাজার ৫৪৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। ধ্বংসস্তূপ এলাকা বিবেচনায় ১০টি শহরে এ সময়ের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে।
তুরস্ক ও সিরিয়ায় ১০ হাজার মোবাইল ঘর পাঠানোর কথা জানিয়েছে কাতার। এছাড়া ১২০ জনের উদ্ধারকারী দল, ফিল্ড হাসপাতাল তৈরির সরঞ্জাম ও মানবিক সাহায্য পাঠানোর কথা জানিয়েছে তারা।