topআন্তর্জাতিক

অর্থ সংকট : এগোনোর সব পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে পাকিস্তানের

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: জাতীয় মুদ্রা রুপির মান প্রতিনিয়ত পড়তে থাকা, অসহনীয় মূল্যস্ফীতি, দেশজুড়ে জ্বালানি ও বিদ্যুতের ঘাটতির জেরে চরম সংকটের ঘূর্ণিপাকে পড়েছে পাকিস্তান। অর্থনীতিবিদদের ভাষ্য, পুরোপুরি দেউলিয়া হয়ে যাওয়া থেকে বর্তমানে মাত্র কয়েক কদম পেছনে রয়েছে দেশটি। বর্তমানে যে অবস্থা চলছে, তাতে কোনো মিত্র দেশও আর পাকিস্তানকে ‍ঋণসহায়তা দিতে ভরসা পাচ্ছে না। ফলে, এখন দেশটির সমানে একটিই উপায় আছে; আর তা হলো আইএমএফের ঋণ। দেশের টালমাটাল অর্থনীতিকে স্থিতাবস্থায় আনতে ঋণের জন্য গত বছর থেকে আইএমএফে তদবির শুরু করেছে প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের নেতৃত্বাধীন জোট সরকার। কিন্তু আইএমএফ কিছু শর্ত প্রদান ব্যতীত এখনও ঋণ প্রদানের ব্যাপারে ইতিবাচক বা নেতিবাচক কোনো সাড়া দেয়নি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সময় থেকেই আইএমএফের ঋণের জন্য তদবির শুরু করেছিল পাকিস্তান। আইএমএফ তাতে সম্মত হয়েছিল এবং ঋণের কয়েক কিস্তি গ্রহণও করেছিল তৎকালীন সরকার। আইএমএফের বিভিন্ন শর্তের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল জ্বালানি খাতে ভর্তুকি প্রত্যাহার করা কিন্তু ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন পিটিআই সরকার শর্তটি মানতে রাজি না হওয়ায় ঋণের কিস্তি স্থগিত করেছিল আইএমএফ। বর্তমান শেহবাজ শরিফের নেতৃত্বাধীন সরকারের সামনেও একই শর্ত রেখেছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই ঋণদাতা সংস্থা। শেহবাজ শরিফও এই শর্ত মানতে প্রস্তুত ছিলেন না এবং তার প্রধান কারণ— সামনের অক্টোবরে পার্লমেন্ট নির্বাচন হবে পাকিস্তানে; কিন্তু এই মুহূর্তে দেশটিতে স্থিতিশীলতা আনতে হলে এই শর্ত মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই তার সামনে। বিশ্বের বৃহত্তম ঋণদাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা ও পাকিস্তানের অন্যতম শীর্ষ অর্থনীতিবিদ আবিদ হাসান এএফপিকে বলেন, ‘আমরা একদম সড়কের শেষ মাথায় এসে পৌঁছেছি। (আইএমএফের ‍ঋণ ব্যতীত) সামনে আর কোনো পথ নেই। এ কারণে আইএমএফ এখন যা শর্ত দেয়, তা মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই সরকারের সমানে।’ ‘যদি সরকার (শর্ত) না মানে, সেক্ষেত্রে দেশ আর দু-এক মাসের মধ্যে নিশ্চিতভাবেই দেউলিয়া হয়ে যাবে এবং তখন পাকিস্তানের অবস্থা হবে শ্রীলঙ্কার মতো, কিংবা তার চেয়েও খারাপ।’
একটি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা কতখানি খারাপ হতে পারে— সাম্প্রতিক সময়ে তার সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত শ্রীলঙ্কা। শাসকগোষ্ঠীর অদক্ষতা-অব্যবস্থাপনা, অপচয় ও ভুল নীতি গ্রহণের জেরে দক্ষিণ এশিয়ার এই দ্বীপদেশটিতে অর্থনৈতিক কাঠামো বলতে বর্তমানে প্রায় কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। সংকটে অতীষ্ঠ জনগণের ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে এক পর্যায়ে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন।
বর্তমানে অবশ্য পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থাও শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি থেকে খুব দূরে নেই বলে মনে করছেন পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনোমিক্সের গবেষক নাসির ইকবাল। এএফপিকে তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের অর্থনীতি কার্যত ধসে পড়েছে।’
কোনো দেশের অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অন্তত ৩ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো ডলারের রিজার্ভ থাকতে হয়। পাকিস্তানের রিজার্ভে আছে মাত্র ৩৭০ কোটি ডলার। এই পরিমাণ ডলার দিয়ে বড়জোর ৩ সপ্তাহের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারবে দেশটি। পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমগুলোর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে খাদ্য ও ওষুধ ব্যতীত অন্য আর কোনো পণ্য আমদানির অনুমতি দিচ্ছে না সরকার। এমনকি, কারখানায় শিল্পোৎপাদন ও নির্মাণশিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় রাসায়নিক ও অন্যান্য কাঁচামাল জাতীয় পণ্যও আমদানি করার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। রাসায়নিক ও কাঁচামাল আমদানির অনুমতি না মেলায় বর্তমানে এক রকম বন্ধ আছে পাকিস্তানের শিল্প কারখানা ও নির্মাণখাত। এমনকি সরকারি ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত প্রকল্পগুলোও স্থগিত আছে।
করাচির শহরতলী এলাকার পথে পথে এখন বসে থাকতে দেখা যায় বিপুল সংখ্যক দিনমজুর ও নির্মাণ শ্রমিককে। কাজের আশায় এখনও প্রতিদিন সকালে এসে জড়ো হন তারা, কাজ মেলে না। ৫৫ বছর বয়স্ক জাফর ইকবাল পেশায় রাজমিস্ত্রি। করাচির সড়কের ধারে কাজের আশায় বসে থাকা জাফর এএফপিকে বলেন, ‘দেশে এখন শ্রমিকের সংখ্যা কমছে, বাড়ছে ভিক্ষুকের সংখ্যা।’ তিনি আরও জানান জানান, বর্তমানে পরিবারের জন্য একবেলার খাবার জোগাড় করাও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে তার জন্য। উলফাৎ নামের এক বিধবা নারী করাচিতে নিজের ছেলেকে নিয়ে থাকেন। তার ছেলে একজন বাইকচালক, অর্থাৎ বাইকে যাত্রী পরিবহন করেন। এএফপিকে তিনি বলেন, ‘খাদ্যপণ্যের দাম এত বেশি যে, আমরা এখন আর দিনে তিনবেলা খাবার খেতে পারছি না। সকালে একটু দেরিতে নাশতা করি, তারপর সাতটার দিকে রাতের খাবার খেয়ে নি। মাঝখানে আর কোনো কিছু খাওয়া হয় না।’
একদিকে যেমন অর্থসংকট দিন দিন তীব্র হয়ে উঠছে পাকিস্তানে, তেমনি বিপুল ঋণের বোঝাও চেপে বসেছে দেশটির ওপর। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর জামিল আহমেদ জানিয়েছেন, চলতি বছর জুন মাসে, অর্থাৎ আর্থিক বছর শেষ হওয়ার আগেই পাকিস্তানকে বিদেশি ঋণের কিস্তিবাবদ ৩ হাজার ৩০০ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে।

এদিকে, দিন দিন বিদ্যুৎ সমস্যা প্রকট হয়ে উঠছে দেশটিতে। রাজধানী ইসলামাবাদসহ বড় বড় শহরগুলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় থাকছে। প্রত্যন্ত এলাকাগুলোর অবস্থা আরও খারাপ। জ্বালানিমন্ত্রী মুসাদ্দিক মালিক অবশ্য সম্প্রতি জানিয়েছেন, রাশিয়া পাকিস্তানকে কম দামে জ্বালানি তেল দিতে সম্মত হয়েছে এবং আগামী এপ্রিল মাস থেকে রুশ তেলের সরবরাহ আসা শুরু করবে। কিন্তু এপ্রিল আসতে আরও প্রায় তিন মাস বাকি। ততদিন কীভাবে চলবে পাকিস্তান?

 

Related Articles

Back to top button