নেপালে বিক্ষোভ-প্রাণহানির জেরে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ

# প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগে বিক্ষোভকারীদের উৎসব
# বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কাকে দেখেই সরকার পতনের আন্দোলন
# গণমাধ্যমের অফিসে ব্যাপক ভাঙচুর ও আগুন
# পার্লামেন্টে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে বিক্ষোভকারীরা
# নেতা-মন্ত্রীদের বাড়িতে হামলা ভাঙচুর ও আগুন
# ওলির দেশত্যাগ ঠেকাতে সীমান্তে কড়া নজরদারি
টাইমস ২৪ ডটনেট: নেপালে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেন-জি বিক্ষোভকারীদের তুমুল আন্দোলন ও সংঘাতে প্রাণহানির জেরে মঙ্গলবার দেশটির প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি পদত্যাগ করেছেন। পদত্যাগপত্রে প্রধানমন্ত্রী ওলি লিখেছেন, সাংবিধানিক পথে সংকটের সমাধানের পথ তৈরির জন্য তিনি পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলির পদত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়তেই আন্দোলনকারীদের মধ্যে বিজয়োল্লাস দেখা গেছে। উৎসবমুখর হয়ে ওঠে রাজধানী কাঠমান্ডুসহ পুরো দেশ। গতকাল মঙ্গলবার বিক্ষোভকারীরা আবারও কাঠমান্ডুর ফেডারেল পার্লামেন্ট ভবনে প্রবেশ করে। তারা পার্লামেন্ট প্রাঙ্গণের ভেতরের কিছু অংশ ভেঙে প্রবেশ করে এবং সেখানেই ‘বিজয় পতাকা’ ওড়ান। এসময় পার্লামেন্ট, মন্ত্রী ও এমপিদের বাসভবনে আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষোভকারীরা। নেপালে টানা সহিংস বিক্ষোভে অন্তত ২০ জন নিহত হওয়ার পর গতকাল মঙ্গলবার পদত্যাগ করার পরই প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলিকে নজরদারীতে রেখেছে। এরই মধ্যে নেপাল ও ভারত দুই দেশই সীমান্ত ও আকাশপথে কঠোর নজরদারি শুরু করেছে। নেপালে জেন জি আন্দোলন অবশেষে পতন হলো কে পি শর্মা অলির সরকারের। মাত্র দুদিনের বিক্ষোভেই পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। কিন্তু তার এই ক্ষমতাচ্যুতি আচমকা কোনো ঘটনা নয়। প্রতিবেশী বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায় সরকার পতনের আন্দোলন থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই এমন কঠোর আন্দোলনে নেমেছিলেন নেপালের তরুণরা।
গত সোমবার বিক্ষোভকারীরা পার্লামেন্ট ভবনে ঢুকে পড়ে ভাঙচুর চালায়। এসময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে ১৯ জন নিহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কারফিউ জারি করা হয়। কিন্তু আন্দোলনকারীরা অনির্দিষ্টকালের এই কারফিউ ভেঙেই রাস্তায় নামেন। এর প্রেক্ষাপটে সরকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকেও নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু এবং অন্যান্য শহরে বিক্ষোভ করতে থাকেন বিক্ষুব্ধ প্রতিবাদকারীরা। বিক্ষোভ থেকে নেপালের প্রধানমন্ত্রী ওলি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবাসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতার বাড়িঘরে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে। আন্দোলন-বিক্ষোভ সোমবার প্রাণঘাতী সংঘাতে রূপ নিলেও এর রেশ শুরু হয়েছিল আরও আগে থেকে। হিমালয়ের কোলঘেঁষা দেশটিতে দারিদ্র্য থাকলেও রাজনৈতিক নেতা ও কর্তাব্যক্তিদের সন্তানদের বিদেশে ভোগবিলাস ও রাজকীয় জীবন-যাপন ক্ষোভ তৈরি করছিল। এসব নিয়ে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগের প্লাটফর্মগুলোতে সমালোচনা ও নিন্দা হতে থাকে। এর সঙ্গে প্রকাশ হতে থাকে সরকারের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভও। কিন্তু সরকার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কড়াকড়ি আরোপ করে। এই পদক্ষেপ বুমেরাং হয়। উল্টো রাস্তায় নামেন প্রতিবাদকারীরা। সেই প্রতিবাদ শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকেই পদত্যাগ বাধ্য করলো। নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির পদত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়তেই আন্দোলনকারীদের মধ্যে বিজয়োল্লাস করে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, তারা পার্লামেন্ট প্রাঙ্গণের ভেতরের কিছু অংশ ভেঙে প্রবেশ করে এবং সেখানেই ‘বিজয় পতাকা’ ওড়ান। নেপালের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচিত পার্লামেন্ট ভবন এখন আন্দোলনের প্রতীকী স্থানে পরিণত হয়েছে। এর আগে, সোমবার সংঘর্ষ চরমে পৌঁছালে নিরাপত্তা বাহিনী গুলি চালায়। ওইদিন অন্তত ২০ জন নিহত এবং প্রায় ৫০০ জন আহত হন। আহতদের অনেকেই গুলিবিদ্ধ অবস্থায় বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
নেপালে জেন জি আন্দোলনের মাত্র দুদিনের মধ্যেই পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন কে পি শর্মা অলি। কিন্তু তার এই ক্ষমতাচ্যুতি আচমকা কোনো ঘটনা নয়। প্রতিবেশী বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায় সরকার পতনের আন্দোলন থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই এমন কঠোর আন্দোলনে নেমেছিলেন নেপালের তরুণরা।
কয়েক বছর ধরে দুর্নীতির নানা ঘটনা নেপালের পার্লামেন্ট ও জনসমাজে আলোচিত হলেও কার্যকর সমাধান হয়নি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ২০১৭ সালের এয়ারবাস চুক্তি, যাতে নেপাল এয়ারলাইনস দুটি এ-৩৩০ উড়োজাহাজ কিনে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে প্রায় ১ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন রুপি ক্ষতি করে। পাঁচ বছর তদন্ত শেষে কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা দোষী সাব্যস্ত হলেও জনঅসন্তোষ দূর হয়নি। অংশগ্রহণকারীদের মতে, কর প্রদান করলেও তার সঠিক ব্যবহার নেই—এমন অভিযোগ তরুণদের ক্ষোভ আরও বাড়িয়েছে।
প্রতিবাদকারীরা বলছেন, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায় সাম্প্রতিক সরকার পতনের আন্দোলন থেকে নেপালের তরুণরা অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কা ও ২০২৪ সালে বাংলাদেশে তরুণদের নেতৃত্বে গণআন্দোলন সরকারকে পতন ঘটায়। একইসঙ্গে ফিলিপাইনে রাজনীতিবিদদের সন্তানদের বিলাসবহুল জীবনের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া নেপালের তরুণদের ক্ষোভ আরও উসকে দেয়। এছাড়া, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেপালি রাজনীতিবিদদের সন্তানদের বিলাসী জীবনের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে বঞ্চনার অনুভূতি গভীর হয়। যেখানে দেশের মাথাপিছু আয় মাত্র ১ হাজার ৩০০ ডলার, সেখানে এ বৈষম্য তরুণদের ক্ষোভের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। গত ৪ সেপ্টেম্বর নেপাল সরকার ফেসবুকসহ কয়েকটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধের ঘোষণা দেয়। এতে আগেই ক্ষুব্ধ তরুণদের ক্ষোভ আরও বেড়ে যায়। পোখারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক যোগ রাজ লামিছানে বলেন, এই আন্দোলনের কেন্দ্রে রয়েছে ন্যায়, জবাবদিহি ও ন্যায্যতার দাবি। তরুণরা দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত, আর সরকারের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত তাদের হতাশাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ২০১৫ সালে যুব আন্দোলন হিসেবে যাত্রা শুরু করা সংগঠন ‘হামি নেপাল’ সোমবারের বিক্ষোভ আয়োজন করে। কাঠমান্ডু জেলা প্রশাসন দপ্তরের অনুমতি নিয়েই তারা এ কর্মসূচি পালন করে। তবে বিক্ষোভকারীরা পার্লামেন্টে ভবনের প্রাঙ্গণে প্রবেশের চেষ্টা করলে পরিস্থিতি সহিংস হয়ে ওঠে। এসময় পুলিশ গুলি চালালে অন্তত ১৯ জন নিহত হন, আহত হন পাঁচ শতাধিক মানুষ। এতে আন্দোলন আরও তীব্র হয়ে ওঠে। এ সময় দেশটির সংসদ ভবন, সুপ্রিম কোর্ট, প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্টের বাসভবনসহ সরকারি বেসরকারি স্থাপনা হামলা-ভাঙচুর করেছেন বিক্ষোভকারীরা। দেশটির রাজধানী কাঠমান্ডু ও কান্তিপুরে বিভিন্ন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানেও ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি পদত্যাগের পর পার্লামেন্টের ভেতরে প্রবেশ করেছেন নেপালের শত শত বিক্ষোভকারী। এ সময় পার্লামেন্টের মূল ভবনে আগুন ধরিয়ে দেন তারা। আন্দোলন তীব্র হওয়ার পর মঙ্গলবার পদত্যাগে বাধ্য হন কেপি শর্মা। গত সোমবার পার্লামেন্টে প্রবেশের চেষ্টা করেন বিক্ষোভকারীরা। এ সময় তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। এতে অন্তত ১৯ জন নিহত হন। তরুণদের গুলি করে মারার পর ক্ষোভে ফেটে পড়েন সাধারণ মানুষ। মঙ্গলবার সকাল থেকে কারফিউ ভঙ্গ করে তারা রাস্তায় নেমে আসেন। নেপালের পার্লামেন্ট সেক্রেটারিয়েটের মুখপাত্র ইকরাম গিরি পার্লামেন্টে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেছেন, শত শত মানুষ পার্লামেন্ট এরিয়ায় ঢুকে পড়েছেন এবং তারা মূল ভবনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন। এছাড়াও রাজনৈতিক নেতা ও মন্ত্রীদের বাড়িঘরে হামলা-অগ্নিসংযোগ শুরু করেছেন। কাঠমান্ডু উপত্যকা ও অন্যান্য জেলায় গতকাল মঙ্গলবার এই হামলা চালানো হয়। এছাড়া বিরোধীদলীয় নেতা ও সিপিএন (মাওবাদী কেন্দ্র) এর চেয়ারম্যান পুষ্পকমল দাহালের খুমালতারের বাসভবনেও বিক্ষোভকারীরা পাথর নিক্ষেপ করে। প্রশাসনের কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকলেও তরুণ আন্দোলনকারীদের থামানো যাচ্ছে না। তাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছে সাধারণ মানুষ। তবে নেপালে প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি দেশ থেকে পালাতে পারেন। এই অবস্থায় সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রীর দেশত্যাগ ঠেকাতে ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সব ধরনের উড্ডয়ন ও অবতরণ বাতিল করা হয়েছে। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, বিশেষ অনুমতি ছাড়া কোনো আন্তর্জাতিক বা অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট ছাড়তে দেওয়া হবে না। ফলে আকাশপথে ওলি দেশ ছাড়ার সুযোগ কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। প্রতিবেশী ভারতও সীমান্তে নজরদারি জোরদার করেছে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের পানিটাঙ্কি সীমান্তে বাড়তি পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। বসানো হয়েছে অতিরিক্ত তল্লাশি চৌকি। সীমান্ত পারাপার, যানবাহন ও যাত্রীদের চলাচল নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। সীমান্ত এলাকায় এখন কার্যত উচ্চ সতর্কতা জারি রয়েছে, যাতে কোনোভাবেই ওলি গোপনে প্রবেশ করতে না পারেন। সব মিলিয়ে, ওলি দেশ ছেড়ে পালাতে পারবেন কি না তা এখনো অনিশ্চিত। তবে নেপাল-ভারত উভয় দেশের কঠোর নজরদারি ও সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তার সম্ভাব্য পালানোর পথ কার্যত রুদ্ধ করে দিয়েছে।