বাংলাদেশ

মালয়েশিয়ায় অর্থপাচার অধরা নূরআলী নোমান বশীর সিন্ডিকেট

# বনানী থানায় নূর আলী সিন্ডিকেটের কাউকে আসামী করা হয়নি

# শুধু মালয়েশিয়া নয় মধ্যপ্রাচ্য, সিঙ্গাপুর ও কোরিয়াতেও নানা জালিয়াতির অভিযোগ এই চক্রের বিরুদ্ধে

নিজস্ব প্রতিবেদক
মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানীতে জালিয়াতি অর্থ আত্মসাৎ ও অর্থপাচারের মূলহোতা নূর আলী ও তার সিন্ডিকেটের সদস্যরা অধরাই রয়ে গেছে। সম্প্রতি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআিইডি) ২৭ জনশক্তি রপ্তানীকারকসহ ৩৩ জনের বিরুদ্ধে বনানী থানায় অর্থ পাচারের অভিযোগে মামলা করেছে। ওই মামলায় নূর আলী সিন্ডিকেটের কাউকে আসামী করা হয়নি।
বায়রার সম্মিলিত সমন্বয় ফ্রন্টের সভাপতি মোহাম্মদ ফারুক, মহাসচিব মোস্তফা মাহমুদ, যুগ্ম মহাসচিব ফকরুল ইসলাম ও সিনিয়র সহ-সভাপতি রিয়াজ উল ইসলামসহ বায়রা নেতারা দীর্ঘদিন থেকে নূর আলী-নোমান সিন্ডিকেটর বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে আসছেন। তারা বলেন রহস্যজনক ভাবে সিআইডির মামলায় নূর আলী সিন্ডিকেটভুক্ত ৩১ জনের একজনকেও আসামী করা হয়নি। তারা আরও জানান, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্য, সিঙ্গাপুর, কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রপ্তানীর হোতা নূর আলী। তার সিন্ডিকেটের বাইরে কেউ কোন কাজ করার সুযোগ পাননা। তিনি মালয়েশিয়া সিন্ডিকেটেরও মূল নিয়ন্ত্রক। কোরিয়াতে জনশক্তি রপ্তানী সিন্ডিকেটেরও মূল হোতা নূর আলী।


বায়রার সাবেক নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে ২০২২ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানীকারকদের সিন্ডিকেটে নূর আলীর ছিল জন। এই ৩১ জন বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে। অথচ তাদের বিরুদ্ধে কোন ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। নূর আলী ও তার সিন্ডিকেটভূক্ত সদস্যরা মালয়েশিয়ায় যাওয়া শ্রমিকদের কাছ থেকে ন্যূনতম দেড় লাখ টাকা করে নিয়েছেন। আবার কারও কারও কাছ থেকে দুই লাখ থেকে ছয় লাখ টাকা পর্যন্ত নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ন্যূনতম দেড় লাখ টাকা হিসাবে মালশেয়িয়ায় কর্মী পাঠিয়ে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে নূর আলীর ইউনিক ইস্টার্ন (প্রা.) লিমিটেড। অথচ সরকারি হিসাবে জনপ্রতি তাদের নেওয়ার কথা ছিল ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা। সিআইডি-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নূর আলীর নেতৃত্ব্ ১০ বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সিকে ২০১৫ সালে কর্মী পাঠানোর অনুমতি দেয় মালয়েশিয়া। পেরে এসব এজেন্সি নূর আলী সিন্ডিকেট বা চক্র নামে পরিচিত পায়। নূর আলীর বিরুদ্ধে অন্তত ছয় হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগে ২০১৮ সালে বন্ধ করে দেওয়া হয় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার।

এরপর ২০২১ সালে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের পর মালয়েশিয়া সরকার প্রথমে ২৫ এজেন্সিকে কর্মী পাঠানোর অনুমতি দেয়। ওই ২৫ সিন্ডিকেটও ছিল নূর আলী কব্জায়। পরে সেই এজেন্সির সংখ্যা একশতে দাঁড়ায়। যার মূল নিয়ন্ত্রক ছিলেন নূর আলী। জনশক্তি রপ্তানী সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানান, জনশক্তি রপ্তানী সিন্ডিকেটের মূল হোতা নূর আলী পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থাকে ঘুস দেয়। বিশাল অংকের ঘুষ লেনদেনের কারনে সিআইডির মামলায় তার নাম নাম নেই। বিগত সাত বছর ধরে তিনি এককভাবে বায়রা নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। তিনি ঢাকা জেলা আওযামী লীগের সভাপতি বেজনজির এমপিকে দুইবার বায়রার সভাপতি করেছেন। এছাড়া যুবলীগ মহানগর দক্ষিণের সভাপতিকে বায়রার সভাপতি বানিয়েছেন। বিশেষ কোন সুবিধা পেয়ে সিআইডি কর্মকর্তাদের একটি অংশ তার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সিআইডির এক কর্মকর্তা জানান, ২০২৪ সালের নভেম্বরে নূর আলী ও তার সিন্ডিকেটের সদস্যদের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তৎকালীন সিআইডির প্রধানকে একটি চিঠি দেয় বায়রা সদস্যরে একটি অংশ। চিঠিতে নূর আলী চক্রের বিরুদ্ধে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ করা হয়েছে। চক্রের সদস্য হিসেবে নূর আলী, সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল, সাবেক এমপি নিজাম হাজারী, বেনজির আহমেদ, মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, আওয়ামী লীগ নেতা মহি উদ্দিন মহিসহ বেশ কয়েক জনের নাম উল্লেখ করা হয়। ওই চিঠির পর তদন্ত শুরু করে সিআইডি। এতে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠিয়ে কয়েকগুণ বেশি অর্থ আদায় ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের সঙ্গে অনেকের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। সিন্ডিকেটের ৩৩ সদস্যদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করেছে সিআইডি। আরও সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
সিআইডি ও জনশক্তি রপ্তানী সংশ্লিষ্টরা জানান, ইউনিক ইস্টার্ন (প্রা.) লিমিটেড (আরএল-০০২১)-এর এমডি নূর আলী সিন্ডিকেটে আরও যারা রয়েছেন তারা হলেন, রাব্বী ইন্টারন্যাশনালের (আরএল-০২৫৮) প্রোফাইটর মোহাম্মদ বশীর, দামহাসী কর্পোরেশনের (আরএল-০৭২৭), আমিন ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলসের (আরএল-৮১) ‍রুহুল আমিন, মৃর্ধা ইন্ট্যারন্যাশনাল কর্পোরেশনের (আরএল-১১০৮) কাওসার মৃধা, ম্যানিসপাওয়ার কর্পোরেশন (আরএল-৯৩৭) মো. মাহবুব আলম, অদিতী ইন্টারন্যাশনালের (আরএল-০৯৮৩) বিশ্বজিৎসাহা, সেলিব্রেটি ইন্টারন্যাশনালের (আরএল-০৫০৩) মো. আব্দুল হাই, প্রভাতী ইন্টারন্যাশনালের (আরএল-০৯৩২) মোহাম্মদ আফসার উদ্দিন, সাদীয়া ইন্টারন্যাশনালের (আরএল-০২৯২) শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান, বি.এন.এস ওভারসীজ লিমিটেডের (আরএল-১৪৫০) ইঞ্জিনিয়ার ইসহাক আহমেদ শাকিল, অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনালের (আরএল-১৩১৮) আরিফুর রহমান, আল কাশেম ইন্টারন্যাশনালের (আরএল-০৬৮০) ফরিদ আহমেদ, পি.আর. ওভারসীসের (আরএল-১৯২৮) গোলাম রাকিব, দরবার গ্লোবার ওভারসীসের (আরএল-১২৯৫) মাহবুব মিয়া, সাইট ইন্টারন্যাশনালের (আরএল-০৩৪৫) শাহদাত হোসেন, কাশিপুর ওভারসীসের (আরএল-১৩১৭) মো. রফিকুল হোসাইন, রুবেল বাংলাদেশ লিমিটেডের (আরএল-১৪৫৫) কামরন নাহার হীরামনি, আমান এন্টারপ্রাইজের (আরএল-০৭২৪) মো. রফিকুল ইসলাম পাটোয়ারী, এ্যালিগেন্টস ওভারসীসের (আরএল-০৫৪৪) মিজানুর রহমান, পিএন এন্টারপ্রাইজ কোম্পানী ঢাকা লিমিটেডের (আরএল-০৩৭৬) নূর মোহাম্মদ তালুকদার, দ্যা জিএমজি এ্যাসোসিয়েট লিমিটেডের (আরএল-১১৪৩) মনির হোসেন, থানেক্স ইন্টারন্যাশনালের (আরএল-১৭৭৯) আব্দুল্লাহ সাহেদ, সাওন ওভারসীজের (আরএল-০৭৫৯) এবিএম সামসুল আলম কাজল, ত্রিবেনী ইন্টারন্যাশনালের (আরএল-০০২২) মো. সাইফুল নূর, হৃদয় ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের (আরএল-০২৪০) সৈয়দ গোলাম সরোয়ার, মনসুর আলী ওভারসীস অ্যান্ড ট্রাভেলসের (আরএল-০৯৯১) শাহ ইমরান ভূঁইয়া ও অরবিটালস ইন্টারন্যাশনালের (আরএল-১৪৫৭) নাফিসা কামাল।
বায়রার একাধিক নেতা জানান, বাংলাদেশে জনশক্তি রপ্তানীখাতে অনিয়ম, জালিয়াতি ও বিশৃঙ্খলার জন্য দায়ী নূর আলী ও তার সিন্ডিকেটভুক্ত সদস্যরা। এরা বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রপ্তানীর নামে চাঁদাবাজী মানবপাচারসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত। নূর আলীর প্রভাবসহ অদৃশ্যকারণে তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। নূর আলীর সঙ্গে এই চক্রে ধামহাসি কর্পোরেশনের নোমান ও রাব্বী ইন্টারন্যাশনালের বশীর অন্যতম দোসর হিসেবে কাজ করছে। এরা মালয়েশিয়ায় ১০ সিন্ডিকেটে ছিল আবার ২৫ ও ১০১ ‍সিন্ডিকেটেও ছিল। শ্রমিকের রক্তচুষে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করলেও তাদের বিরুদ্ধে কোন ধরনের আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়যনি। তারা আরও জানান, শুধু জনশক্তি রপ্তানী নয় সিন্ডিকেটের হোতা নূর আলী সিটি কর্পোরেশনের জায়গা দখল করে শেরাটন হোটেল, গুলশানে ওয়েস্টিন হোটেল, আশুগঞ্জ ও মেঘনা ঘাটে পাওয়ার প্লান্ট, বিভিন্ন স্থানে রিসোর্ট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন। তিন দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন। অথচ তার বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
বায়রার নেতারা আরও বলেন, সম্প্রতি সিআইডি মানবচাপার ও চাঁদাবাজির মামলায় আদালতে ফাইনাল রিপোর্ট দিয়েছে। সেখানে সিআইডি পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেছে মালয়েশিয়ায় মানবপাচার ও চাঁদাবাজীর প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কিন্তু এরপরও ৩৩ জনের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের অভিযোগ এনে বনানী থানায় মামলা করা হয়েছে। একই সংস্থার দুরকম তদন্তে সংশ্লিষ্টরা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তাদের কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন নূর আলী চক্র বিপুল টাকা ঘুষ দিয়ে তাদের প্রতিপক্ষ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা করিয়েছে। তবে সিআেইডি বলছে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত অব্যাহত আছে।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) জসিম উদ্দিন খান বলেন, মালয়েশিয়ায় অর্থপাচার সিন্ডিকেটে একটি মামলা হয়েছে। আরও তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে আরও একাধিক মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের সহকারী পুলিশ সুপার আল-মামুন বলেন, নূর আলীসহ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে যারা মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠিয়ে নির্ধারিত ফির বাইরে অর্থ আদায়ের সংশ্লিষ্ট একশ এজেন্সির বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। দেশে-বিদেশে তাদের অবৈধ সম্পদের খোঁজ নেওয়া হবে। বিএফআইইউর সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। মামলার পর ইন্টারপোলের মাধ্যমে পলাতকদের গ্রেপ্তারে সহায়তা নেওয়া হবে।

Related Articles

Back to top button