বাংলাদেশ

বাংলা একাডেমিতে তুঘলকি কান্ড, অবসরে গিয়েও তিনি প্রকল্প পরিচালক

করছেন নিয়মিত অফিস

জ্যৈষ্ঠ প্রতিবেদক : সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পরেও প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়মিত অফিস করছেন বাংলা একাডেমীর সাবেক পরিচালক (প্রশাসন) ড. হাসান কবীর। গত ৯ মাস যাবত তিনি অবৈধভাবে একাডেমি ভবনেই অফিসে বসে প্রকল্পের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন নজির এই প্রথম। অনুসন্ধানে এই বিষয়ে যথেষ্ট প্রমাণ মিলেছে প্রতিবেদকের কাছে। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার স্বৈরাচার সরকার আমলে প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পাওয়া এই কর্মকর্তা ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে অবসর গ্রহণ করলেও কোন এক অদৃশ্য ক্ষমতার দাপটে এখনো খোদ বাংলা একাডেমিতে বসেই প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। সর্বশেষ গত ৩০ সেপ্টেম্বরও তাকে বাংলা একাডেমীর ড. এনামুল হক ভবনের ষষ্ঠ তলায় অফিস করতে দেখা গেছে। এ ঘটনায় রীতিমতো চাঞ্চল্যের ঝড় বইছে বাংলা একাডেমীর স্টাফদের মাঝে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলা একাডেমীর লাইব্রেরি আধুনিকায়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) হিসেবে ড. হাসান কবীর দায়িত্ব পালনকালে আওয়ামী লীগ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কে এম খালেদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় জুনায়েদ আহমেদ পলকের বিশ্বস্ত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান দিয়ে প্রকল্পের কাজটি শুরু করেছিলেন। প্রকল্পটির ১৯ কোটি ৬৬ লাখ টাকার। গুঞ্জন আছে, মন্ত্রী কে এম খালেদকে পাঁচ কোটি টাকার বিনিময়ে তিনি এই প্রকল্পের পিডি হয়েছিলেন। তার অধীনে প্রকল্পের কাজে এত বেশি অনিয়ম ও দুর্নীতি শুরু হয়েছিল যে, ২০২৪ সালের ভোট চুরির পর গঠিত নতুন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী সরজমিনে প্রকল্পের কাজ দেখতে এসে হাতে নাতে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়ার পর প্রকল্পের কাজ স্থগিত ঘোষণা করেন। প্রায় ছয় মাস বন্ধ থাকা অবস্থায় ২০২৪ এর ৫ই আগস্ট স্বৈরাচার ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের পর মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব আতাউর রহমানের সরাসরি হস্তক্ষেপে প্রকল্পের কাজ পুনরায় শুরু হয়। উল্লেখ্য সাবেক সচিব আতাউর রহমান ও প্রকল্প পরিচালক ড. হাসান কবীর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সহপাঠী ছিলেন। একইসাথে ছাত্র হওয়ার সুবাদে তাদের মধ্যে বিদ্যমান সু-সম্পর্কের ফলে বন্ধ কাজ পুনরায় শুরু হয়। রাত দিন শত শত লোক কাজ শুরু করে। কিন্তু তার পরও কাজ যথাসময়ে শেষ করতে পারেনা। আরো ছয় মাস সময় বৃদ্ধি করে ৩০ শে জুন ২০২৫ তারিখ পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়। কিন্তু তার পরও নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে পারেনি। এরই মধ্যে গত ৩১ শে ডিসেম্বর ২০২৪ এই তারিখে ড. হাসান কবীর অবসরে চলে যান। একদিকে অবসর অন্যদিকে বর্ধিত সময়ের পরেও যথাযথভাবে কাজ শেষ করতে পারেনি ড. হাসান কবীর। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে, এই প্রকল্পের অর্থ তিনি অনিয়মিতভাবে ব্যয় করেছেন এবং অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। তিনি পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দিয়েছেন এবং এর মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। ২০১৮ সালে মোট ৫টি লটের কাজ দেওয়া হলেও ৪টি লটের কাজ এখনো সম্পন্ন হয়নি। এ নিয়ে ২০১৯ সালের এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনেও প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ার কারণ হিসেবে প্রকল্প পরিচালকের অনিয়মকে দায়ী করা হয়েছে।

শুধু তাই নয়, ড. হাসান কবীরের বিরুদ্ধে বাংলা একাডেমিতে একাধিক পদে আত্মীয়-স্বজন ও পছন্দের লোককে অবৈধভাবে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে। তার বিরুদ্ধে “নিয়োগ বৈষম্য ও করাপশন আমল (২০২২-২৩)” সংক্রান্ত কমিটির তদন্তে ব্যাপক দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, তিনি তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে আত্মীয়-স্বজনদের বিভিন্ন পদে নিয়োগ দিয়েছেন এবং এর মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন। এমনকি তদন্ত কমিটি এসব দুর্নীতির প্রমাণও পেয়েছে এবং তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার সুপারিশ করেছে। এছাড়া ড. হাসান কবীর বাংলা একাডেমির বই ক্রয় প্রকল্পের সাথেও জড়িত ছিলেন। অভিযোগ রয়েছে যে, তিনি এই প্রকল্পেও ব্যাপক দুর্নীতি করেছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বই ক্রয়ের নামে তিনি পছন্দের প্রকাশকদের কাছ থেকে বই কিনেছেন এবং এতেও বড় ধরনের অর্থ আত্মসাৎ হয়েছে। আরো অভিযোগ আছে যে, ড. হাসান কবীর তার মেয়াদকালে অত্যন্ত নিচুমানের এবং ক্ষতিকর বই ক্রয় করেছেন, যা বাংলা একাডেমির সুনামের জন্য ক্ষতিকর। এসব বই ক্রয়ের পেছনেও ব্যক্তিগত আর্থিক সুবিধা গ্রহণের অভিযোগ উঠেছে।
ড. হাসান কবীরের বিরুদ্ধে উত্থাপিত এসকল অভিযোগের ভিত্তিতে গঠিত তদন্ত কমিটি তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, চাকুরী করাকালীন সময়ে তিনি বাংলা একাডেমির বিভিন্ন স্টাফদের কাছ থেকে প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যক্তিগত ঋণ নেন। যা তিনি এখনো পরিশোধ করেননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমন কয়েক জন পাওনাদার এ বিষয়ে প্রতিবেদককে বলেন, “ক্ষমতা থাকতেই তো টাকা ফেরত পাইনি। আর এখন তো তিনি অবসরে গিয়েও চাকরি করছেন। তার ক্ষমতা কত উপরে বুঝতেই পারছেন। আমাদের টাকা কি আর কখনো ফেরত পাবো?
৩০ সেপ্টেম্বর সরেজমিনে বাংলা একাডেমির ড. এনামুল হক ভবনের ষষ্ঠ তলায় গিয়ে ড. হাসান কবীরকে অফিস কক্ষে উপস্থিত পাওয়া যায়। পরিচয় দিয়ে অবসরের পরে কিভাবে অফিস করছেন জানতে চাইলে প্রতিবেদককে বলেন, “ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই আমি এখনো দায়িত্ব পালন করছি। আপনারা নিউজ করতে চাইলে করেন। তাতে আমার কিছুই যায় আসে না। প্রয়োজনে আপনারা উপদেষ্টার কাছেও যেতে পারেন। বাংলা একাডেমি আমাকে ছাড়া অচল”। বাংলা একাডেমির স্টাফদের কাছ থেকে তিন কোটি টাকা ব্যক্তিগত ঋন নিয়ে ফেরত না দেয়ার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বলেন, ” ঐসব টাকা সব আমি দিয়ে দিয়েছি। এখন আর কেউ টাকা পাবেনা আমার কাছে”।
প্রশ্ন উঠেছে, কে রক্ষা করছে হাসান কবীরকে? কার খুঁটির জোরে এবং কোন আইনের বলে অবসরে যাওয়ার পরেও তিনি এখনো প্রকল্প পরিচালনার কাজ করে যাচ্ছেন? বাংলাদেশের আইন বিষয়টি কতটা বৈধতা দেয়? এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলা একাডেমীর সচিব সেলিম রেজা মুঠোফোনে প্রতিবেদক কে বলেন,”প্রকল্পের কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গিয়েছে। তিনি এখন অবসর কালীন ছুটিতে আছেন। উনার অবসর গ্রহণের পর বাংলা একাডেমির মহাপরিচালককে মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্পের দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রকল্পের কাজ শেষ করতে গিয়ে মহাপরিচালক হয়তো মাঝে মাঝে তার সহযোগিতা নিয়ে থাকতে পারেন। তবে তিনি কখনো নিয়মিত অফিস করতে পারেন না”। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কে প্রকল্পের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এমন কোন মন্ত্রণালয় থেকে দেয়া চিঠি দেখতে চাইলে তিনি বলেন, “অফিসে এসে খুঁজে নিন”।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব মিহির মুসাকি মুঠোফোনে বলেন,” আমি একটা মিটংয়ে আছি, পরে কথা বলবো”।

Related Articles

Back to top button