ঢাকা-বরিশাল রুটে চালু হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী নদীভ্রমণ —বিআইডব্লিউটিসির উদ্যোগে নৌপর্যটনে নতুন দিগন্ত
ঐতিহ্যের প্রত্যাগমন: পর্যটন সার্ভিসে শতবর্ষী প্যাডেল স্টিমার ‘পি.এস মাহসুদ’

মাখদুম সামি কল্লোল: বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থা (বিআইডব্লিউটিসি) দেশের নদীপথ ও উপকূলীয় যোগাযোগে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে যাচ্ছে। ঐতিহ্যবাহী শতবর্ষী প্যাডেল স্টিমার ‘পি.এস মাহসুদ’ এবার নতুন আঙ্গিকে পর্যটন সার্ভিসে যুক্ত হতে যাচ্ছে। ঢাকা-বরিশাল রুটে পর্যটকদের জন্য এই স্টিমার সার্ভিস শুরু হলে দেশের রিভার ট্যুরিজমে এক নবযুগের সূচনা ঘটবে বলে আশা করছে সংস্থাটি।
ঐতিহ্যের ধারায় নদীপথের নবজাগরণ
১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিআইডব্লিউটিসি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নৌযোগাযোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ফেরি, যাত্রীবাহী জাহাজ, কার্গো ও সী-ট্রাক সার্ভিসের মাধ্যমে দেশের দক্ষিণাঞ্চল ও রাজধানীর মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ বজায় রাখছে সংস্থাটি।
এই ধারাবাহিকতায় এবার নদীপথে ঐতিহ্য, ইতিহাস ও পর্যটনের মেলবন্ধন ঘটাতে ‘পি.এস মাহসুদ’ প্যাডেল স্টিমার-কে পর্যটন সার্ভিসে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
‘পি.এস মাহসুদ’: ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী
১৯২৯ সালে কলকাতার গার্ডেন রিচ ওয়ার্কশপে নির্মিত ‘পি.এস মাহসুদ’ এক সময় অবিভক্ত বাংলার নদীপথে ‘রকেট স্টিমার’ হিসেবে পরিচিত ছিল।
বেলজিয়ামের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় ১৯৮৩ সালে এটি ডিজেল ইঞ্জিনে রূপান্তর করা হয় এবং ১৯৯৫ সালে যুক্ত হয় মেকানিক্যাল গিয়ার সিস্টেম।
বিগত শতাব্দীজুড়ে নিরাপদে যাত্রী পরিবহনকারী এই স্টিমার কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই বাংলাদেশের নৌ-ঐতিহ্যের প্রতীক হয়ে আছে।
আধুনিকায়নে ঐতিহ্যের সংরক্ষণ
২০২৫ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর মাসে ‘পি.এস মাহসুদ’-এর হাল ও সুপারস্ট্রাকচারে স্টিল প্লেট পরিবর্তন, দুটি নতুন জেনারেটর সংযোজন, সম্পূর্ণ রং করা ও কাঠের ডেক সংস্কারের মাধ্যমে নতুন রূপে সাজানো হয়েছে।
এছাড়াও সংযোজিত হয়েছে ‘হেরিটেজ কর্নার’, যেখানে শতবর্ষে ভ্রমণকারী বিশিষ্ট ব্যক্তিদের স্মারক, পুরনো নৌযান উপকরণ ও ঐতিহাসিক নিদর্শন প্রদর্শন করা হবে।
পর্যটকদের জন্য অভিজ্ঞতা ও সুযোগ
প্রতি শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে স্টিমারটি ঢাকা সদরঘাট থেকে বরিশাল বন্দরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে এবং শনিবার সকালে ফিরে আসবে।
একসঙ্গে ৩২৩ জন পর্যটক আরোহনের সুযোগ পাবেন। যাত্রীরা নদীপথের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বিশেষ করে মেঘনা নদীর দৃশ্য উপভোগ করতে পারবেন।
খাবার ব্যবস্থাতেও থাকবে ঐতিহ্যের ছোঁয়া— ফিস কাটলেট, স্মোকড হিলশা, ফিস ড্রাইসহ ক্লাসিক মেন্যু পরিবেশন করা হবে।
চাইলে যাত্রীরা জাহাজেই রাত্রিযাপন ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারবেন।
বাংলাদেশের পর্যটন ও অর্থনীতিতে নতুন দিগন্ত
বিশ্বব্যাপী অভ্যন্তরীণ ও সামুদ্রিক পর্যটন খাত বর্তমানে বিশ্ব জিডিপির প্রায় ৫ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব করছে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৮.৫ মিলিয়ন কর্মসংস্থান সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশে ঐতিহ্যবাহী স্টিমারভিত্তিক পর্যটন সার্ভিস চালু হলে তা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিআইডব্লিউটিসির নৌখাত উন্নয়নে বহুমুখী পরিকল্পনা
বর্তমানে সংস্থাটির বহরে রয়েছে ৪৯টি ফেরি, ৪টি প্যাডেল স্টিমার, ৮টি ওয়াটার বাস, ৯টি সী-ট্রাক, ২টি অয়েল ট্যাংকারসহ বিভিন্ন নৌযান ও ৪টি ডকইয়ার্ড।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি ৯৩ লক্ষাধিক যাত্রী এবং ১৭ লক্ষাধিক যানবাহন পারাপার করেছে।
চট্টগ্রাম-সন্দ্বীপ, মহেশখালী-কক্সবাজারসহ বিভিন্ন রুটে নতুন সার্ভিস চালু, আধুনিক ক্রুজ শিপ নির্মাণ ও ৮টি নতুন নৌরুট চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
বিআইডব্লিউটিসি চেয়ারম্যানের ভাষায়,
“ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও পর্যটন বিকাশের লক্ষ্যে শতবর্ষী প্যাডেল স্টিমার ‘পি.এস মাসুদ’-কে পর্যটন সার্ভিসে নিয়োজিত করার এই উদ্যোগ শুধু নদীপথ নয়, বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সংস্কৃতির জন্যও এক অনন্য মাইলফলক।”
ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মেলবন্ধনে নদীমাতৃক বাংলাদেশের এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে দেশের নৌপর্যটন শিল্পে এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিচ্ছে।



