বিজয়ের পাঁচ দশক, অনিরাপদ সড়ক এখনো বাস্তবতা

মোঃ মনোয়ারুল ইসলাম : ১৬ ডিসেম্বর আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গৌরবময় দিন। এই দিনটি কেবল বিজয়ের উৎসব নয়; এটি আত্মত্যাগ, মানবিক মর্যাদা ও জীবনের অধিকারের স্মারক। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতার মূল আকাঙ্ক্ষা ছিল এমন একটি রাষ্ট্র, যেখানে মানুষ নিরাপদে বাঁচবে, নির্বিঘ্নে চলাচল করবে এবং সম্মানের সঙ্গে জীবন যাপন করতে পারবে। অথচ স্বাধীনতার পাঁচ দশকেরও বেশি সময় পর দাঁড়িয়ে আজ প্রশ্ন জাগে—আমাদের সড়কগুলোর বর্তমান অবস্থা কি সেই বিজয়ের চেতনাকে সত্যিই ধারণ করতে পেরেছে?
প্রতিদিন সড়কে যে প্রাণগুলো ঝরে যাচ্ছে, আমরা সেগুলোকে খুব সহজে দুর্ঘটনা” বলে চিহ্নিত করি। শব্দটি ব্যবহার করে যেন আমরা দায় এড়িয়ে যেতে স্বস্তি পাই। কিন্তু সত্যিকার অর্থে এগুলো কি নিছক দুর্ঘটনা? নাকি দীর্ঘদিনের অব্যবস্থা, দুর্বল আইন প্রয়োগ, দায়িত্বহীনতা এবং সামগ্রিক উদাসীনতার ফল? যে দেশের স্বাধীনতা রক্তে কেনা, সে দেশে সড়কে মৃত্যুকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেওয়া কি বিজয়ের চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে?
সড়ক নিরাপত্তা কোনো বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়; এটি সরাসরি মানুষের জীবনের অধিকার ও রাষ্ট্রের দায়িত্বের সঙ্গে যুক্ত। নিরাপদ সড়ক মানে শুধু মসৃণ বা প্রশস্ত রাস্তা নয়। এর অর্থ শৃঙ্খলিত যানবাহন ব্যবস্থা, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত চালক, নিয়ম মানার সংস্কৃতি, পথচারীবান্ধব অবকাঠামো এবং সর্বোপরি কার্যকর আইন এর প্রয়োগ। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমাদের সড়কগুলোতে বেপরোয়া গতি, অদক্ষ ও অপ্রশিক্ষিত চালক, যাত্রী টানার প্রতিযোগিতা এবং ট্রাফিক আইন অমান্য করার প্রবণতা নিত্যদিনের চিত্র। এর প্রত্যক্ষ ভুক্তভোগী হচ্ছে সাধারণ মানুষ—শিক্ষার্থী, শ্রমজীবী মানুষ, নারী, শিশু ও বয়স্করা।
রোডক্র্যাশে নিহত একজন মানুষ কেবল একটি পরিসংখ্যান নয়; তিনি একটি পরিবারের স্বপ্ন, নির্ভরতা ও ভবিষ্যৎ। একটি দুর্ঘটনা মুহূর্তের মধ্যে একটি পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে অনিশ্চিত এবং মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে দিতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে একটি পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষকে হারানোর অর্থ আজীবনের সংগ্রাম। তবুও আমরা প্রায়শই এসব মৃত্যুকে নিয়তির দায় বলে এড়িয়ে যাই। এই মানসিকতাই আমাদের সমাজের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা এবং সড়ক নিরাপত্তা অগ্রগতির প্রধান অন্তরায়।
রাষ্ট্রের দায়িত্বের জায়গায় তাকালে দেখা যায়, সেফ সিস্টেম এর আলোকে সড়ক নিরাপত্তা আইন না থাকা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সীমাবদ্ধতা, অবকাঠামোগত দুর্বলতা, সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি এবং জবাবদিহিতার অভাব সড়ক ব্যবস্থাপনাকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। প্রকৌশল, আইন প্রয়োগ ও জনসচেতনতা—এই তিন স্তরের সমন্বয় ছাড়া সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। কিন্তু বাস্তবে এই সমন্বয় এখনো প্রত্যাশিত মাত্রায় গড়ে ওঠেনি।
তবে বর্তমানে সড়ক নিরাপত্তা শুধু প্রশাসনিক সমস্যা নয়; এটি সামাজিক মূল্যবোধ ও জনমনের পরিবর্তনেরও প্রশ্ন। আমাদের প্রতিটি নাগরিক যদি ছোট ছোট দায়িত্বগুলো নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণ করে, যেমন সীটবেল্ট পরা, হেলমেট ব্যবহার এবং মোবাইলে কথা না বলা, তবে রোডক্র্যাশের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব। পাশাপাশি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন ও মিডিয়ার মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। যুবসমাজকে সড়ক নিরাপত্তার অংশীদার হিসেবে ধরে নিলে পরিবর্তন গড়ে ওঠা আরও ত্বরান্বিত হবে। সরকারের পরিকল্পনা ও নাগরিক উদ্যোগ মিলিত হলে, প্রতিটি পথ, প্রতিটি শহর ও গ্রামে নিরাপদ চলাচলের সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়বে। এই ধরনের সমন্বিত প্রচেষ্টা শুধু জীবন বাঁচাবে না, বরং দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
তবে শুধু রাষ্ট্রের দিকে আঙুল তুললেই দায়িত্ব শেষ হয় না। নাগরিক হিসেবেও আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব রয়েছে। চালক হিসেবে নিয়ম মানা, পথচারী হিসেবে সচেতন থাকা, যাত্রী হিসেবে অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা—এসবই সড়ক নিরাপত্তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আইন মানাকে যদি আমরা ভয় বা বাধ্যবাধকতা হিসেবে না দেখে নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করতে পারি, তাহলে সড়কে শৃঙ্খলা অনেকটাই ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
এই জায়গায় তরুণ ও যুব সমাজের ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিজয় উদযাপনকারী প্রজন্ম হিসেবে তরুণদের কাঁধেই ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের দায়িত্ব বর্তায়। সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে সচেতনতা তৈরি, সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা, নীতিনির্ধারকদের কাছে জবাবদিহি দাবি করা—এই কাজগুলোতে যুবসমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকলে সড়কে মৃত্যু কমানো সম্ভব।
বিজয় দিবস আমাদের শুধু অতীত স্মরণ করায় না, ভবিষ্যতের জন্য নতুন করে অঙ্গীকার করতেও শেখায়। এই দিনে আমাদের শপথ হওয়া উচিত—সড়কে আর কোনো প্রাণ ঝরবে না। নিরাপদ সড়ক কোনো বিলাসিতা নয়; এটি একটি মৌলিক নাগরিক অধিকার। রাজনৈতিক সদিচ্ছা, কঠোর ও ধারাবাহিক আইন প্রয়োগ এবং নাগরিক সচেতনতার সমন্বয় ঘটাতে পারলে সড়কে মৃত্যুহার শূন্যের কাছাকাছি নামানো অসম্ভব নয়।
প্রশ্ন থেকেই যায়—নিরাপদ সড়ক ছাড়া কি বিজয় সত্যিই সম্পূর্ণ? বিজয় দিবস তখনি অর্থবহ হবে যখন আমরা এমন একটি বাংলাদেশ গড়তে পারব, যেখানে মানুষ সড়কে নিশ্চিন্তে ও নিরাপদে চলাচল করতে পারবে। বিজয়ের চেতনা তখনই পূর্ণতা পাবে, যখন স্বাধীন দেশের সড়কেও জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।
সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা মানে শুধু প্রাণ বাঁচানো নয়, এটি দেশের বিকাশ ও সামাজিক স্থিতিশীলতার মূল ভিত্তি।প্রযুক্তি,পরিকল্পিত অবকাঠামো এবং সচেতন সমাজের মিলিত প্রচেষ্টাই রোডক্র্যাশ কমাতে পারে। শহীদদের ত্যাগকে সার্থক করা যাবে তখনই, যখন আমাদের দেশের প্রতিটি মানুষ সড়কে নিশ্চিন্তে ও নিরাপদে চলাচল করতে পারবে। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা হল সত্যিকারের বিজয়ের চেতনার প্রতিফলন।
-লেখক
মোঃ মনোয়ারুল ইসলাম
এ্যাডভোকেসি অফিসার (পলিসি)
স্বাস্থ্য সেক্টর
ঢাকা আহছানিয়া মিশন


