মায়ের অধিকার

সৈয়দা রাশিদা বারী : ভাষা সৈনিকদের মহাব্বতের বাংলা ভাষার ছোট্ট একটি শব্দ মা! এই মা শব্দের অর্থ এবং বানান এর কোন ভিন্নান্তর হয় না। ভিন্নান্তর নেই। মা তো মা ই। প্রত্যেকের মায়ের জায়গায় মা, একই মা। কারো ভালোবাসার কারো অবহেলার। অনেক পুরুষই আছেন মাকে ভালোবাসেন শ্রদ্ধা করেন, সন্তানের কাতারে রেখে, আরেক সন্তান মনে করেন। বোঝা মনে করেন না। হিসাবের বাইরে রাখেন না। তিনারা অন্যান্য ভাই-বোনদের সাথে মাকে দেখার ব্যাপারে ঠেলাঠেলি করেন না। মায়ের পিছনের ব্যয় খাওয়া পড়া নিয়ে ভাগ বাটোয়ারা করেন না। যেমন মাও সন্তানদের মানুষ করার সময়, পেটে ধরে দুধ খাওয়ানোর সময়, অন্যের উপরে ফেলে রাখেন নাই ঠেলাঠেলি করে। মা একাই সন্তানের সমস্ত দায়িত্ব পালন করেছেন। একাধিক সন্তানের আলাদা আলাদা ভাবে একাই সব দায়িত্ব পালন করেছেন ভাগ করেন নাই। ভাগ করে কারো জন্য সন্তানের কাজ ফেলে রাখেন নাই। সমাজ সংসারে নারী মানেই মা। প্রত্যেক নারীই মা। কারো মা কারো বোন, কন্যা, ভাবি, ফুফু খালা, নানী দাদি প্রভৃতি সম্পর্কে। কিন্তু মূলত একজন নারী মানেই সম্মানিত মা। মায়ের পার্থক্য নাই কিন্তু ব্যক্তিত্বের পার্থক্য আছে। যেমন আছে যুগের অবিস্মরণীয় কিছু জ্ঞানী ও গুণী নারী। এইখানে আমরা সব নারীকে, সব বোনকে, মাকে, কন্যাকে এক কাতারে ফেলতে পারিনা। এক দাঁড়িপাল্লা এক বাটখারাই মাপতে পারি না। শুধু পেটের ভাত,, পরনের কাপড়, আর যেখানে সেখানে ঘুমিয়ে পড়া অথবা যার তার কাছে সামান্য একটু ঘুমাবার জায়গা হলেই হয়, এইরকম সব মায়ের ক্ষেত্রেই নয়। যেখানে রাত সেখানেই কাত, এরকম পরিবেশ সব নারী সব মায়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়। খনা, কিলোপেট্রা, সুলতানা রাজিয়া, গুলবাহার সুলতান, প্রথম রানী এলিজাবেথ, দ্বিতীয় রাণী এলিজাবেথ, সম্রাজ্ঞী নুরজাহান, মমতাজ মহল, লুৎফুন্নেসা বেগম, ইংল্যান্ডের মহারানী ভিক্টোরিয়া, মৃণালিনী দেবী, প্রমিলা নজরুল, মাদার তেরেসা, প্রীতিলতা পোদ্দার, ইন্দিরা গান্ধী, ইলা মিত্র, সুচিত্রা সেন, সৈয়দা সাফিয়া জাফর হাই, বেনজির ভুট্টো, প্রিন্সেস ডায়না এরাও নারী। বেগম ফয়জুন্নেসা চৌধুরী রানী, দেওয়ান সহিফা বানু চৌধুরানী, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, বেগম বদদুন্নেসা আহমদ, সৈয়দা সেলিমা নুরজাহান বেগম, সাংবাদিক সেলিনা পারভীন, নুরজাহান বেগম, অধ্যক্ষ জাহানারা হক, শতাধিক গ্রন্থের প্রণেতা সৈয়দা রাশিয়া বারী আরো প্রভৃতি নারী রয়েছেন তারাও নারী। তারাও মা। কারো মা কারো বোন কন্যা ভাবি ফুপু খালা দাদি নানী। সম্পর্কের দিক থেকে দেখতে একই কিন্তু কর্মের দিক থেকে আলাদা। শুধু পেটের ভাত পরনের কাপড় যথাতথা ঘুমাবার একটু স্থান সব নারীর জন্য নয় প্রযোজ্য বললাম তো। সাজেই ওই সমস্ত অসাধারন নারীর জন্যই বলছি। জিনারা যুগে যুগে এসেছিলেন। এখনো আছেন এসেছেন। ভবিষ্যতেও থাকবেন আসবেন। তাই বৈষম্য নয় বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে চাই এবং বলছি। মাত্রিক সূত্রে পিতৃক সূত্রে সন্তান মা-বাবা কর্তৃক তাদের সহায় সম্পত্তি পাবার মত, অধিকার প্রাপ্ত হওয়ার মত, সন্তান সূত্রেও মা সন্তানের অর্জনকৃত অর্থ করি সম্পদ সম্পত্তিতে অধিকার প্রাপ্ত হোক এবং হওয়া জরুরী। সুন্দর সুস্থ সমাজ গঠনে হওয়া দরকার। তাহলেই সাধারণত আর পুত্র কর্তৃক, পুত্রবধূ কর্তৃক, মায়ের অবহেলা অমর্যাদা অপমান অপদস্ত হওয়ার সুযোগ থাকবে না। মাকে পুত্র এবং পুত্রবধূ বোঝা মনে করবেনা। মাকে দয়া করে স্থান ভরণ পোষণ দিচ্ছে তারা, এই গুঙানি আত্ম অহংকারে কষ্ট দিতে ও মায়ের অপমান করতে পারবে না। মায়ের প্রয়োজন মিটাচ্ছে তারা, এই ব্ল্যাকমেল করতে পারবেনা। মা যথাসাধ্য পুত্র কর্তৃক অর্জিত তার প্রাপ্তি নিয়ে চলবেন। সব পুত্র কর্তৃক মা তাদের আইন কামের একইভাবে কমিশন পাবেন। একজন পুত্র হলে একজন পুত্রের কাছ থেকেই পাবেন। পুত্রবধূ বুঝবে যে স্বামী তার মায়ের প্রাপ্তি বুঝিয়ে দিচ্ছে। দয়া করে দিচ্ছে তা নয়। মা ইনভাইট করে রেখেছে, মা সেই ইনভেস্টেড বিনিময় পাচ্ছে। জমি খরিদ করে রেখেছেন সেই জমির ফসল পাচ্ছে। এমন হলে এখানে কোন মাথা পুত্রবধূ ঘামাবে না। পুত্রবধূর মাথা ঘামানোর জন্য তো শুধু শাশুড়িই না। শাশুড়ির পুত্রের জীবনও পুরে ঝাজরা হয়ে যায়! তার মানে প্রত্যেক স্বামীরও, স্বামীর নিজের মায়ের জন্য, স্ত্রীর কাছে জবাবদিহিতা দিতে দিতে অতিষ্ঠ হয়ে যায়! এই অতিষ্ঠ হওয়ার হাত থেকে বাঁচতে ওই আইন জারি করতে হবে। উঠতে বসতে স্বামী বেচারা যেভাবে জন্মদাত্রী মায়ের জন্য স্ত্রীর কাছে ছোট হয়, এইটাও হবে না। অবশ্যই মায়ের এই পাওনাটিও লিগাল। এই প্রাপ্তিতে কারো আপত্তি বিপত্তি থাকার কথা নয়। সন্তানের আই ইনকাম বাৎসরিক অথবা মাসিক পাক্ষিক তথা সন্তানের অর্জনকৃত গচ্ছিত সম্পত্তির কমিশন মায়ের লিগাল প্রাপ্তি। উপযুক্তও বটে। সেটা সন্তানের জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুদশায় উভয় ক্ষেত্রেই যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমন প্রয়োজনীয়। মায়ের নিরাপত্তার এবং পারিবারিক মর্যাদা রক্ষণাবেক্ষণের এটা একটা বড় পথ। মান প্রেস্টিজ শুধু মায়েরই রক্ষা হবে না সন্তানেরও হবে। পরিবারেরও হবে। আত্মীয়-স্বজন প্রতিবেশীরও হবে। প্রত্যেক সন্তান কতৃক মা তার সন্তানের আয় ইনকামের একটা পার্সেন্ট কমিশন পাবেন। এমনকি সুদে আসলে ফিরিয়ে পাবেন। প্রথম জীবনে মা সন্তানকে পেটে ধরা থেকে বুকের দুধ খাওয়ানো এবং তার পিছনে যত পরিশ্রম দিয়েছেন এবং ইনভেস্ট করেছেন সেটা ফিরিয়ে পাবেন। সন্তানকে নমিনি করতে হবে না মায়ের নামে। জন্ম দেওয়া ঔরসস্কৃত সন্তান, সন্তান থেকে এই হিসেবে পাবেন। কর্ম এবং ইনভেস্ট করার মর্যাদা হিসেবে ফিরিয়ে পাবেন। বৃদ্ধাশ্রম আছে ভালো। এই কার্যক্রম চলছে চলুক। অব্যাহত থাকুক। বলেছি তো সব নারীর জন্য সব কিছু নয়। ডেস্ক এবং টেবিল চেয়ার সব মায়ের লাগে না। সব মা লেখক কবি সাহিত্যিক সাংবাদিক সম্পাদক নন। বৃদ্ধাশ্রমে অসহায় নিঃস্বহায় পথিকজন তথা সেরকম মাদের জন্য প্রয়োজন, তাদের জন্য বেস্ট। কিন্তু জিনারা গুরুত্বপূর্ণ নারী, গুরুত্বপূর্ণভাবে সন্তানকে মানুষ করেছেন। জীবনের সব ঢেলে দিয়ে, মানুষের মতন উপযুক্ত ও মানুষ করেছেন। এই গুরুত্বপূর্ণ নারীদের ত্যাগের বিনিময়, তার শেষ বয়সের মান সম্মান এবং সবকিছু রক্ষার্থে এইভাবেই হওয়া বাঞ্ছনীয়। মানে সন্তানের উপার্জিত সবকিছুর কমিশন থেকে প্রাপ্তি হওয়া বাঞ্ছনীয়। তাহলে পুত্র পুত্রবধূকে এবং তার সন্তানের নমিনি করে দিয়ে গেলেও, জন্মদাত্রী মায়ের জায়গা থেক, মায়ের বেঁচে থাকার অধিকার ও মায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকবে। পুত্রবধূ ও তার আত্মীয়-স্বজন অপদস্থ হেয় প্রতিপন্ন অপমান অপদস্থ লাঞ্ছিত গঞ্জিত বঞ্চিত এমনকি যে সে ধর্ষণ করতে পারবে না। যেহেতু শেষ জীবনটা মায়ের পথে পথে ঘায় গুতো খেয়ে বেড়াতে হবে না। সম্মানীয় মা বৃদ্ধকালের শেষ দিনগুলোও সসম্মানে বাঁচতে পারবেন। বোঝা হয়ে তিতে হয়ে ধুকে ধুকে মরবেন না। সম্মানের সাথে চির বিদায় নিতে পারবেন আল্লাহর দুনিয়া পৃথিবী থেকে। কেননা সে তো তার পুত্রকে ইয়াং জীবনে সর্বস্ব দিয়ে পুত্রকে মানুষের মত মানুষ করেছেন। পেটে ধরা থেকে বুকের দুধ খাওয়ানো থেকে, আরো কতই পুত্রের পিছনে তার অবদান রয়েছে পুত্র প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত। সেই পুত্রের পিছনের ঐ ইনভেস্ট কর্ম শ্রম পরিশ্রম এর বিনিময় শেষ অক্ষম জীবনে ফিরিয়ে পাবেন সুধে আসলে। পুত্র কর্তৃক পাওয়া মায়ের এই প্রাপ্ততা খাঁটি এবং নির্ভেজাল। যেমন খাটি এবং নির্ভেজাল অবদান মা রেখেছিলেন পুত্রর প্রাপ্ত বয়স না হওয়া পর্যন্ত। পুত্রের মানুষের মত মানুষ না করা পর্যন্ত। বাংলাদেশে মাতা পিতার ভরণপোষণ আইন 2013 সালে পাশ করা হয়েছে। অবশ্যই এই নীতিমালা আইনের প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল। শ্রদ্ধা রেখেই আমি অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথির বক্তব্যে উপরোক্ত নির্দেশনাও জরুরি ভাবে কার্যকরী হওয়ার আহ্বান রেখেছি, গত ৩১ শে অক্টোবর ২০২৫ মিরপুরে ‘জাগো নারী ফাউন্ডেশনের ২০তম বছর পূর্তি আয়োজন অনুষ্ঠানে। usa বসবাসরত মহামায়াবী নারী নুরুন্নাহার মেরীর প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান, এটা একটি স্বেচ্ছাসেবী জাতীয় এনজিও প্রতিষ্ঠানও বলা চলে। এখান থেকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বহু নারীর স্বাবলম্বী হওয়ার অনুপ্রেরণা যোগানো হয়েছে। নুরুন্নাহার মেরি আপার প্রতি কৃতজ্ঞ এবং তাকে ধন্যবাদ, যে তিনি দূরে থেকেও দেশের নারীর জন্য আজীবন কাজ করে যাচ্ছেন। এই সমাজে নারীর অধিকার তো সবাই লেখেন এবং সবাই পড়ে থাকেন কিন্তু আমি আজ ‘জাগো নারী ফাউন্ডেশন’ এর ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে, জাগো নারী ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা, সভাপতি, মানবাধিকারের আর এক মনীষী নারী, নুরুন ন্নাহার মেরি আপার সৌজন্যে লিখলাম ‘মায়ের অধিকার।
০১. ১১. ২০২৫ ইং, সন্ধ্যা ৭টা, শনিবার।



