বাংলাদেশ

লেবাসধারী অধ্যাপক আবু ইউসুফের অনিয়ম-দুর্নীতিতে চলছে বাংলাদেশ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ

নিজস্ব প্রতিবেদক: অধ্যাপক আবু ইউসুফের অনিয়ম-দুর্নীতি ও লুটপাটের আখড়ায় পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ। কলেজের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান হয়েও অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ নিয়োগ এবং পদোন্নতিতে আর্থিক দুর্নীতি করেই চলেছেন অধ্যাপক আবু ইউসুফ। অভিযোগ রয়েছে, অর্থের বিনিময়ে তিনি বিভিন্ন পদে নিয়োগ ও পদোন্নতি দিয়ে আসছেন।

অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, অধ্যাপক আবু ইউসুফ ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ এ.টি.এম. জাফরুল আজমের যোগসাজশে শিক্ষক নিয়োগে ১০ থেকে ১৫ লক্ষ এবং অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ নিয়োগে ৪০ থেকে ৫০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র অনুযায়ী নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ থাকার পরও কলেজ গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু ইউসুফ তার পছন্দের প্রার্থীকে অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগের লক্ষ্যে নীতিমালা লঙ্ঘন করে তড়িঘড়ি করে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেন এবং আবেদনের জন্য পর্যাপ্ত সময় দেননি। সরকারি প্রজ্ঞাপন উপেক্ষা করে গঠন করেন সিলেকশন বোর্ড এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যে নিয়োগের ব্যবস্থা নেন।

রাজধানীর গ্রিন রোডের বাংলাদেশ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের গত ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় (মাত্র একটি পত্রিকায়) নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। আবেদনের শেষ তারিখ ছিল ৫ অক্টোবর ২০২৫। কিন্তু উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে ৪ অক্টোবর পর্যন্ত কলেজে দুর্গাপূজার ছুটি ছিল। ফলে অনেক আবেদনকারী আবেদন জমা দিতে পারেননি।

বাংলাদেশ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে অধ্যক্ষ পদে ৩টি এবং উপাধ্যক্ষ পদে ২টি আবেদন জমা পড়ে। অভিযোগ রয়েছে, অধ্যাপক আবু ইউসুফের নির্দেশে অনেক আবেদন ‘গায়েব’ করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া আবু ইউসুফ ও কোষাধ্যক্ষ এ.টি.এম. জাফরুল আজমের আত্মীয়দের অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগের পায়তারা চলছে।

সূত্র জানায়, বর্তমানে আর্থিক অনিয়মের মাধ্যমে সাজেদা খানমকে অধ্যক্ষ এবং রুমানা বাশারকে উপাধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে।

বর্তমান গভর্নিং বডির মেয়াদ গত ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে শেষ হয়েছে। তবুও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন ছাড়া দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন অধ্যাপক আবু ইউসুফ। গভর্নিং বডির মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো চিঠিও আসেনি। নিয়ম অনুযায়ী, পরবর্তী কমিটি ৬০ দিনের মধ্যে গঠিত হতে হবে; অর্থাৎ ১৭ নভেম্বর ২০২৫ তারিখে ৬০ দিন পূর্ণ হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অধ্যাপক আবু ইউসুফ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীল দলের সদস্য এবং বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত।

প্রাক্তন চেয়ারম্যান মোঃ নাজমুল আহসানের নেতৃত্বে গঠিত অডিট কমিটির রিপোর্ট বর্তমান চেয়ারম্যান আবু ইউসুফ প্রকাশ করেননি। সেই অডিট রিপোর্টে প্রাক্তন অধ্যক্ষ রুপশ্রী চৌধুরী ও প্রাক্তন উপাধ্যক্ষ আয়েশা আক্তারের ৪১ কোটি টাকার আর্থিক দুর্নীতির প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি। বরং তাদের বিভিন্ন সুবিধা প্রদান করেছেন এবং প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্র্যাচুইটি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন।

এ ছাড়া মোহাম্মদ এ জামান চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে কলেজের আয়-ব্যয়ে অসামঞ্জস্য, অতিরিক্ত নগদ লেনদেন, সাপোর্টিং ডকুমেন্ট ও বিল-ভাউচার না থাকা, শিক্ষকদের পদোন্নতি, প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্র্যাচুইটি খাতে ব্যাপক অনিয়মের তথ্য পাওয়া গেছে।

রাজধানীর গ্রিন রোডে জমি ক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রাথমিক মূল্য নির্ধারণ হয়েছিল ৫ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, যা পরে বেড়ে গিয়ে ৭ কোটি ৫০ লাখ টাকায় ক্রয় করা হয়।

প্রতিটি বিভাগে শিক্ষক নিয়োগে স্বজনপ্রীতি, আর্থিক লেনদেন, অনিয়মিত উপস্থিতি, ও বৈষম্যপূর্ণ আচরণের অভিযোগও পাওয়া গেছে।

সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বে থাকা ডালিয়া ও সাজেদা খানমকে অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ নিয়োগ সংক্রান্ত প্রশ্নে তারা কোনো মন্তব্য না করে বলেন, “এ বিষয়ে আমাদের কিছু বলার নেই, উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলুন।”

অধ্যাপক আবু ইউসুফকে ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি দাবি করেন যে, গভর্নিং বডির বর্তমান কমিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী বৈধ। তিনি বলেন, “পরবর্তী কমিটি গঠিত না হওয়া পর্যন্ত আমি দায়িত্বে আছি, এবং ৬০ দিন এখনো পূর্ণ হয়নি।” একই সঙ্গে তিনি স্বীকার করেন যে, ২০২৪–২৫ শিক্ষাবর্ষে পাস কোর্সে কোনো শিক্ষার্থী ভর্তি হয়নি।

অন্যদিকে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ এ.টি.এম. জাফরুল আজমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি কল কেটে দেন এবং পুনরায় যোগাযোগ করেননি।

সার্বিকভাবে, প্রতিষ্ঠানটির সুশাসন, স্বচ্ছতা, ও আর্থিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে দুর্নীতি দমন কমিশনের জরুরি হস্তক্ষেপ এবং প্রশাসনিক সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ অপরিহার্য বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট মহল।

সবশেষে বলা যায়, বর্তমান গভর্নিং বডির দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের জরুরি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।

Related Articles

Back to top button